আগের পর্বে কথা হচ্ছিল, হোমিওপ্যাথির তত্ত্বকে একটু যুগোপযোগী করার সিরিয়াস প্রয়াস সেভাবে কেন নেওয়া হল না, এই নিয়ে।
হ্যানিম্যানসাহেব নিজের বইয়ের ছটি সংস্করণ করে গিয়েছিলেন – তিন দশকের মধ্যে – ষষ্ঠ সংস্করণটি অবশ্য দিনের আলোর মুখ দেখে তাঁর মৃত্যুর পরে আরো আধা শতাব্দীরও অধিক কাল পার করে – হ্যানিম্যানের নিজের ভাষায়, আঠারো মাসের পরিশ্রমের ফসল সেই যথাসম্ভব নিখুঁত সংস্করণ – প্রথম সংস্করণের সাথে তো বটেই, এমনকি পঞ্চম সংস্করণের সাথেও ষষ্ঠের ফারাক অনেক – অর্থাৎ, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, নিজ-অভিজ্ঞতা ও সমকালীন ভাবনাচিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে হ্যানিম্যান নিজের চিন্তাভাবনারও ঘষামাজা করে চলেছিলেন। কিন্তু, সেই সংস্করণের প্রকাশের পর একটি শতাব্দী পার হয়ে গেল – হ্যানিম্যানের তত্ত্বের নতুন বিশ্লেষণের প্রয়াস কিছু কিছু হলেও তত্ত্বটিরই স্থানে আরো আধুনিক তত্ত্বের কথা এখনও কেউ ভেবে উঠতে পারলেন না – কেন? বিশেষত, যখন একথা প্রায় সর্বজনস্বীকৃত, যে, বিজ্ঞানের জগতে স্থির অবস্থান বলে কিছু হয় না – হয় সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলা, উন্নত হয়ে ওঠা – নচেৎ পিছিয়ে পড়া।
এই লেখায় বারবারই আসছে যাঁর প্রসঙ্গ – যিনি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়েও হ্যানিম্যানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন – সেই উইলিয়াম অসলার-এর কথা আবারও শোনা যাক –
“It is not as if our homeopathic brothers are asleep; far from it, they are awake (many of them at any rate) to the importance of the scientific study of disease.”
অর্থাৎ, এমন নয় যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকরা ঘুমোচ্ছেন – তাঁরা, অন্তত তাঁদের বড় একটা অংশ তো বটেই – তাঁরা অসুখবিসুখের বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন।
ব্যাপারটা ঠিক তেমনই দাঁড়াচ্ছে কি? হ্যানিম্যানের সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাণের ওষুধ – যাকে বলা যায় প্রায়-অসীম লঘুতার (infinitesimal dilution) দ্রবণ – ব্যবহারের পিছনে, অনুমান করা যায়, মুখ্য প্রেক্ষিত ছিল সেসময়ের কার্যকরী ওষুধের অভাব এবং ওষুধের ভালোর চাইতে খারাপ করার প্রবণতা।
মাঝের এই দুশো বছরে রসায়ন ও শরীরবিজ্ঞানের উন্নতি চমকপ্রদ – মলিকিউলার কেমিস্ট্রি, মলিকিউলার বায়োলজি জন্ম নিয়েছে হ্যানিম্যানের অনেক পরে – ভূমিষ্ঠ হয়ে এগিয়েও গিয়েছে অনেক অনেএএকগুণ। সেই প্রেক্ষিত ব্যবহার করে তাঁরা তাঁদের এই প্রায়-অসীম-লঘুতার তত্ত্ব নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখবেন না!!
আজ যাঁরা কোয়ার্ক তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে অংশবিশেষ খাবলে হোমিওপ্যাথির পক্ষে যুক্তি সাজাতে চাইছেন – যেমন ধরুন, পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাসমূহ একে অপরের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে আচরণ করে – এবং ক্ষেত্রবিশেষে কণাসমূহের বিশেষ কিছু ধর্ম ও নির্ভরশীলতা, যেমন স্পিন, দুটি কণাকে পরস্পরের থেকে দূরে সরিয়ে নিলেও অপরিবর্তিত থাকে – সেই উদাহরণ দেখিয়ে অনেকে বলতে চাইছেন, একইভাবে, প্রায়-অসীম-লঘু দ্রবণে দ্রাব্যের অণুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার স্মৃতি রয়ে যায় – বিশ্বাস করুন, এবম্বিধ যুক্তিক্রমের সাথে পুষ্পকরথ বা গণেশরূপ দেখিয়ে বৈদিক যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রমাণ দাখিলের ফারাক নেই। নেহাত তর্কের খাতিরে তাঁদের যুক্তি মেনে নিতে চাইলেও পাল্টা প্রশ্ন থাকেই, দ্রাব্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণের উপস্থিতি যদিও বা স্মৃতির সুবাদে দ্রবণটিকেই দ্রাব্যের ধর্মানুসারী করে তোলে – তাহলে, দ্রাব্যের উপস্থিতি যত কমবে (বা দ্রাব্য এমনকি অনুপস্থিত হয়ে গেলেও) দ্রবণটি ততোই জোরালোভাবে দ্রাব্যের ধর্ম নিতে থাকবে কেন? যাঁরা হোমিওপ্যাথির সাথে ন্যানোকেমিস্ট্রিকে এক করে দেখাতে চান – তাঁদের ক্ষেত্রেও একটাই কথা – উপাদানের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার স্মৃতির দ্বারা শারীরবৃত্তীয় কার্যসিদ্ধির আশা কিছু কিছু আধ্যাত্মিক দর্শনে চললেও চলতে পারে – বিজ্ঞান বলে চালানো মুশকিল।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বা মডার্ন মেডিসিন বা অ্যালোপ্যাথি, যে নামেই ডাকুন না কেন, তার সাথে হোমিওপ্যাথির মূলগত প্রভেদ রয়েছে – সে কথা মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু, সমকালীন রসায়ন-পদার্থবিদ্যা-গণিতের নিয়মকানুনকে অস্বীকার করে প্রায়-অসীম-লঘু দ্রবণকে অসম্ভব শক্তিশালী ওষুধ বলে চালাতে গেলে সে চিকিৎসাদর্শনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় – উঠতে বাধ্য।
মাথায় রাখা যাক, ওষুধ মাত্রেই একটি রাসায়নিক পদার্থমাত্র – হ্যাঁ, ভেষজ উপাদানও কিছু রাসায়নিকের সমষ্টিই। সে ওষুধের কিছু রাসায়নিক ধর্ম থাকবে – মানবদেহে ওষুধটির ক্রিয়া এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সাথে অনেকাংশে থাকবে সেই রাসায়নিক ধর্মের সংযোগ। মানবদেহে সে ওষুধের ক্রিয়া কেমন দাঁড়াতে পারে, তা যাচাই করার পথ দুটি – এক, গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে (উদাহরণ – culture media) – দুই, মনুষ্যেতর প্রাণীদেহে (ইঁদুর বা গিনিপিগ) বা মানবদেহে। এই দুই পরীক্ষাপদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, তার ফলাফল সবসময় একই দাঁড়ায় না – বা কৃত্রিম মাধ্যমের ফলাফল বা গিনিপিগের শরীরে ওষুধের ক্রিয়ার অনুরূপ ফলাফল মানবদেহে সর্বদা পরিলক্ষিত হয় না।
কিন্তু, পরীক্ষাগারে ওষুধের রাসায়নিক ধর্মের ক্ষেত্রে সে সমস্যা নেই – একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক যৌগের সাথে আরেকটি যৌগের বিক্রিয়া ও তা থেকে পরীক্ষালব্ধ তথ্য সর্বদাই একই হবে, যদি পরীক্ষাটি সঠিক পথে করা হয়।
কাজেই, প্রায়-অসীম-লঘুতার দ্রবণ কার শরীরে কাজ করবে আর কার শরীরে করবে না, সে বোঝার চাইতে ঢের সহজ সে দ্রবণের রাসায়নিক বিশ্লেষণ – ওষুধের গুণাগুণ অর্থে কিছু রাসায়নিক ধর্ম – রাসায়নিক ধর্মকে শরীরে ওষুধের ক্রিয়াকলাপের প্রতিনিধি বা সারোগেট মার্কার হিসেবে মেপে দেখাই যায় – রাসায়নিক ধর্মের উপর নির্ভর করে ওষুধটি শরীরে উপযুক্ত অংশে পৌঁছাতে পারবে কিনা বা বেশীক্ষণ ধরে শরীরে থেকে বাড়াবাড়িরকমের কাজ করতে গিয়ে উল্টো বিপত্তি করবে কিনা – কাজেই, ঔষধ-উপাদানের একটি অণুর উপস্থিতি ছাড়া বা খুব কম পরিমাণে দ্রাবকের উপস্থিতিতেই সমগ্র দ্রবণটি সেই উপাদানের ধর্ম অনুসারে বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম কিনা, সে তো রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমেই যাচাই করে দেখা সম্ভব। অর্থাৎ, একটি ওষুধ খাওয়ার পরে রক্তে সে ওষুধের মুখ্য উপাদান বা তার বিক্রিয়াজাত উপাদান উপস্থিত কিনা, সে তো রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ধরে ফেলা যায়। সে পরীক্ষায় প্রত্যাশানুরূপ ফল না পেলে, প্রায়-অসীম লঘুতার তত্ত্ব (law of infinitesimal dilution) অবৈজ্ঞানিক – তাই না??
এ নিবন্ধের একেবারেই শুরুতে বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়ে কার্ল পপারের নাম উল্লেখ করেছিলাম – বলেছিলাম, পপারের ফলসিফায়েবিলিটিকে সিদ্ধ ধরেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করছি। সে তত্ত্বের মূল কথা, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সেটাই, যাকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিছু পূর্বাভাস দিয়ে থাকে – যে পূর্বাভাসগুলি পরীক্ষাযোগ্য – পরীক্ষার ফলের সাথে পূর্বাভাস না মিললে প্রথমে পরীক্ষাপদ্ধতিটি সঠিক কিনা, পরখ করা জরুরী – এবং পরীক্ষাপদ্ধতি যদি সঠিক হয় ও পূর্বাভাস পরীক্ষায় প্রমাণিত না হয়, তাহলে তত্ত্বটিই ভ্রান্ত – অন্তত, বিজ্ঞানের তত্ত্বের ক্ষেত্রে যাচাইয়ের এই নীতি গ্রাহ্য। প্রায়-অসীম-লঘুতার দ্রবণের তত্ত্ব সেই কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আসতে পারছে কি?? রাসায়নিক বিশ্লেষণে ঔষধ দ্রবণে বিন্দুমাত্র ঔষধ-উপাদানের উপস্থিতির প্রমাণ না পাওয়া গেলে এবং হাজার ঝাঁকানোর পরেও ঔষধ-উপাদানের অনুপস্থিতিতে দ্রবণটির রাসায়নিক ধর্ম ঔষধের অনুরূপ না হয়ে উঠতে পারলে – প্রায়-অসীম-লঘুতার তত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণ হয় না কি?? হোমিওপ্যাথির গবেষকরা সেই সরল পথ মানতে না চেয়ে নিত্যনতুন পথ ধরে প্রায়-অসীম-লঘু দ্রবণের রাসায়নিক আচরণের বিচিত্র তাত্ত্বিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছেন – অর্থাৎ, সরাসরি পরীক্ষার মধ্যে না গিয়ে কেন ও কীভাবে ঔষধ-উপাদানের অণুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও দ্রবণটির ওষুধে পরিণত হওয়া সম্ভব, সেই নিয়ে বিবিধ যুক্তি বা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অবতারণা করছেন – কেন? গবেষণার নামে সহজ-সরল রসায়নের পরীক্ষার পথ না ধরে জটিল তত্ত্বের অর্ধপাচ্য উদগারের অনুশীলন করছেন – কেন??
বিজ্ঞান এগোয় একটি তত্ত্বকে ধরে – নিত্যনতুন পরিস্থিতিতে নিত্যনতুন পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সেই তত্ত্ব হয় বাতিল হয়, নাহলে আরো মজবুত হয় – এটাই বিজ্ঞান। আর, একটি তত্ত্বকে স্থির ও অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নিয়ে – পরীক্ষানিরীক্ষাতে সেই তত্ত্বের ফাঁকফোকড় ধরা পড়লে – নিত্যনতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে যে-করেই-হোক সে তত্ত্বকে সত্য বলে খাড়া করে রাখার চেষ্টাটাই অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান। নিজেদের চর্চার বিষয়টিকে সে জায়গায় এনে দাঁড় করাতে চাইছেন কেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবুরা?? মাথায় রাখা যাক, জ্যোতির্বিজ্ঞান বহু যোজন এগোলেও এবং নতুন গবেষণালব্ধ তথ্যের সাথে বিপ্রতীপ অবস্থান সত্ত্বেও, জ্যোতিষকে অভ্রান্ত বলে প্রমাণ করার চেষ্টার অভাব নেই – এমনকি, একটা বড় অংশের জ্যোতিষী জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিয়দংশ খাবলে তাকে জ্যোতিষের পক্ষে যুক্তি হিসেবে পেশ করে থাকেন – শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবুরা নিজেদের চিকিৎসাপদ্ধতিকে সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনছেন কেন?
পছন্দ হোক বা না হোক, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবুরা বাধ্য – না, আইনত বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন উঠছে না – এ বাধ্যবাধকতা মূলত নীতিগত।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে দীক্ষিত ডাক্তারবাবুদের হোমিওপ্যাথি নিয়ে যে অন্যতম প্রধান অভিযোগ – চিকিৎসার নামে সময় নষ্ট করিয়ে দেওয়া – সেবিষয়ে আর ঢুকতে চাইছি না। ক্যানসারের চিকিৎসা করি – কাজেই, এ অভিযোগের সারবত্তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করার মতো অভিজ্ঞতা বিস্তর। এই লেখা লেখার মধ্যেই একজন ফোন করলেন – তাঁর মায়ের ডিম্বাশয়ের ক্যানসার – সফল অস্ত্রোপচারের পর কেমোথেরাপি নিতে বললেও “বড্ডো সাইড-এফেক্ট” ভেবে তাঁরা ওপথে জাননি – শরণাপন্ন হয়েছিলেন ব্যানার্জিমহাশয়ের – আট মাসের ধন্বন্তরি চিকিৎসার শেষে এখন মায়ের যায়-যায় দশা – অতএব, একটু অঙ্কোলজিস্ট দেখালে কেমন হয়!! এমন অভিজ্ঞতা নেই, এরকম অঙ্কোলজিস্ট এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না – ঠিক যেমন পিত্তথলির পাথর গলিয়ে ফেলা যাবে এই আশায় বছরখানেক হোমিওপ্যাথি ওষুধ সেবনের শেষে সরল অস্ত্রোপচারের জটিলতা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেলে সার্জেন দেখাতে এসেছেন, সে অভিজ্ঞতা নেই, এদেশে এমন সার্জেন বিরল – এবং আশ্চর্য ব্যাপার হল, উভয়ক্ষেত্রেই পরিজনের হতাশার অভিমুখটি থাকে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকের প্রতি – গুরুত্বপূর্ণ সময়টা যিনি নষ্ট করে দিলেন, সেই হোমিওপ্যাথির উদ্দেশে বক্তব্য সচরাচর – আসলে অসুখটাই খারাপ ধরণের, হোমিওপ্যাথি খাওয়ার সময় তো অন্তত সাইড-এফেক্টের কষ্টটা পায়নি অত!!
কিন্তু, আমার প্রশ্নটি আরো অনেক বুনিয়াদি পর্যায়ে – হোমিওপ্যাথির মুখ্য উপপাদ্যসমূহ আদৌ বিজ্ঞানের অনুসারী কিনা। গ্যারান্টি দিয়ে উপশম যাঁরা করে থাকেন – তাঁদের নাম আপনি লোকাল ট্রেনের কামরায় বা বিনামূল্যের শৌচালয়ের দেওয়ালে পেয়ে যাবেন। কিন্তু, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অন্যতম স্বীকৃত অঙ্গ অনিশ্চয়তা – একই পর্যায়ের একই অসুখে একই চিকিৎসাপদ্ধতি নিপুণভাবে অনুসরণ করার পরেও সব রোগীর চিকিৎসার ফলাফল একই হয় না – এবং এই ফলাফলের ফারাকটার কারণ, চিকিৎসকের গাফিলতি বা অপদার্থতা নয় – দায়ী, আবারও বলি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্তর্লীন সেই অনিশ্চয়তা – মডার্ন মেডিসিনের ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি, হোমিওপ্যাথি যদি বিজ্ঞান হয়, তাহলে সেই অনিশ্চয়তার যুক্তি তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কাজেই, চিকিৎসায় ভালো ফলাফল সবসময় পাওয়া যাবেই, এমন গ্যারান্টি নেই – হোমিওপ্যাথি যদি বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসাপদ্ধতি হয়, তাহলে সে চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া যায়নি বলে প্রয়াসটুকুকে সময় নষ্ট বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং, বুনিয়াদী প্রশ্নটা হোমিওপ্যাথিতে বিজ্ঞানের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে – সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মিললে বাকি প্রশ্ন বা অভিযোগের ফয়সালা অনুসিদ্ধান্ত মাত্র।
হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবুদের প্রতি একটিই অনুরোধ – তাঁরা নিজেদের চিকিৎসাব্যবস্থাটিকে আরেকটু সচেতনতার সাথে গ্রহণ করুন। মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসকরা মানুন বা না মানুন, এদেশের অসংখ্য মানুষ হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা বিষয়ে আস্থাশীল – তাকে যাঁরা অশিক্ষাসঞ্জাত বলে দাগিয়ে দিতে চান, তাঁদের জানানো যাক, জনসাধারণের আস্থার ব্যাপারে ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশেও হোমিওপ্যাথি পিছিয়ে নেই। কার্যকারিতা বলতে শুধুই প্লাসিবো কিনা, সেও হয়ত আরেকটু খতিয়ে দেখা জরুরী। বড় বড় অসুখের কথা বাদ থাক, খুব সাধারণ উদাহরণ নেওয়া যাক – যেমন ধরুন আঁচিল এবং কড়া (warts and corn) – এই সমস্যায় একটি বিশেষ হোমিওপ্যাথি ওষুধ (যেটি মুখে খাওয়ার ও ত্বকে সরাসরি প্রয়োগ করা, দুরকমভাবেই ব্যবহৃত হয়) ব্যবহার করে সুফল পাননি, এমন ভুক্তভোগী বিরল – একে কি শুধুই প্লাসিবো বলা যাবে!! কার্যকারিতা যদি থাকে, প্রমাণ হয়ে আসুক রাশিবিজ্ঞানস্বীকৃত পদ্ধতিতে – সে প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, গবেষণা হোক কী পথে এলো আরোগ্য – বিজ্ঞান বলতে এটাই। সে পথে না হেঁটে এ-অতি-গভীর-চিন্তনের-ফসল-অল্প-কথায়-বোঝানো-যায়-না-র যুক্তি নেহাতই অপযুক্তি ও উত্তর এড়ানোর অপপ্রয়াস মাত্র।
হোমিওপ্যাথদের উদ্দেশে বলি, দুশো বছর কম সময় নয় – বিজ্ঞানের জগতে তো নয়ই। অণু বা পরামাণুর অস্তিত্ব প্রমাণ হয়েছে এই সবে গত শতকের শুরুতে – জিন-ডিএনএ-র কথা তো ছেড়েই দিন। সেখানে, দুশো বছর আগেকার কোনো চিকিৎসাদর্শন, সে দর্শনের উদ্ভাবক যতো উন্নত মেধার জিনিয়াসই হোন না কেন, একইভাবে উপযুক্ত ও প্রযোজ্য থাকতে পারে কি? থাকা সম্ভব?? অতএব, সেই দর্শনের পিছনে সমকালীন বিজ্ঞানের লব্জ ধার করে ছেঁড়াফাটা তাপ্পি লাগানোর চেষ্টা করে নিজেদেরকে লঘু করবেন না প্লীজ। ভাবনাটাই নতুন করে ভাবুন।
অসলার-এর উক্তি দিয়েই শেষ করব –
“It is distressing that so many good men live isolated in a measure from the great body of the profession. The grievous mistake was ours: to quarrel with our brothers over infinitesimals was a most unwise and stupid thing to do.”
না, এই উক্তির অনুবাদ করছি না আর।
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা যে খুব স্বস্তিকর অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন তো নয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। যে পথ ধরে যেসব প্রশ্নের যেভাবে উত্তর খোঁজা হচ্ছে – প্রশ্ন সে নিয়েও।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান একটিমাত্র পথ ধরেই সমাধানে পৌঁছাতে পারবে কিনা – সে নিয়ে, অন্তত বর্তমান লেখকের, সংশয় রয়েছে। অতএব, কথোপকথন জরুরী। জরুরী সবধরণের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থার সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
কিন্তু, ওই “বিজ্ঞানসম্মত” শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মডার্ন মেডিসিনের যোগ্য সহযোগী বা গ্রহণযোগ্য বিকল্প বা উপযুক্ত প্রতিস্পর্ধী – যেভাবেই দেখুন না কেন – সে হিসেবে প্রমাণিত হতে গেলে যেকোনো চিকিৎসাব্যবস্থাকেই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আসতে হবে। হোমিওপ্যাথিও এ নিয়মের ব্যক্তিক্রম নয়।
(শেষ)
ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু,
এরকমই একটা লেখা খুঁজছিলাম।