জনমেজয় এসে বললো–“আবার কিন্তু গাছ কাইট্যে নিয়ে যাচ্ছে স্যার। চ্যাংড়াগুলা…।”
বসেছিলাম আউটডোরে। রোগীপত্তর নেই। অল্প যে ক’টা ছিল, ছেড়ে দিয়েছি খানিক আগেই। তারপর চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বাইরেটা পিটপিটিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। হাতে পায়ে কৈশোরের আলসেমি। জনমেজয়ের কথায় চটকাটা ভাঙলো। উঠে বসলাম ভালো করে। বললাম– চলো। কই দেখি।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে ঝেঁপে। আকাশের রঙ তালমিছরির মতো আশ্চর্য। স্পষ্ট বোঝা যায়, নির্ঘাৎ আলো আছে ওইপারে। কিন্তু সে আলোর ওপরে কালচে রঙের পাৎলা ওড়না ফেলে দিয়েছে কেউ। দিনের আলোও তাই সন্ধ্যার মতো ময়লাটে। এটাও যদিও কেটে যাবে শিগগিরই। যে বেগে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আকাশ এবার ফর্সা হলো বলে। রুগীও আসতে শুরু করবে তারপর টপাট্টপ। ওই ততক্ষণই যা একটু ছুটি। কুকুরদুটো দেখলাম মাঠ ছেড়ে দাওয়ায় এসে উঠেছে চুপি চুপি। লোমের ওপরে বৃষ্টিজলের গুঁড়ো। কাঁপছে তিরতিরিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে দেখলো একবার। লেজ নাড়লো বড় কষ্টে। তারপর আবার ঘুম লাগালো পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে। ঘুমাক। আমি বরং ‘চ্যাংড়াগুলারে’ ধরি গা যাই দেখি।
জনমেজয় হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। ফিসফিসালো ষড়ের ভঙ্গীতে–“এইখানেই দাঁড়ায় থাকেন, স্যার। এই সাইডে। এদিকেই আসতেছে। পাইর হবে এখুনি সামনে দিয়েই।”
সামনে, মাঠের বুক চিরে হাসপাতালে ঢোকার আর বেরোনোর এক চিলতে রাস্তা। পেভার্স ব্লক দিয়ে সাজানো চমৎকার রকমের। মাঠ ছাপিয়ে এবার, সেই ব্লকেও জল উঠছে ছুঁইছুঁই। শীত শীত ভাব বাতাসে। ছাতা মাথায় দেখি জনা চারেক রুগী ঢুকলো। মুখ চেনা। এ পাড়ারই। সুগার আর প্রেসারের ওষুধ নিয়ে যায় সপ্তাহে সপ্তাহে। আসুক। টিকিট করুক। আমি ততক্ষণ এই বখেড়াটা সামলে নিই টুক করে।
দুটো লোক এলো। বাঁ দিক থেকে মাঠ পেরিয়ে। কদম গাছের তলা দিয়ে। এসেই, সোজা আমার মুখোমুখি। ঠিক যেমনটি জনমেজয় বলেছিল। দেখলাম ভিজছে। ভ্রুক্ষেপহীন ভিজে ভিজে চলেছে দু’জনে। চ্যাংড়া নয় যদিও। মাঝ বয়সী। কালচে রঙের হাফ প্যান্ট। ফুল হাতা জামা। চপ্পল। ভিজে গেছে সবগুলোই চুপ্পুস হয়ে। চুল দিয়ে জল ঝরছে টপাটপ। সাথে করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটো লজ্ঝড়ে সাইকেল। সেগুলো বোঝাই গাছের ডালে। কেরিয়ারে, হ্যান্ডেলে, রডে… সব বেঁধে রেখেছে বেশটি করে কষে দড়ি দিয়ে। কাঁঠাল পাতা দেখা যাচ্ছে পুরু পুরু। কাটারি ঝুলছে কোমর থেকে। আমাকে দেখেই থমকে গেল লোকদুটো। এরাও চেনা। বস্তুত কিলোমিটার পাঁচেকের মধ্যে অধিকাংশই চেনা পরিচিত হয়ে গেছে এই এতদিনে। গলা তুলে, হাত নেড়ে ডাকলাম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে –“হোই…এই যেঃ। এসো এসো। এদিকে এসো।”
লোকদুটো থতমত খেয়ে থেমে গেল। গুজগুজ করলো নিজেদের মধ্যে অনুচ্চে সেকেন্ড খানিক। তারপর একজন এগিয়ে এলো সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করে। চপ্পল খুলে হাত জোড় করলো মাথা ঝুঁকিয়ে। জড়োসড়ো ভঙ্গী। ঠিক যেন অঞ্জনী পুত্র। সমর্পণ করছে নিজেকে পুরুষোত্তমের কাছে।– বলেন স্যার।
মেজাজটা সম্ভবত খাট্টাই ছিল আমার। অথবা বৃষ্টি-মেদুর মনে বিঘ্ন ঘটাতে বিগড়ে ছিল দস্তুররকম। টেনে ধমক লাগালাম গলা ছেড়ে– বলেন স্যার? হ্যাঁ? ব-লে-ন স্যা-র? ফাইজলামি মারতেসো? কার পারমিশান নিয়া গাছ কাটতেছিলা? হ্যাঁ? কার পারমিশন? জানো না? সরকারি সম্পত্তি? পুলিশে খবর দিবো? দেখবা? যাও.. যাও গিয়ে ফালায় আসো যেখান থেকে নিছো। আর কোনোদিন যদি…। মাইর লাগাতে হয় তোমাদের ধরে।
একতরফা হুহুঙ্কারে, লোকদুটো আরো কেঁচো হয়ে গেল। ঠিক যেন জলে ভেজা ঠোঙা। ইনিয়ে বিনিয়ে হাত কচলাতে শুরু করলো পা জড়ো করে। “সরি সার। ভুল হোই গ্যাছে সার। বুঝি নাই সার। লাকড়ি নাই ঘরে সার। চুলা জ্বালাবো ভাইব্যে…। পাতাগুলা ছাগলরে দিমু…। ভুল হোই গ্যাছে। এই কান ধরতেসি সার। ”
হাত তুলে কান ধরলো লোকগুলো সত্যি সত্যি। তারপর চপ্পল পরে উল্টো মুখে চলে গেল সাইকেল তিরতিরিয়ে।
খাট্টা মেজাজটা আরো বিচ্ছিরি রকমের খাট্টা হয়ে গেল আমার। অসম্ভব রকমের একটা চিড়বিড়ানো বিরক্তি। ব্যাজার মুখ করে আউটডোরে ফেরত এলাম ধীর পায়ে। রোগীর ভিড় জমেছিল ছোট্ট। ছাড়লাম। তারপর আবার চেয়ারে হেলান, পা টান টান আলসেমি। নাহঃ। বৃষ্টিটা বোধহয় আর থামবে না মনে হচ্ছে। একটা তো বাজতে চললো প্রায়। রুগীও বোধহয় আসবে না আর। বরং বৃষ্টিই দেখি। যদিও ভাল লাগছে না আর দেখতে। খচখচ করছে মনটা কিরকম। একটু বোধহয় বেশিই বকাবকি করে ফেললাম লোকদুটোকে। বেচারি… বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে…। অবশ্য, ভুল তো কিছু করিনি। নাহঃ। করিইনি। সরকারি সম্পত্তি। যা ইচ্ছে একটা কেটে নিয়ে গেলেই হলো? চিনি তো এদের। একবার ঢিলে দিয়েছ কি মাথায় চড়ে বসবে সদলবলে। কেটেকুটে হাপিস করে দেবে গোটা গাছটাকেই। তখন আবার রাজ্যের ঝামেলা। চিঠিপত্তর,বনদপ্তর, সুপার অফিস। … নাহঃ। ঠিকই আছে। … ভুল করিনি কিছু। শিক্ষা হওয়া দরকার ছিলো ব্যাটাচ্ছেলেদের। … তবে, একটু কম করে বকলেও হতো মনে হয়। ভিজছিলো…। বেচারি…। গরীব দুঃখী মানুষ সব…।
পায়ের আওয়াজে ভাবনার মালগাড়ি থেমে গেল। মুখ তুলে দেখি বিশ্বজিৎবাবু। ভদ্রলোক প্রকৃতিপ্রেমিক। রেসকিউ করেন বেঘোরে আটকে পড়া জীবজন্তুকে। করে, তারপর বনে জঙ্গলে ছেড়ে দেন। সাপ, বেজি, প্যাঁচা, ভাম। এইসব। বাছবিচার নেই তেমন কিছু। কুকুর টুকুরেরও শুনেছি দেখভাল করে বেড়ান শহর জুড়ে। পরিচয় ছিল না আগে। অধুনা হয়েছে। গত মাস তিনেক ধরে ভদ্রলোক চেকআপ করিয়ে যান আমাকে দিয়ে মাঝেমধ্যে। এমনিই। জ্বর-সর্দি, পেটখারাপ, গ্যাস-অম্বল। মামুলি টুকটাক আর কি। প্রেশারও মাপান মাঝেমধ্যে। মেপে দি। গল্প করি। ভালো লাগে। মানুষটা বেশ। মরমী। দয়ালু। পশুপাখী নিয়েই বেঁচে আছেন সহজে সরলে।
হাসলাম। বললাম– বসুন। প্রেসার দেখাবেন?
ভদ্রলোক বসলেন। রুমাল বের করে মুখ মুছলেন সামান্য। হাসলেন ফিরতি।– নাহঃ। এমনিই। একটা গোখরো রেসকিউ করলাম। দেখবেন নাকি? ছবি? বলে, ফোন খুলে এগিয়ে ধরলেন। কুলো পানা চক্কর নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে ফুটখানেক। দেখলেই বুকের রক্ত জল হয়ে যায় ঝটকাতে।
— এই তো, এই নদীর পাশেই ছেড়ে এলাম ব্যাটাকে। আপনার পাশের পাড়াতেই ঢুকেছিলো। একটা বাড়িতে। কল করলো। ধরে, ছেড়ে এলাম। তো ভাবলাম দেখা করে আসি আপনার সাথে। সামনেই তো…।
বৃষ্টিটা বোধহয় এবার ধরবে শেষমেশ। মেঘ ওড়ানোর হাওয়া শুরু হয়েছে দমকা। জোলো স্পর্শ ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। মিঠু এসে ভেজিয়ে দিচ্ছিলো সেগুলোই একটা একটা করে। ঘর অন্ধকার হয়ে আবছায়া। তাই সুইচ দাবিয়ে বাতি জ্বালিয়ে দিলো দুটো । বললো–“উঠবেন এখন? নাকি থাকবেন? তাহলে চাবিটা টেবিলে রেখে দিয়ে যাই?”
ঘাড় নাড়লাম মুখ তুলে।–“যা। ফার্মাসি ঘরে তালা দিয়েছিস? ল্যাবে? ঠিক আছে। সামনের দরজাটা আমিই আটকে দেব যাওয়ার সম’তে তখন…। ছাতা এনেছিস তো?”
প্যান্ট গুটাচ্ছিল মিঠু। হেসে, হাত তুলে ছাতাটা দেখালো। তারপর চলে গেল সাইকেল নিয়ে। আমি বিশ্বজিৎবাবুকে পাকড়াও করলাম আবার। রাউন্ডে যেতে পারবো না এখনই। ছাতা আনিনি সঙ্গে করে। আনিও না কোনোদিনই। বাদলার দিনে কারো না কারো ছাতা ধার নিই ইনডোরে যাওয়ার পথটুকুতে। পেশেন্ট বা স্টাফেদের। মিঠুকে আটকালেও হতো। ছেড়ে দিয়ে আসতো এক ফার্লং খানিক ইনডোর তক্কো। আটকালাম না। থাক। থেমেই যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ততক্ষণ গল্প গুজব করি একটু।
— নদীর পাড়ে ছাড়লেন মানে? কোন নদী? করলা? মানে, এই এ-ই করলা? মাঠের ওইপারে?
“হ্যাঁ। এই তো…”বাঁ হাতটা তুলে দেখালেন বিশ্বজিৎবাবু। ইঙ্গিতে বোঝালেন মাঠের ওইপারটাকে। তারপর টুলটা একটু টেনে এনে বললেন–“এদের খুব লজ্জা…বুঝলেন কিনা! খুবই লাজুক এরা। ঠান্ডা প্রকৃতির। ভালোমানুষ টাইপের। দাঁড়াইশের মতো গুন্ডা নয়। নতুন জায়গায় মানিয়ে গুছিয়ে নিতে অসুবিধা হয় গোখরোর। লে-খা… তা ধরুন নেই কোথাও সেভাবে। কিন্তু আমি দেখেছি। কম দিন তো হল না। সেই ক্লাস টেন থেকে এদের নিয়েই তো কারবার। একবার একটা গোখরো… সাপেদেরও হ্যান্ডিক্যাপ হয় জানেন তো!… তো গোখরো একটা, ফণাটার সাইডে ছোট্ট করে কাটা… ন্যাচারাল। ইনজুরি টিনজুরি নয়। রেসকিউ করে দূরে ছেড়ে এলাম একজা’গাতে। তারপর দিন পনেরো পরে কল পেয়েছি। গেলাম। ওই যেখানে ছেড়েছিলাম ওই এরিয়াতেই। ছাগল চরাইতে গিছলো ছেলেরা। সাপ দেখে খবর দিয়েছে। গিয়ে দেখি … সেই গোখরোটাই। ছোট্ট কাটা ফণার ডান কর্নারে। শুয়ে আছে। কী চেহারা হয়েছে সাপটার… ভাবতে পারবেন না। না খায়ে খায়ে শুকায়ে আদ্ধেক হয়ে গেছে একেবারে। নির্জীব। নড়তে চড়তেও পারছে না। মায়া হলো বুঝলেন ! পরিবারের হেল্প নিই আমি। মানে… খুব দরকার পড়লেই। বাড়ি নিয়ে এলাম বেচারাকে। আমি আর আমার পরিবার দেখভাল করলাম ক’দিন। খাওয়ালাম হাতে করে। একটু সুস্থ হতে, ওর কাছাকাছি জঙ্গলে ছেড়ে দিলাম। একদম টনটনা। সেই চেহারা ছবি। চকচক করছে একেবারে। … এরকম আরো দু’তিনবার দেখেছি। গোখরো, নিজের এরিয়ার বেশি বাইরে চলে গেলে আত্মহত্যা করে। দানাপানিও মুখে তোলে না। অভিমানী সাপ খুব। এইটা তাই নদীর ওইখানেই ছেড়ে এলাম। লোকবসতি তো কিছুই নাই ওদিকে। আবার ধরুন… কাছাকাছিও হলো। থাক। থাক ক’টাদিন একা একা। একটা জোড়া আছে ওর শুনছি। আজ পেলাম না খুঁজে। ওরা দেখলেই কল করবে বলেছে। তখন ওই নদীর ধারেই ছেড়ে আসবো গিয়ে। খুব খুশি হবে তখন দু’জনে…।”
বিশ্বজিৎবাবু ফোন পকেটে নিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন বাইক স্টার্ট দিতে দিতে–“রাউন্ডটা এবার দিয়েই দ্যান বুঝলেন। আকাশটা দেখ্সেন তো? আবার নামবে এক রাউন্ড। বাড়ি ফিরে যান তার আগে আগে। চ্চলি।”
বৃষ্টিটা সত্যিই থেমেছে। কদম গাছটা দিয়ে জল ঝরছে বড় বড় ফোঁটার। বাতাসে, পেট্রলের আবছা গন্ধ। কুকুর দুটো ঘুম কাটিয়ে উঠে ল্যাজ নাড়ছিলো। অন্যমনস্ক ভাবে বিস্কুট খাওয়ালাম ভেঙে ভেঙে। গল্প করছিলাম যতক্ষণ, ততক্ষণ টের পাইনি একটুও। এখন, এই একলা আউটডোর চৌহদ্দিতে অনুভূতিটা আবার ফেরত এলো। কেমন একটা চটচটে ভাব। কাদা লাগা পা জল দিয়ে ধুলেও যেমন একটা খুঁতখুঁতেমি আঠা আঠা লেগে থাকে, ঠিক ওইরকম। নিজের ওপর বিরক্তিটা আর যাচ্ছে না কিছুতেই। লক-ডাউনের বাজার। লোকের হাতে কাজবাজ নেই। টাকা পয়সাও তলানিতে। রেশনের কয়েক কেজিতে আর কতটুকুই বা চলে! না না…ইশশ! না বকলেই হতো অতখানি। কাঁঠাল পাতা খেত নাহয় ছাগলগুলো দুটো। চুলা জ্বলতো। দুঃখী মানুষ সব। বড়ো সাদাসিধা। ভিজছিলো। জল ঝরছিল হাফ প্যান্টের ঘের থেকে…।
মনটাকে ঝাড়া দিয়ে রাউন্ডে গেলাম। রুগীগুলোকে দেখলে তবুও মন ভালো হয় একটু আধটু। ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির পেশেন্ট সব। মরে যেতে পারে জেনেও দিন কাটাচ্ছে দিব্যি। লুডো টুডো খেলছে। গল্প গুজব। হিন্দি গান মোবাইল ফোনে। মেরে হাথোঁ মে ন ন চুড়িয়াঁ হ্যায়। হাসি ঠাট্টা মাঝেসাঝে।
রুমে রুমে ঢুকে রাউন্ড শুরু করলাম। চতুর্থ রুমে ঢুকে দেখি, অরবিন্দ শুয়ে আছে চাদর ঢাকা নিয়ে। পায়ের কাছে কাপড়ের পুঁটলির মতো বউটি। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে স্বামীর পায়ে। এরা দু’জন জুটিতেই থাকে। স্বামী বিনা বউটির কেউ নেই। ছেলে মেয়েরা লায়েক হয়ে ভিনু হয়েছে। একলা বাড়িতে এই দুজনেরই সংসার। কেঁদে ফেলেছিল বউটি হু হু করে। — এখানেই রেখে দ্যান বাবু। ঘরে কেউ নাই। কে দ্যাখবে? এখানেই রেখে দেন দুইজনকেই। সুস্থ হইলে বাড়ি নিয়া যাবো।
এরকমটা যদিও নিয়মে নেই। রোগী ছেড়ে দেওয়ার কথা হপ্তা দুয়েকেই। বাদবাকি কোর্স বাড়িতে থেকে খাবে। তবুও রেখে দিয়েছিলাম। দু’জনকেই। বুড়িকে ছাড়া বুড়ো থাকবে না। আবার… ছেড়ে দিলেও বাড়ি যাবে না। মস্তো মুশকিল। থা-ক! এইখানেই থাক। বাড়ি গিয়ে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার চাইতে এইটা তবুও ভালো। রুগীর হিসাবে জল মিশিয়ে, খাবারেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম দু’জনের চারবেলা। ভালোই করেছিলাম একদিক থেকে। বউটির প্রাণে বড় দয়া মায়া। পাশের বেডেই ছিল থমাস। থমাস মুন্ডা। একেবারে শয্যাশায়ী। লোকজনও কেউ নেই ওর নিজের বলতে। তো সেই থমাসেরও বড্ডো যত্ন আত্তি করে বউটি। জামা কাপড় পর্যন্ত কেচে দেয় নিজের হাতে করে। সবাই মিলে ভালোই আছে একরকম। সন্ধ্যেবেলা রামায়ণ দেখে শরিফুদ্দিনের মোবাইলে। হাসে। বকবকায়।
সেই থমাসই দেখি নেই। পাশের বেডটা ফাঁকা। বউটি বললো– “ওই পিছনদিকে গেছে। আজ বেড থেকে নাইম্যা হাঁটাহাঁটি শুরু করসে তো!”
অরবিন্দ বললো–” আইজ ভালো আছি বাবাঠাকুর। রাধামাধব ভালো রাখুন আপনারে। রা-ধা মাধব.. হরি হরি।”
আর হরি হরি ! ঝটিতি বাদবাকি রাউন্ড সেরে আর ফাইলে অ্যাডভাইজ লিখেটিখে পিছন দিকটাতে গেলাম দেখতে। থমাসের তত্ত্ব তালাশ করা উচিত একবার অন্তত। এতদিন বেড রিডেন ছিল। আজ, বেশি উৎসাহে যদি উল্টে পড়ে যায়! যাই…দেখি গিয়ে।
দেখলাম থমাস বসে আছে উবু হয়ে। মাংসহীন উরুদুটো যেন দুঃখী সরলরেখা। কুঁজো পিঠটার গেঞ্জি ফুঁড়ে বোঝা যাচ্ছে গাঁটে গাঁট মেরুদণ্ড। থমাস, ” আঃ আঃ” করতে করতে একটা পাটকিলে রঙের বেড়ালকে খাওয়াচ্ছে। সম্ভবত ওর ভাতেরই এঁটো কাঁটা। বেড়ালটা ছোট্ট গোলাপী জিভ বের করে চাটছে অল্প অল্প।
এগোলাম না। বেড়ালটা পালাবে। পা টিপে টিপে ফিরে এসে অরবিন্দর বউকে বলে গেলাম– খেয়াল রেখো। ওই পিছনেই আছে। বেড়াল খাওয়াচ্ছে বসে বসে। তারপর হাঁটা লাগালাম স্কুটির দিকে। চটচটে অপরাধবোধটা এবার জেঁকে বসেছে আরো। বিশ্বজিৎ বাবু, অরবিন্দের বউ, এমনকি থমাস পর্যন্ত…। অথচ থমাস নিজেই এতদিন পালিত ছিল বউটির। একটু বল ফিরে পেয়েই পালন করতে শুরু করেছে আরেকটা প্রাণকে।
নাঃ। ঠিক হলো না একদম। পাতা খেতো ছাগলগুলো নাহয়। পুরুন্তু কাঁঠাল পাতা। চুলা জ্বলতো গনগনিয়ে ঘরে। দুঃখী মানুষ সব। ভিজছিল বেচারি। চুল থেকে জল টপটপ …। নাহঃ। যাই, জনমেজয়কে খুঁজি গিয়ে। এই তো … ওই পিছনেই তো থাকে।
জনমেজয় দাঁড়িয়েই ছিল বাইরে। এঁটো হাত। হাঁক মারলো দূর থেকেই–“আপনি যান স্যার। আমি তালা মেরে দিচ্ছি হাত ধুয়েই।”
একটু ইতস্তত করলাম। এগোলাম বেশ কিছুটা। তারপর… কিন্তু কিন্তু করে মুখ খুললাম অপরাধীর মতো —“সে দিয়ো। কিন্তু… ঠিক হলো না বুঝলে! থাক। ওদের ডেকে তুমি নিয়ে যেতে বলো ডালপালাগুলোকে। লক ডাউনের বাজার…।”
জনমেজয় দাঁত বার করে হাসলো–“চিন্তা কইরেন না স্যার। নিয়ে গ্যাছে চ্যাংড়াগুলা। একটু বাদেই আসছিল চুপচুপ কইরে। লুকায়ে। আমি আর বলি নাই আপনাকে…।”
“শাল্লা!” এই এ-তক্ষণে হাসি ফুটলো আমার মনে অবশেষে। চটচটে ভাবটাও পুরোপুরি উধাও। “আসি হে” বলে আমি স্টার্ট দিলাম স্কুটিতে।
না। বিশ্বজিৎবাবুর ভবিষ্যৎবাণী মেলেনি। মেঘ বৃষ্টি সব কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে ঝকঝকে। পাতার রঙে, টাটকা কচি সবুজ।
আপনার লেখাগুলি মণের ভেতর কোথায় যেন ছুঁয়ে যা। ভালো থাকবেন আর আমাদের মণ কেমন করা লেখাগু৷ উপহার দিয়ে যান।
ভালো লেখা। ভালো মনের মানুষ না হলে এ লেখা হয় না। লিখবেন। আমি আপনার প্রায় নিয়মিত পাঠক।