“এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি, / কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি।”
মানুষ কিছু স্মৃতি ভুলে যেতে চায়। একটা বড়ো ইরেজার দিয়ে মনে হয় ঘষে তুলে দিই মনের ভেতর ছায়া ফেলে রাখা কিছু অংশ। ভুলে যাই ভুল করে দিয়ে ফেলা কোনো কথা, যা আমাকে আজও কুরেকুরে খায়। ভুলে যাই ব্যর্থ কিছু কাজ, আনমনে অলস মুহূর্তে কাঁটার মতো যেগুলো খোঁচাতে থাকে হৃদয়কে। ভুলে যাই আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া কিছু জীবনকে। ইসস্, এটা যদি পেতাম, ওই ইনস্ট্রুমেন্টটা যদি থাকতো, আর কয়েক ঘন্টা যদি সময় পেতাম। যদির জাগলিং করতে করতে ভাবি যদি ঘটনাটাই না ঘটতো!
আমার একলা ছাদে, একলা আকাশের সাথে কথা হয়। তারার চুমকি বসানো শাড়ি, আর চাঁদের টিপ পরে একলা আকাশ আমার গল্পে কাঁদতে কাঁদতে ভোরের কাছে হারিয়ে যায়।
ভোরবেলা লাল চোখ নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ থেকে ঘরে ফিরে আসলে স্ত্রী জিজ্ঞেস করে -“আবার বায়ু চেগেছিল?” তার দৃঢ় বিশ্বাস কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতে পারলে আমাকে মোটে তিনি পাগলাগারদের বাইরে থাকতে অ্যালাও করতেননা।
আর ঘটনাটা বেশি দিনের পুরনো নয় যে তার ওপর বিস্মরণের ধুলো জমবে। বাচ্চাটার নাম ছিল আমিনা। আমিনার দাদুর আমি প্রস্টেট অপারেশন করেছিলাম। এক পিসির গলব্লাডার। ওর বাবা অ্যাপেন্ডিক্স বার্স্ট করে হাসপাতালে আমার আন্ডারে ভর্তি হয়েছিল। অপারেশনের পর প্রায় দশদিন ওখানেই ছিল সে। তখনও ওর বাবার বিয়েই হয়নি। সেইসব গল্প শুনতে শুনতে আমিনা বেড়ে উঠছিল। সেই গল্পের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে নিজস্ব গল্প তৈরি করেছিল ও। ও নাকি বাবার অপারেশনের সময় আমার পাশে ছিল। আমাকে অ্যাসিস্ট করেছিল। পিসির অপারেশনের ছুরিটা নাকি ওই চালিয়েছিলো। দাদুর ড্রেসিং নিয়মিত করতো কে? কেন, আমিনা ছিল না?
ফর্সা টুকটুকে মিষ্টি একটা মেয়ে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই কথা বলতো। ওদের পরিবারের সবাই আমার পেশেন্ট। চেম্বারে কেউ দেখাতে আসলে তার হাত ধরে আমিনা হাজির।
প্রতিবারে একই গল্প আমাকে শোনাতো। আমি ‘মনে পড়ছে না’ এমন একটা মুখ করে বলতাম- তুই? ও সুর করে টেনে টেনে বলতো- আমি, আমিনা।
ঘটনাটা ঘটেছিল রোজার মাসে। খুব গরম তখন। দায় না পড়লে মানুষ বাইরে বেরোচ্ছে না। তার ওপর কৃষ্ণনগরের ওপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা গেছে। সূর্যদেব অঞ্চলটার আশপাশ দিয়েই ঘোরাফেরা করছেন। সেদিন আমার অ্যাডমিশন ডে। অর্থাৎ যত মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা খুনখারাবি অ্যাক্সিডেন্ট পাল্টিখাওয়া রোগী আমার আন্ডারে ভর্তি হবে। ওই তীব্র গরমে পেশেন্টের চাপ একটু হালকাই ছিল। দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় আমিনার দাদু আমায় ফোন করে। আমিনা সাইকেল শিখতে গিয়ে পড়ে গেছে। বাচ্চারা তো কতই দুমদাম পড়ে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম -মাথায় লাগেনি তো?
নাহ্, মাথায় লাগেনি বা অজ্ঞান বমি খিঁচুনি কিছু হয়নি। আমি ফোনেই আশ্বস্ত করলাম। তাহলে কিছু হয়নি। এখনই ওকে কৃষ্ণনগর টেনে আনতে হবে না। ওর দাদুও একমত। তার ওপর বাড়ির সবাই রোজা রেখেছে। পরে একসময় চেম্বারে দেখিয়ে নেবে।
তখনও ইফতারের সময় হয়নি। আমিনার মায়ের ফোন -,”ডাক্তারবাবু, আমিনা কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে। আমার মন বলছে আপনাকে একবার দেখিয়ে নেওয়া ভালো।”
তবে আর কি? নাচতে নাচতে চলে এসো। অ্যাডমিশন ডে+র দিন এমনিতেই আমি চেনাজানা রোগীদের এড়িয়ে চলি। তাদের নজর দিতে গিয়ে সত্যিকারের সিরিয়াস পেশেন্টগুলো অবহেলার শিকার হয়। একটু বিরক্ত হয়ে সম্মতি জানাই।
আমিনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো সন্ধ্যা সাতটার সময়। বাঁদিকের পাঁজরের তলার দিকে একটু ছড়ে গেছে মাত্র। কিন্তু ওকে পরীক্ষা করে বুক শুকিয়ে গেল। পালসের ভল্যুম খুব কম, জিব শুকনো, স্বাভাবিকের থেকে বেশি সাদা লাগছে ওকে।
ভেতরের কোথা থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি হিমাক্সিল চালালাম। সন্ধ্যাবেলায় হাসপাতালের আলট্রাসোনোগ্রাফি বন্ধ। স্থানীয় একটা সেন্টারে অনুরোধ করলাম ছবিটা করে দেবার। বাড়ির লোক সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নিয়ে যায় আমিনাকে।
যা ভয় করেছিলাম তাই। আমিনার স্প্লিন ফেটে গেছে, এখনই অপারেশন করতে হবে। এই অপারেশন হাতে ব্লাড না রেখে করা খুব বিপজ্জনক। একটা ব্লাড রিকিউজিশন করে অ্যানাস্থেটিস্টকে ডেকে পাঠালাম। অ্যানাস্থেটিস্ট আমার সঙ্গে একমত। রক্ত চাই। রক্ত হাতে না নিয়ে এই রোগীর অপারেশন করলে মারা যাবে।
এদিকে দুঃসংবাদ। আমাদের ব্লাডব্যাংকে রক্ত নেই। বাড়ির লোককে বললাম -শীগগির রানাঘাট চলে যাও। আরও ঘন্টা খানেক। আমিনা দ্রুত নেতিয়ে পড়ছে। খবর এলো রানাঘাটেও ওই গ্রুপের ব্লাড নেই। ফোনেতেই চিৎকার করে আমিনার বাবাকে বলি যে একটা গাড়ি ভাড়া করে কলকাতা চলে যেতে। কতো নেতা-মন্ত্রী হেলিকপ্টার করে কয়েক মিনিটে হুশ করে শহর থেকে শহরে উড়ে যায়। বিনা কারণে। আমার আমিনার জন্য তোমরা কেউ কপ্টারটা দেবে গো? আমিনাদের জন্য কবে থেকে কপ্টার থাকবে? এক বোতল রক্ত হুশ করে উড়ে আসবে আকাশ পথে শক্তিনগর ওটিতে?
এর মধ্যে আমি আর আমার অ্যানাস্থেটিস্ট অদ্ভুত একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলি। যা হয় হোক, আমরা এই অবস্থাতেই অপারেশন করবো। আমিনার দেহ থেকে বেরনো রক্তই ওকে কোনভাবে চালাবো। আমিনার মা সম্মতি দেয়। চোখ বুজে। আমি আছি না! ম্যায় হুঁ না! আমার মধ্যে যে ওরা আল্লাহর আশীর্বাদ দেখে।
ওটিতে ঢোকার পর আমিনা চোখ বড়ো করে শ্বাস নিতে থাকে। অ্যানাস্থেটিস্ট মাথা নাড়ে। গ্যাস্প করছে, ইনটিউবেট করার জন্য দ্রুত হাতে মেশিনগুলো সেট করতে থাকে। হঠাৎ করে স্থির হয়ে যায় আমিনা। উপুড় হয়ে বুকে কান রাখি আমি।
সম্পাদক মহাশয়, আমাকে মৃত্যুর কাহিনী লিখতে বলবেন না প্লিজ, আমার যে চারদিকে চাপচাপ রক্ত। আমারই হৃদয় ছিঁড়ে ছড়িয়ে আছে।
আমিনাদের বাড়ির লোক আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখে না।
লাল, নীল, হলুদ, সবুজ যে পার্টিই ডাকুক না কেন- আমি রক্তদান শিবিরে হাজির হই। রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলি।
আর গভীর রাতে ক্ষত-বিক্ষত হই। একলা আকাশ আর একলা আমি মুখোমুখি বসে রাত জাগি। স্মৃতি মুছে দেবার কোনো ইরেজার যে নেই।
মর্মস্পর্শী লেখা!
♥️♥️♥️🙏🙏🙏
বাকরুদ্ধ আমি
🙏🙏🙏
বিয়োগান্তক ভালোবাসার কাহিনী
মনকে ভারাক্রান্ত করে দিলো
🙏🙏🙏💐💐💐
😞🙏