লোকটা বড্ড ভয় পেয়ে গেলো । অমন মুশকো, লম্বা চওড়া লোকটা… এই একটু আগেই যে বললো ‘ ও এট্টু আধটু মদ না খেলে আবার পুরুষ মানুষ নাকি!’ , গলায় সোনার চেন,হাতে বালা…এই মিনিট খানেক আগেও যে বলছিল ‘ওসব সুগার ফুগার আছে বলে মিষ্টি খাবো না, এরকম ভীতু লোক আমি না’, আর তারপর হো হো করে হাসছিল। সেই লোকটাই আমার কথাটা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো ।
একটা ছোট্ট ঘা! প্রথম লোকটা দেখেছিল মদ খেয়ে এসে বউকে লাথি মারবার সময়ে। ডান পায়ের তলায়। কবে, কখন যে হয়েছে খেয়ালই করেনি। স্থানীয় ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল পরদিন সকালে। ডাক্তারবাবু সুগার টেস্ট করতে দিয়েছিলেন। আর ,তাতেই লোকটা জানতে পারে, ওর হাই সুগার। জীবনে প্রথম সুগার পরীক্ষা হয় পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে। ধরা পড়ে, রক্তে মাত্রাতিরিক্ত শর্করা। এর আগে আর কোনও উপসর্গ ছিল না লোকটার! নাকি জানার চেষ্টাও করেনি?
প্রথমে বিশ্বাসই করেনি আপাত ডাকাবুকো লোকটা। অগত্যা আবার সুগার পরীক্ষা করিয়েছিল। আর, তাতেও যখন ধরা পড়ল সত্যিই ওর রক্তে মিশে আছে অনেক বেশি মাত্রায় সুগার, লোকটা ভাবল এবার তবে সত্যিই সুগার টুগার হয়েছে হয়তো।
তা হোক। আছে তো ডাক্তার। লোকটা ডাক্তার দেখালো, ওষুধপত্র কিনল। ডাক্তারবাবুর ডায়েট আর শরীরচর্চার উপদেশ এক কান দিয়ে শুনল আর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিল। ওষুধ খেত মাঝে মধ্যে আর আকন্ঠ মদ গিলে বাড়ি ফিরত।
“তোমার এত্ত সুগার। ডাক্তারবাবু বারবার বলেছেন এসব না খেতে…” বউয়ের এই কথা গ্রাহ্যই করেনি লোকটা।
“ওষুধ তো খাচ্ছিই। এত টাকার ওষুধ খাচ্ছি কেন তবে?”
” সেটাও তো রোজ খাও না নিয়ম করে।” বউ অনুযোগ করল।
“থামো তো।” বিছানায় শুয়ে পড়ে লোকটা।
স্ত্রী থেমে যায়। লোকটার হম্বিতম্বি থেমে যায়। কেবল অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠে সুগারের মাত্রা। ডায়াবেটিস থাবা বসাতে থাকে চুপিসারে । লোকটা জানতেই পারে না। ভাবতেও পারে না তার মতো বীর পালোয়ানের শরীরকেও জব্দ করতে পারে সুগার!
পায়ের ঘা কিন্তু আবার মাথা চাড়া দেয়। এইবার আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে ঘা। আবার ডাক্তার। আবার ওষুধ। আবার আপাত, ক্ষণস্থায়ী নিরাময়। তারপর যেই কে সেই…
লোকটা ভুলে যায়, ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রথম পদক্ষেপ হলো নিয়মানুবর্তিতা । সময় মতো নিয়ম করে ওষুধ খাওয়া, সঠিক পথ্য, শরীরের কসরত, চিকিৎসকের পরামর্শ – এগুলোর বহুমুখী আক্রমণের দ্বারাই ডায়াবেটিসকে বাগে আনতে হবে। নিয়মভঙ্গের মাশুল না হলে দিতে হবে শরীর দিয়ে। কারও চোখ, কারও কিডনি, কারও নার্ভ, কারও যৌনাঙ্গ, কারও হার্ট, কারও বা ব্রেন এই রোগের শিকার হবে।
এই লোকটার যেমন পায়ের ঘা। একটা সারছে, আরেকটা হচ্ছে। কখনও একসঙ্গে অনেকগুলো ঘা। দুইপায়ে একসাথে। একটা না সারতেই আরেকটা উপস্থিত । পা ফেটে যাচ্ছে। পচে যাচ্ছে পায়ের চামড়া । ডায়াবেটিক আলসার।
কথাটা বুঝিয়ে বলতেই লোকটা ভয় পেয়ে গেলো ।
“এটা কী বলছেন স্যার?”
“ঠিকই বলছি। ডায়াবেটিস রুগীদের একটা বড় অংশের পায়ের নানা জায়গায় ঘা হয়, চামড়া পচে যায়। মাত্রাতিরিক্ত সুগার আর পায়ের অযত্ন এই দুয়ের সহাবস্থানই যথেষ্ট। আর আপনার তো সেটাই হয়েছে। এরপর পা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বহু মানুষের পা বাদ দিতে হয়। আমারই অনেক পেশেন্টের হয়েছে।” আমি জোর দিয়ে বললাম। লোকটা কোনও উপদেশ শোনে না, যথেচ্ছভাবে জীবন কাটায় আর তাতে করেই ডায়াবেটিস ওর পায়ে থাবা বসিয়েছে। সমস্যা গুরুতর । ডায়াবেটিস থেকে নার্ভের সমস্যা , তার সঙ্গে পায়ের অযত্ন , ধূমপান, মদ্যপান সবকিছুই লোকটার পা দুটোকে খেয়ে ফেলছে ক্রমেই।
“পা বাদ চলে গেলে তো আমি বাঁচবই না স্যার।” এই প্রথম লোকটার গলায় ভয় শুনতে পেলাম। মদ আর মিষ্টি না খেয়ে যে থাকতেই পারে না, সেই লোকটাই হঠাৎ বলে উঠল, ” আর মদ ছোঁব না স্যার। কথা দিচ্ছি। নিয়মিত ওষুধ খাব। আমার পা বাঁচান স্যার। ”
“ভয় পেয়ে গেলেন, তাই তো? এই ভয়টা একটু আগে পেলে ভাল হতো। মরণ কালে হরির নাম করছেন। ডায়াবেটিক ফুট মানে পা জুড়ে ডায়াবেটিস জনিত ঘা, পায়ের নানা অংশ পচে যাওয়া, পুঁজ জমা, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, এমনকী পায়ের হাড়ে পর্যন্ত ইনফেকশন ছড়িয়ে যেতে পারে। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রাণ বাঁচাতে পা বাদ দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।”
” এখন?” লোকটা কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করল।
” এখন থেকে প্রতিজ্ঞা করুন যা বলব শুনে চলবেন। পায়ের যত্ন নিন। ঘায়ের দুবেলা ড্রেসিং প্রয়োজন । সুগার একদম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সারবে ঘা , আস্তে আস্তে সারবে। কিন্তু, কথা না শুনলে আবার হবে।” প্রেস্ক্রিপশন করতে শুরু করলাম।
” পায়ের যত্ন বলতে স্যার?” লোকটা যেন বাধ্য ছাত্রের মতো হয়ে গেছে।
” পায়ের পাতা, আঙুলের ফাঁকে লক্ষ্য রাখবেন কোনও কাটা, ছেঁড়া আছে নাকি। রোজ গরম জল দিয়ে পা পরিষ্কার করবেন। পায়ে ময়শ্চারাইজার লাগাবেন। নখ কাটবেন নিয়মিত । দরকারে পায়ে ওষুধ লাগাবেন । মোজা পড়বেন। পায়ের সঙ্গে মানানসই জুতো পড়বেন যাতে পায়ে ঠিক মতো আঁটে। একবার হলে এই ডায়াবেটিক আলসার কিন্তু বারংবার হয়। এই কথাগুলো মনে রাখবেন, মেনে চলবেন । আর, অন্য কোনও চেনা পরিচিত ডায়াবেটিস রোগীকেও বলবেন। তবে, সবথেকে বেশি দরকার রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের মধ্যে রাখা। মনে থাকবে?” হাসলাম লোকটার দিকে তাকিয়ে। সত্যিই তাই। ডায়াবেটিক ফুট, ডায়াবেটিক আলসার ডায়াবেটিস পেশেন্টদের জন্য একটা বিপজ্জনক ও বিরক্তিকর উপসর্গ। অথচ, কিডনি, হার্ট বা চোখের যত্ন নিতে গিয়ে এই দিকটা যেন মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। রোগীদের তো বটেই , অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারদেরও। রোগীদের অজ্ঞানতা, অসচেতনতা ওদের ঠেলে দেয় ডায়াবেটিক আলসারের দিকে। যার ফলশ্রুতি অনেক ক্ষেত্রেই অঙ্গহানি! এমনকী মৃত্যুও আশ্চর্য নয়!
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। আমার সাম্মানিক দিয়ে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। মনে হলো ওর যেন সম্বিত ফিরেছে। ফিরলেই ভাল। এভাবেই যদি জনসচেতনতা বেড়ে যায় খারাপ কী!
অপূর্ব একটি উপকারি পেজ।
খুব উপকৃত হচ্ছি প্রতি নিয়ত
ধন্যবাদ আপনাদের
অয়ন জোয়ারদার
খুব ভালো
?
১. নিয়মভঙ্গের মাশুল না হলে দিতে হবে শরীর দিয়ে। কারও চোখ, কারও কিডনি, কারও নার্ভ, কারও যৌনাঙ্গ, কারও হার্ট, কারও বা ব্রেন এই রোগের শিকার হবে।
প্রশ্ন: ওপরের সবকটি বা একাধিক কি একসঙ্গে হতে পারে ?
২.ধূমপান বাদ, কিন্তু মদ্যপান কি একদম বাদ ? নাকি পরিমিত মদ্যপান ( ৯০ মিলি/ দিন) চলে … যদি ওষুধ, ঠিক খাবার, ব্রিসক্ ওয়াকিং মানা হয়?
উপকৃত হলাম। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাদের
উপকৃত হলাম খুব আবার ভয়ও পেলাম কিছুটা। ওষুধ খেলেও নিয়ম করে শরীর চর্চা করা হয়ে ওঠে না। আর মিষ্টির প্রতি লোভটাও তো ছাড়তে পারিনি পুরোপুরি!