প্রায় ৪০ বছর আগে আশির দশকের শুরুতে প্রশ্ন উঠেছিল–ওষুধের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য ওষুধ? অর্থাৎ ওষুধ কোম্পানির লাভের জন্য মানুষ ব্যবহৃত হবে নাকি মানুষের প্রয়োজনে ওষুধ উৎপাদিত হবে?
ওষুধ হল এমন ধরনের রাসায়নিক যার ব্যবহার রোগ সারাতে, রোগের কষ্ট কমাতে, রোগ নির্ণয় করতে, রোগ প্রতিরোধ করতে অথবা সুস্থ মানুষের কোন শারীরিক পরিবর্তন আনতে।
ওষুধ আবার পণ্যও বটে, ওষুধ কোম্পানি যার উৎপাদন করে লাভের জন্য। অন্য পণ্যের সঙ্গে ওষুধ এর পার্থক্য হল যে এর ক্ষেত্রে পণ্য পছন্দ ক্রেতা অর্থাৎ রোগী করেন না, পছন্দ করার দায়িত্ব ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে আরেকজনের, অর্থাৎ ডাক্তার। ডাক্তারই বলে দেন রোগী কোন ওষুধ খাবেন।
আমাদের দেশের ওষুধের বাজারে এক লাখেরও বেশি নামের ওষুধ পাওয়া যায়। দেশের অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকায় ওষুধের সংখ্যা কিন্তু ৩৭৬।
কেন এত ওষুধ? বাকি ওষুধগুলো কি প্রয়োজনীয় নয়? ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার বুঝতে গেলে আমাদের কতগুলো জিনিস বুঝতে হবে।
প্রথম বিষয়টা হলো কোন কোন অবস্থায় ওষুধ না হলেও চলে তা জানা। যেমন–
ক) কাশি হলে সিরাপ না খেয়ে গরম জলের ভাপ নেওয়া, তাতে কফ পাতলা হয়ে সহজে বেরিয়ে আসে।
খ) ডায়রিয়ায় প্যাকেটের ও আর এস না দিয়ে এক গ্লাস জলে কানায় কানায় ভর্তি দুই চায়ের চামচ চিনি, তিন আঙ্গুলের এক চিমটি নুন আর অর্ধেকটা লেবু দিয়ে ও আর এস বানানো।
গ) জ্বর কমাতে জল দিয়ে গা মোছা।
ঘ) কোষ্ঠবদ্ধতায় প্রথমে পায়খানা নরম করার ওষুধ না দিয়ে শাকসবজি খাওয়া আচালা আটার রুটি খাওয়া জল বেশি করে খাওয়া।
দ্বিতীয় বিষয় হল ওষুধের নাম।
ওষুধের তিনটে নাম। প্রথম নামটা রাসায়নিক নাম, যে নাম মনে রাখার দরকার ডাক্তারদেরও হয় না। দ্বিতীয় নাম জেনেরিক বা গোত্রীয় নাম, যে নামে কোন একটি ওষুধ সারা পৃথিবীতে পরিচিত। তৃতীয় নাম ব্র্যান্ড নাম বা বাজারী নামে। একই ওষুধকে বিভিন্ন কোম্পানি বাজারজাত করে বিভিন্ন নামে।
ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারে জেনেরিক নাম বা আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহার করা হয়। কারণ হলো–
ক) জেনেরিক ওষুধের দাম কম। ব্র্যান্ড নামের ওষুধকে পরিচিত করার জন্য মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ রাখা, বিজ্ঞাপন দেওয়া, ডাক্তারদের জন্য খরচ ইত্যাদি ব্রান্ড ওষুধের দাম এ ধরা থাকে। জেনেরিক ওষুধের সে বালাই নেই।
খ) ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তকে বা পত্রপত্রিকায় জেনেরিক নামই ব্যবহার করা হয়।
গ) পরে আলোচনায় দেখব ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রয়োজনীয়। জেনেরিক নাম ব্যবহারে মিশ্রণ ওষুধের ব্যবহার কমে।
ঘ) ব্র্যান্ড নামে বিভ্রান্তির সুযোগ অনেক তেমনটা জেনেরিক নামে নেই।
এমনই অনেক কারণ জেনেরিক নাম ব্যবহার এবং ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার না করার পক্ষে।
তৃতীয় বিষয়টা হল ওষুধের মিশ্রণ।
ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশন বা নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রণ ওষুধ সাধারণভাবে অযৌক্তিক, কেননা–
ক) এক্ষেত্রে একটা ওষুধের মাত্রা অপরিবর্তিত রেখে অন্যটার মাত্রা কমানো বাড়ানো যায় না।
খ) মিশ্রণের উপাদান ওষুধগুলো আলাদা আলাদা কিনলে যা দাম হয় সাধারণত মিশ্রণ ওষুধের দাম তার চেয়ে বেশি হয়।
গ) দেখা গেছে উপাদানগুলোর মোট পার্শ্ব চেয়ে মিশ্রণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়।
চতুর্থ বিষয় হল অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর এবং নিষিদ্ধ ওষুধ কোনগুলো তা জানা।
দেশে কোন কোন ওষুধ নিষিদ্ধ তা জানা যায় কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে। যদিও মনে রাখবেন নিষিদ্ধ হওয়ার বহু বছর পরেও নিষিদ্ধ ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়। নিষিদ্ধ করার পরেও অনেক সময় ওষুধ নিয়ন্ত্রককে পিছু হটতে হয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর সংস্থার চাপে, কখনো বা আদালতের রায়ে।
অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এর উদাহরণ হল সবকটি কাশির সিরাপ, এনজাইম প্রিপারেশন, অধিকাংশ হিমাটিনিক অর্থাৎ রক্ত তৈরির ওষুধ, টনিক।
এর পরের বিষয়টা হল মি টু ড্রাগ (Me too drugs)-গুলিকে চেনা। মি টু ড্রাগের বাংলা করা যায় আমিও ওষুধ। বহু প্রচলিত, পরিচিত, পরীক্ষিত কার্যকারিতার একটা ওষুধের গঠনে সামান্য পরিবর্তন এনে মি টু ড্রাগ তৈরি করা হয়।
একটা ওষুধ তৈরির পর নির্দিষ্ট একটা সময় অব্দি আবিষ্কারক ওষুধ কোম্পানি ইচ্ছামত দামে, ইচ্ছামত লাভ রেখে ওষুধটাকে বিক্রি করতে পারে। নির্দিষ্ট সময় অবধি পার হয়ে গেলে অন্যান্য কোম্পানিও সে ওষুধ টা তৈরি করতে পারে। তখন প্রতিযোগিতার জন্য ওষুধের দাম কমে, কোম্পানির লাভ কমে। নতুন ওষুধ তৈরি করলে আবার লাভ, তাই পুরনো ওষুধ থেকে মি টু ড্রাগ।
মি টু ড্রাগ নতুন ও দামি হলেও কার্যকরী বেশি এমনটা নয়।
বলা যেতে পারে ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের জন্য দেশের অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকায় সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। ওষুধ সম্বন্ধে কেবল ডাক্তার জানবেন এমনটাই নয় জানতে হবে রোগী বা সাধারণ মানুষকেও।
শেষে যেটা বলার তা হল যুক্তিসঙ্গত ওষুধও অযৌক্তিক ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবে রোগ নির্ণয়, তার জন্য ইতিহাস গ্রহণ এবং শারীরিক পরীক্ষা করা, ল্যাবরেটরি পরীক্ষা যুক্তিসঙ্গতভাবে করা এসবও প্রয়োজনীয়।
কিশোর বিজ্ঞান ও কুসংস্কার, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।