“রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা”…. কালজয়ী লাইন। কিন্তু ‘অন্তর’ মানে মন কোথায়? কোথাও যদি ঠিক করে না থাকে, তাহলে ব্যথা হবে কেমন করে? আর যদি ধরে নিই, মনের ঠাঁই মাথায়, তাহলে কি এটা আসলে ‘মাথার ব্যথা’?
প্রেম করেছেন? প্রেমে ঝাড় খেয়েছেন? উত্তর সব ‘হ্যাঁ’ হলে আপনি এই ‘অন্তরের ব্যথার’ ব্যাপারটা জানেন। ভালো করে জানেন। এই ব্যথাটা ঠিক হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, ‘গোটা অঙ্গে বোরোলিন’ মেখে নেওয়ার মতো ব্যথা নয়। এটা একটা প্রাণ হু হু করা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, চোখ জলে ভরে আসা, সবকিছু অর্থহীন ভেবে পৃথিবী ছেড়ে পালানোর ইচ্ছের ঝড় তুলে আনা ‘ব্যথা’…
ঠিক ব্যথা নয়, একধরনের কষ্ট, মন ভালো না লাগা যন্ত্রণা, বিষাদ, যা স্থায়ী হলে ডেকে আনতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার (অসুখ শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।), সেটা হচ্ছে ‘মানসিক অবসাদ’।
পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০-১২ শতাংশ এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে কি হবে?? সাময়িক অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশী!
নিজের আত্মীয় প্রিয়জনকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন বা গোর দিতে গেছেন কবরস্থানে, এমন মানুষের সংখ্যা, যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে কম নয়। আমি, এমনিতে অনেকবার গেছি, প্রথম বোধহয় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মরদেহ নিয়ে।
বছর দেড়েক আগে যখন নিজের মাকে নিয়ে গেলাম, দেহটি পরে আছে, বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অন্য মৃতদেহ, আমার সমস্ত সত্তা তখন এই বিমূর্ত বেদনায় খানখান হচ্ছিলো, মায়ের পাশে বসে। একটা কিরকম দলা পাকানো ভাব!!
আবার সেইদিন ইমার্জেন্সিতে একদল রাজনৈতিক মস্তান (স্বঘোষিত সমাজসেবী!!) মুখে কিঞ্চিৎ বিজাতীয়, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, ঠিক যেনো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে এসেছে, আমাকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে দিতে এসেছিলো। আমার ‘অমানবিক’ গালে, গলায় ক্ষুরের মতো হাত বুলিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিলো, ‘লাশ’ ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো, তখনও একটা অদ্ভুত নিস্ফল রাগ, এইরকম একটা অসার যন্ত্রণার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিলো মনের গভীরে। এরকম ‘বোধ’-এর স্বীকার আমরা প্রায়ই হই, প্রায় সকলেই, কোনো না কোনো সময়ে।
তারপর, এই সঙ্কট কখনো সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে ফেলতে পারে, সাময়িক ভাবে ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুচিন্তা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা। তাৎক্ষণিক আবেগে এই ধরনের ঘটনা বড় একটা কম ঘটেনা। আবার দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ থেকেও তা আসে। সব মিলিয়ে ‘আত্মহত্যা’ প্রায়শই ওই ‘অন্তরের ব্যথা’ রই একটা তীব্রতম রূপ যা একজন মানুষকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ থেকে আচমকাই সরিয়ে দিতে পারে।
যা হোক, কথা তো হচ্ছিলো ‘ব্যথা’ নিয়ে। আমাদের একটা শরীর আছে, ব্যথা, বিষ, যন্ত্রণা, তারও কিছু কম হয় না। হাতটা কেটে গেলো, পা টা গেলো মচকে, বদ হজম হলো, কিংবা প্রচন্ড জ্বর… শরীরের ‘ব্যথা’ তো নানাভাবে, নানারূপে আমাদের আক্রান্ত করে, করে চলেছে অহরহ। শিরশিরে ব্যথা, কনকনে বা দপদপানি ব্যথা, জ্বলে যাওয়া ব্যথা… অনেক রকম প্রকারভেদ। আসলে ‘ব্যথা’ হলো শরীরের কষ্টের প্রধানতম প্রকাশ, আর এইসব ব্যথার অনুভূতি গ্রাহ্য হওয়ার জন্য নানারকম স্নায়ু আছে যা মস্তিষ্ক অবধি নিয়ে যাবে, আবার অনুভূতি বহন করে আনবে ব্যথার জায়গায়।
এই শরীরের ব্যথা কম বা বেশী হতেই পারে। আবার, ব্যক্তিবিশেষেও কম, বা বেশী হয়!! একই রকম জোরে চিমটি কাটলে পাঁচজন লোক কি একই রকম ব্যথা পায় নাকি?? পায় না। এখানেই ঠিক ‘মনের’ একটা ভূমিকা আছে! সেটা হচ্ছে বেদনার বোধ!! শরীর বা মন, সব যন্ত্রণার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি… কারো কম হয়, কারো বেশী। এইভাবেই শরীর মিশে যায় মনে, শারীরিক যন্ত্রণার প্রকাশবোধের ফারাক, আর মানসিক যন্ত্রণার উৎপত্তির ভাবভঙ্গী, এইসবের মধ্যেই মানুষ হয়ে ওঠে ‘ব্যক্তি’, তার নিজস্ব ‘মানসিক পরিসর’ নিয়ে। মন হয়ে ওঠে শরীরেরই অংশ, সেটা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান দিয়ে নয়, সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, যতই মস্তিষ্ক-এর গভীরে অনেক রাসায়নিকের চলন থাকুক না কেনো!!
আগের দিন জার্সি গরুর দুঃখে ম্রিয়মান একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। উনি আসলে আমাকে অনেকদিন ধরে দেখান, আট বা নয় বছর বা বেশীও হতে পারেন। এখন অল্প ওষুধে দিব্যি ভালো আছেন। প্রথমে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে যখন ওনাকে দেখতে যাই, উনি নির্বিবাদে পাথরকুচি, ভাঙা কাঁচ ইত্যাদি চিবোচ্ছিলেন! মুখ কেটেকুটে রক্তারক্তি, ভ্রুক্ষেপই নেই!!
ওই যে বলছিলাম ‘ব্যথা’ পুরোপুরি শারীরিক নয়, মানসিকও নয়। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কিছু, ব্যক্তিনির্ভর, সবসময় গ্রাহ্য করার মতো নয়, আবার অগ্রাহ্যও করা যায় না।
এইসব নিয়ে আরো কিছু অন্য দিন।
আমি ২০১৫ সাল থেকে অবসাদে ভুগি। এখন ভিষণ নেতিবাচক হয়ে গেছি। তারমধ্যে যাকে দীর্ঘ দিন ভালোবাসতাম সে ও কিছু কাজের বন্ধু চূড়ান্ত বাজে ভাবে আমাকে আহত করে চলে গেছে। বর্তমানে বেঁচে আছি বাবা মা’র জন্য। কিন্তু বাঁচার মতো কোনো ইচ্ছা নেই। রাতে ঘুম হয়না। ওষুধ খাই। খুব ই খারাপ দিন কাটাচ্ছি। আমার বয়স ৩০.
ওষুধ খেয়ে যেতে হবে, কিন্তু তাতে অসুবিধা না কমলে, যিনি চিকিৎসা করছেন, তার কাছে আবারো গিয়ে নিজের সমস্যা বলতে হবে।
আর একটা সম্পর্কের ভাঙ্গা গড়াই জীবনের সবকিছু নির্ধারণ করে দেয় না। এখনো নতুনভাবে বাঁচার অনেক সুযোগ আছে।
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা । ভালো লাগলো ।
সকলের লেখাই পড়ুন।
নিজে একাধিক সময়ে অবসাদে ভুগেছি বলেই বলতে পারি, অন্তর থেকে সুস্থ জীবনে ফেরার তাগিদ ও শক্তি অর্জন করতে না পারলে কোন ওষুধ, ডাক্তার বা
অন্য কোন পন্থাই কার্যকরী রূপ ধারণ করতে পারেনা।
ঠিকই। মনের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত শক্তির সন্ধান খুঁজে পাওয়াটাই আসল ব্যাপার। চিকিৎসকেরা এই কাজে সাহায্য করেন মাত্র।
মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্য মেডিটেশন কতটা কার্যকারী?
যথেষ্টই কার্যকরী।
হ্যাঁ। চিন্তার ক্ষেত্রে “পজিটিভ” জায়গাটা খুঁজে বের করে পারলেই অনেকটা অবসাদ কমে। ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন।