বাঁশবনে বৃষ্টির মতো হিন্দুয়ানির একটানা গোঁড়ামি আটকাতে বসে সেকালের ব্রাহ্মসংস্কারকরা যে নিজেদের তৈরি করা সংস্কার বাতিকে বেশি ডুবুডুবু হয়েছিলেন —এমনটাই দাবি ১৮৭০ এর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের| একদিকে ডিরোজিয়ানদের শেকড় খুলে আসা পশ্চিমপ্রেম আরেকদিকে ব্রাহ্মদের বিমূর্ত ঈশ্বর নিয়ে রাতদিন পিটপিট করতে লাগা –দুইয়ে মিলে বাঙালির বুদ্ধিচর্চা তখন জমাট ধোঁয়াশায়| ঠিক এইসময়টাতেই তরুণ ব্রাহ্ম সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্ম সম্পাদনা শুরু করলেন একটি শিশুপত্রিকা| নাম মুকুল|
অবাক হয়ে গেলাম| দেখলাম, শিশুদের জন্য লেখা বানাতে বসেও কোনোরকম নৈতিক শুদ্ধতার ধার ধারছেন না এই সংস্কারক| ব্রাহ্ম নীতিচর্চায় সেরফ তুড়ি মেরে মুকুলে শিবনাথ সাজালেন দুই একলা পাখির এক উচাটন মোহময়তার গপ্পো|
গপ্পোটা ছিলো এইরকম —পাখি দুটো বাস করতো একই খাঁচায়| কাল গেল| কালক্রমে কামাসক্ত হলো দুই বন্ধু পাখি| নিজেদেরকে বেশ ভালোরকম মজিয়ে নিলো ভালোবাসায়| এবার একটা মরে গেলো| খাঁচার মালিক দোসরা জুড়ি এনে দিতে চাইলে বেঁচে থাকা পাখিটির জন্য| বেঁচে থাকা পাখি সাথী বদলে নারাজ| ক্লান্তিতে যেন হাই তুলল সেটি| মালিকের পছন্দ করে আনা কনেপাখিকে refuse করে বেছে নিলো একটি চাকতি আয়না| মাগো মা! কী কাণ্ড কী কাণ্ড! এরপর থেকে পাখিটি রোজ আয়নায় নিজেকে দেখে| একদম ঘুরিয়েফিরিয়ে এপাশ ওপাশ থেকে দেখে নিজেকে| দেখে আর যখন ইচ্ছে তখন চুমু খেযে খেয়ে দেয় আয়নাটাকে| খেয়ে খেয়ে একশেষ করে চাকতি আয়না|
আজ একহাট গুরুজনদের সামনেও স্বীকার করতে কোনো লাজ নেই —- বারো তেরো বছর বয়সে নিঝুম দুপুরে গপ্পোটি পড়তে পড়তে শরীর বোঝার শুরু আমার| হা হা হা| শুরু করাটা করব না ভেবেও আটকাতে আর পারিনি|
প্রাণিতত্ত্ববিদ ডারউইন থেকে দার্শনিক উইল ডুরান্ট, কেই বা অস্বীকার করতে পেরেছেন জীবজগতের প্রচ্ছন্ন আত্মসৌন্দর্য্যবোধ ও আত্মপ্রেমের গোপন ইচ্ছেকে! উনিশ শতকের সম্পাদকটি বুঝি হাঁটতে চাইছিলেন আরো ক পা| শিশুকেও জাগাতে চাইছিলেন| জাগাতে চাইছিলেন শিশুর পালিশ না হওয়া কাঁচা কাঁচা বাসনাগুলোকে| বাসনার বিলাসকে| বিভ্রমকেও|
এর বহুদশক পর বিভূতির পথের পাঁচালী —অলিন্দ পেরিয়ে ছুটছে মুগ্ধ অপু আর সাথে সেই যে সেই ভীষণ সপ্রতিভ মেয়েটা —সেই লীলা —যে কেবল তার নতুন বন্ধুকে মোহে ফেলতে দৌড়ের হাঁফ ঝেড়েও ফেলেছে নিমেষে —তারপর একটার পর একটা খুলে ধরছে উপহার পাওয়া তার যাবতীয় বই| হতেও তো পারে নিজেও সে পড়ে গেছে সমান বন্ধুতায়| কিশোরী লীলার বইয়ের ঝুলিতে একখানি বাঁধানো মুকুলও যে রয়েছে দেখি! সম্পাদক শিবনাথ শাস্ত্রী|
কেন এ গল্প বললাম? অভিভাবকদের শিশুপাঠ্য নির্বাচনের সুবিধে করে দেয়ার জন্য| আপনার শিশু ক্রান্তিকালের শিশু| কোভিড নামক এক বিশ্বব্যাপী শোষকের সামনে সে| দূর থেকে দেখছেন অনলাইন পড়াশুনায় বেশ মজে আপনার শিশু| আসলে সে হয়ত খুঁজছে নতুন নতুন app| কখনো এক পুতুল দিয়ে আরেক পুতুলের হত্যার গেম –কখনো হয়ত পুতুল পুতুল ঠকর ঠকর sex গেম| যৌনাঙ্গের পর্দাও ফাটছে ফুটফুটে গ্রাফিক্সে| অতএব? বই পড়ান| ছেলেমানুষির বই নয় কেবল| স্বাভাবিক ও স্ফূর্ত জীবনবোধের বই| শিবনাথ শাস্ত্রী আপনার আমার চেয়ে বোধহয় শিশুর মনের ব্যাপারে বেশি বুঝতেন| তাই তাঁর শিশুপত্রিকায় দুই পাখির love গল্পের পাশাপাশি সাজিয়ে দিয়েছিলেন কাফ্রি দাসদের মুক্তিদাতা থিওডোর পার্কারের কথা অথবা সারা বিশ্ব জুড়ে তখন শুরু হয়ে যাওয়া শ্রমিকমুক্তি আন্দোলনের কথা|
আমার ইচ্ছে —আপনার পাখিছানা কথা কয়ে যাক বইয়ের সাথে –কথা লিখুক নতুন খাতায়| একদম ভর্তি করে| নতুন শব্দে
একদম তাই।সারাদিন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ওদের চোখ,মন,মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। বইয়ের মত বন্ধু পৃথিবীতে আর কি হতে পারে!খুবই যুক্তিপূর্ণ মত।