-“ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। বছরে এই দুটো ঈদের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি। হায় আল্লা এমন ঈদ আসবে কে জানত?”
-“কেন আম্মি? জামাকাপড় কিনবে না?”
– “বড়সড় খরচা রে সোনা।”
– “তা হোক, চলো না আম্মি। এবছর ইফতারে শুধু মুড়ি, বেগুনি। ভাল্লাগেনা!”
– “বুশরা, আমার মোটে কটা টাকা। তোর জন্য শুধু একটা ফ্রক হবে।”
– “লেসের কাজ করা, কেমন? সাদা নেটের ফ্রিল।”
– “অতো দাম দিয়ে কিনতে পারব না মামণি। শিমূলের জন্মদিন ঈদের পবিত্র দিনে। ভুলে গেলি?”
– “তাহলে ভাইজানের জামা আগে কেনো আম্মি। আমাকে চুড়ি দিলেই হবে।”
মায়ের চোখে জল দেখে নিউটন চুপ করে গেল। আজ পঁচিশ তারিখ। মে মাসের এই বিশেষ দিনটাতে আর কিছু না হোক মা একবাটি পায়েস রান্না করবেই। নিউটনের নাম ওর বাবা রেখেছিলেন শিমূল। বাড়ি ঘিরে টকটকে লাল শিমূল ফুলের গাছ। শিমূল সালাউদ্দিন নামটার ‘নিউটন’ হওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিল।
আব্বা মারা যাওয়ার পর স্কুলছুট হতেই হয়েছিল শিমূলকে। আম্মির সঙ্গে রোজ দোকানে বসতে হত। পেঁয়াজি, বেগুনি, মোচার চপ, আলুর চপ, আর চা। একহাতে সামাল দিতে পারত না মা। একপ্রস্থ বিক্রি হত সকালে। কচুরি ভাজত মা। আর শালপাতার প্লেটে একহাতা করে আলুর তরকারি দিয়ে চারটে কচুরি সাজিয়ে দিত সে খরিদ্দারদের। প্রতি প্লেট দশ টাকা। বড় উনুনে চা বানাত মা। কেটলি থেকে ঢেলে দিত খুরিতে। শিমূলের কাজ ছিল খুরিগুলো থালায় বসিয়ে হাতে হাতে দেওয়া। বেঞ্চ তো মোটে একটা। টেনেটুনে তিনজন বসতে পারে।
বোন স্কুলে যেত। মিড ডে মিলের আশায়। শিমূলের আর স্কুল যাওয়া হল না। কম্পিউটার চালাতে এত ভাল লাগত অথচ কথাটা বলাও হল না আম্মিকে। সে না দেখলে কে দেখবে তার মাকে! যখন উনুনের তাতে ঘন্টার পর ঘন্টা চপ ভাজতে ভাজতে মায়ের মুখ লাল হয়ে যায়, ইচ্ছে হয়, পুকুরের পানি নিয়ে আঁজলা করে মায়ের মুখটা ভিজিয়ে দিতে। মা তার পৃথিবী। আব্বা তো চলেই গেলেন। দোকানদারি করলেও শিমূলকে নিয়ে বড় স্বপ্ন ছিল তাঁর।
ছেলের যে কম্পিউটার সায়েন্স ভাল লাগে জানতেন আব্বা। তিল তিল করে জমাচ্ছিলেন। পাঁচ হাজার হয়েছিল। সব চলে গেল আব্বার দাফনে। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায়। নিউটন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারো বছর বয়সে যে ছেলের বাবা মারা যায়, তার ভাগ্যে লড়াই আর লড়াই।
দুপুরবেলাটা সে আর বাড়ি যায়না। আবির চাচাদের বাগান, ক্ষেত পাহারা দেয়। আবির আলি ফিরোজ হলেন মুর্শিদাবাদের বিরাট আমবাগানের মালিক। যেমন মিষ্টি আম, তেমনি সুস্বাদু।
কোহিতুর, গোলাপখাস, বেগমবাহার, বিরা, নবাব পসন্দ, রানি, চম্পা, চন্দনকোষা, ল্যাংড়া, হিমসাগর, মির্জা পসন্দ প্রায় একশো ত্রিশ প্রজাতির আম। পাহারাদার আছে প্রায় কুড়ি জন। শিমূলের বাবা মারা যাওয়ার পর আবির চাচা বাগানের পুবদিকটা পাহারার কাজে লাগিয়েছিলেন শিমুলকে। দুপুরবেলা একথালা ঝরঝরে সাদা ভাত, ঘন মসুর ডাল আর তিন চার রকমের তরকারি পাঠাতেন চাচি। অমন সুস্বাদু ব্যঞ্জন তাদের বাড়িতে হয়না। বাপমরা ছেলের জন্য চাচির হয়তো করুণা হত। সেরকমই একদিন বসে ছিল এক আম গাছের তলায়। মাথার উপর এসে পড়ল একটা কোহিতুর আম।
প্রচন্ড নরম এই আম। রাজা বাদশার খাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ফলন খুব কম। পাড়াও মুশকিল। এমন তুলতুলে যে অতি সামান্য চাপেও ফেটে যেতে পারে। শিমূল গল্প শুনেছে এই আম নাকি মসলিনে জড়িয়ে রাখতে হত নবাবদের জন্য আর পাড়ার এক ঘন্টার মধ্যেই খেয়ে ফেলতে হত।
অবাক কান্ড! আমটা পড়বি তো পড় শিমূলের মাথায় এবং একফোঁটাও বিকৃত হলনা। শিমূল সেই আম হাতের তেলোতে সাবধানে বসিয়ে ছুটল আবির চাচার কাছে। মাথায় আপেল পড়েনি বটে, কিন্তু অত্যাশ্চর্য এই ঘটনার জন্য সেদিন থেকে তার নাম হয়ে গেল নিউটন।
আবির চাচা তার উপর এতোটাই খুশি হল যে বাড়ির লাইব্রেরির বই পড়তে দিয়ে দিল শিমূলকে। শিমূলই প্রস্তাবটা দিয়েছিল। একে স্কুলছুট। তায় লকডাউন। বাইরের জগত বলতে আমবাগান আর খরিদ্দারেরা। মনের খোরাক পাবে কোথায়? বোন তো বাড়িতে বসে থাকে আজকাল। টুকটাক ঘরকন্নার কাজ করে। দাদা আর মা রোজ রাতে দোকান বন্ধ করে ফিরে এলে একসঙ্গে গল্প হয়। রোযা রেখেছে মা আর বোন। নিউটন ওদেরকে রোজকার পড়া গল্প ভাল করে বলে।
শিমূল পড়েছে , নিউটনেরও লেখাপড়া শুরু করতে একটু দেরি হয়েছিল। দিদিমার কাছে উলসথ্রপে মানুষ হচ্ছিলেন নিউটন , কারণ তার বাবা মারা যাওয়ার পর মা আবার বিয়ে করেছিলেন। নিউটনকেও ক্ষেতখামারের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর মা। তবে কিছুদিন পর নিজের মেধার জোরে স্কুলে গেছিলেন নিউটন। আর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছিলেন।
শিমূল জানে, ওর হয়তো আর স্কুল যাওয়া হবে না। আমবাগান পাহারা দেওয়ার টাকা সংসারের খরচে লাগে। চুপ করে বই পড়ে সে। একদিন সাহস করে বলেই ফেলল, “আপনার ইয়া বড় স্মার্টফোনটা ব্যবহার করতে দেবেন চাচা ? ওটা দিয়ে তো ফোন করেন না। ”
আবির আলি নিউটনকে স্নেহের চোখে দেখেন। প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,”হ্যাঁ,ফোন করি ছোট মোবাইল থেকে। বড়টা তো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। আমরা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানি না। তুই চালা। জিনিসটা ভালও থাকবে।”
সেই থেকে শুরু নিউটনের স্মার্টফোন ঘাঁটাঘাঁটি। আবির আলি মাঝেমধ্যে দেখেন বিকেলেও ছেলেটা ঠায় বসে চোখ রেখেছে স্ক্রিনে। কী সব টেপাটেপি করছে।
বছরটা বড্ড মন্দ যাচ্ছে এবার। বিশে বিষ। শুরু থেকে রোগ ব্যাধি। আল্লাহ্তালা রুষ্ট প্রকৃতির প্রতি মানুষের ব্যাভিচারে। কত লোক যে জ্বরে ভুগছে। ফল ফুলুরিও ভাল হয়নি। মধুপোকায় আমবাগানের প্রচুর গাছে আম ধরেনি। গুটি অবস্থাতেই পড়ে গেছে। যাও বা ছিল, ঝড়ে ঝরে একেবারে লন্ডভন্ড বাগান। আবির আলির মাথায় হাত। ঈদের আগে এ কী ক্ষতি! এখন কীভাবে সে বিক্রি করবে এই আম। নেবে কীভাবে? লরি চলাচল বন্ধ ।লকডাউন ওঠেনি সর্বত্র। এতগুলো লোকের মাইনে তো দিতে হবে! ঈদ বলে কথা।
পঞ্চায়েতের মোড়ল এসে বলল, -“এবারে কোনও আশা নেই। আম সব বিলিয়ে দেওয়া হোক।”
-“তাহলে এক টাকাও তো আমার ঘরে ঢুকবে না? বিরাট লোকসান। চালাব কীভাবে?”
নিউটন চুপ করে দেখছিল সব। সকাল হয়েছে সবে। আজ মায়ের সঙ্গে দোকানে যাওয়া হবে না। সোজা চেয়ে নিল আবির আলির স্মার্টফোন। ঘুটঘাট করল বেশ কিছুক্ষণ। ঘন্টা তিনেক পর থেকে আবির আলির মোবাইলে পরপর ফোন আসতে লাগল। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সার সার গাড়ি এসে দাঁড়ালো তাদের গ্রামে। টেম্পো, ছোট হাতি, মায় প্রাইভেট গাড়ি, বাইক, এমনকি অটো। সবাই আম কিনতে এসেছে।
রাতভোর হাত লাগাল বাগানের কর্মচারীরা। ঈদের সকালে আবির আলির ঝুলি ভরে উঠল কড়কড়ে নোটে।
-“হ্যাঁ রে, নিউটন, কী যাদু করলি বাপ?”
শিমূল আনন্দে ডগমগ। মিষ্টি হাসল। -“দেড় বছর ধরে আপনার স্মার্টফোনে একটা অ্যাপ বানিয়ে রেখেছিলাম চাচা।”
-“অ্যাপ মানে আপেল?”
নিউটন হেসে ফেলল। -“গুগল ঘেঁটে শিখে নিয়ে এই অ্যাপটা আমি নিজে ডিজাইন করে বানিয়ে রেখেছিলাম বিক্রিবাটার জন্য। বেশ ক’বার মায়ের তৈরি শিমাইয়ের পায়েস বিক্রি করব ভেবেছি। কিন্তু আমার টিম কোথায় চাচা? টাকা কই? লোক লাগবে তো!”
গ্রামশুদ্ধ লোক হাঁ করে তাকিয়ে নিউটনের দিকে।
-“তোমার নামে একটা মেল আইডি খুলে ফেলেছিলাম চাচা। তারপর এই অ্যাপ দিয়ে গ্রামের আশেপাশে বহরমপুর টাউনে একটা ট্রাই করলাম ।
-“তারপর?”
-“লেগে গেল। ঈদের সময় ফল কে না চায়! পাকা আম, কাঁচা আম সবকিছুর ডিম্যান্ড। খরিদ্দাররা ফোন নম্বর চাইল। আমি তোমারটা দিয়ে দিলাম।”
-“তোর মাথায় কী আছে নিউটন? ধার দিবি?”
শিমূল হেসে বলল,”এটা কিছুই না। স্কুল যেতে পারলে স্যারের থেকে আরও কতো প্রোগ্রামিং শিখতে পারতাম। তবে লকডাউন নিউটনের সময়ও হয়েছিল।”
বুশরা উত্তেজিত হয়ে বলল,”হ্যাঁ, তুই তো বলেছিলি। তখন প্লেগ মহামারী।”
শিমূল হেসে বলল, “বিউবোনিক প্লেগের জন্য কেমব্রিজ ছুটি হয়ে গেছিল। লকডাউনে নিউটন ফিরে এসেছিলেন দিদিমার গ্রামের বাড়ি, উলসথ্রপে।”
শিমূল দেখল মায়ের চোখ বড় বড়। -“ঐ সময় উনি বিখ্যাত দুটো আবিষ্কার করেছিলেন। বাইনোমিয়াল থিওরেম আর ক্যালকুলাস।”
আবির আলি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। -” বলিস কী? তুই এত কিছু জানিস? লকডাউন উঠলেই তোকে আমি শহরের স্কুলে পাঠাব।”
শিমূল ফাজিল হেসে বলল, “আসলে লকডাউনের সময় স্যার নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল বলেই বোধহয়, ঠিক যেমন আমার। আম পড়েছিল।”
শিমূল দেখল মায়ের চোখ থেকে জল পড়ছে। কিন্তু মুখে হাসি। -“জন্মদিন মুবারক বেটা।”
-“দাদা, পঁচিশে মে তোর জন্মদিন, কবি নজরুলের জন্মদিন আর পঁচিশে ডিসেম্বর আইজাক নিউটনের জন্মদিন, যিশুখ্রিষ্টরও।”
-“কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ভুলে গেলি? পঁচিশে বৈশাখ? আসলে পঁচিশ তারিখটাই মহামানবদের। রাসবিহারী বসুর জন্মদিনও আজ।” মিচকি হাসল শিমূল ।
-“দেখাচ্ছি তোর মজা রে ভাইজান।” বুশরা ছুটে গেল শিমূলের দিকে।
‘ঈদ মোবারক নিউটন’ বলতে বলতে একে একে সবাই আদর করতে এগিয়ে এল শিমূলকে।