গত কয়েক বছর ধরে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ বার বার সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলির কাছে একটাই আবেদন করে এসেছেন- সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করুন ও স্বাস্থ্য বাজেট বাড়িয়ে জিডিপির 2.5% করুন। কোভিড হানায় বিপর্যস্ত মানুষ যখন দিশেহারা তখন সরকারী হাসপাতাল গুলিই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি পুঁজি তাদের বহুমূল্য হাসপাতালগুলি পুরোপুরি বন্ধ রেখেছিলেন। এখন যখন খুলেছে, তখন তারা ঘোষিত ভাবে বেড ভাড়া ও চিকিৎসা পরিষেবা বাবদ দৈনিক খরচ ধরেছে 25000 থেকে 75000 টাকা। এই খরচ ছাড়া আরো খরচ হবে যদি রোগীর ভেন্টিলেটর দরকার হয়।
স্পষ্টতই এই উচ্চ মূল্য দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে পারার জন্য যে অর্থ শক্তি দরকার এই দেশের বেশিরভাগ মানুষের তা নেই। যে মানুষ ট্রেনের পরিষেবা বা ধরা যাক ব্যাঙ্কের পরিষেবা খারাপ বলে তার বেসরকারিকরণ চান তিনিও এত টাকা খরচ করে পরিষেবা কিনতে চাইবেন না। সরকারী পরিষেবার মান আশানুরূপ নয় বলে আমরা অভিযোগ করি কিন্তু নিজেরাই যখন কোন সরকারী পদ লাভ করি তখন তার অপব্যবহার করি। ক্ষমতা অনুসারে সেই অপব্যবহার বদলে যায়। যিনি ছেলেমেয়ের জন্য পেনসিল বা এক দিস্তে কাগজ বাড়ী নিয়ে যান ও সেটাকে অন্যায় ভাবেন না তিনি সুযোগ পেলে ট্রেন বিক্রি করে দেবেন, এর মধ্যে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। দুধে জল মেশানো যার অভ্যাস সে একসময় ভুলে যাবে জল বিক্রি করছে না দুধ বিক্রি করছে।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে খারাপ পরিষেবার বড় কারণগুলো হল- চিকিৎসকের আনুপাতিক হার কম, শয্যা সংখ্যা কম, পরিকাঠামো মান্ধাতার আমলের ও সুষ্ঠু পরিচালন নীতির অভাব। তার সাথে যুক্ত হয় কোন কাজ অগ্রাধিকার পাবে তা নিয়ে একটি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট নীতির অভাব।
যখন বেসরকারি হাসপাতাল দাম বাড়ায় তখন সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকার বলছেন যে লাগামছাড়া ব্যয় যাতে না হয় তার জন্য শয্যা প্রতি প্রতিদিন খরচ এক হাজার টাকা হবে। এই নিদান যারা দিচ্ছেন বেসরকারি পরিষেবার খরচ নিয়ে কোন তাদের কোন ধারনা নেই। বেসরকারি হাসপাতাল যে পুঁজি ঢেলেছে তার ব্যয় সব সময় পরিষেবা খরচের সাথে যুক্ত থাকে। তার সাথে থাকে পরিচালনার দৈনন্দিন খরচ। সরকার যদি বলে এক হাজারের বেশি নিতে পারবে না তাহলে কোন একদিন তারা পরিষেবা বন্ধ করে যেখানে উচ্চ হারে লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থা করবে।
সরকারের অন্য প্রতিক্রিয়া একই রকম বাস্তব বর্জিত। তারা বলেন ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা হবে। ধরা যাক এদেশের পঞ্চাশ কোটি মানুষের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা করে ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করা হল। এই টাকা পাওয়ার জন্য সরকার বাৎসরিক যে প্রিমিয়াম দেবে তা পাবে কোন প্রাইভেট কোম্পানি। যেহেতু এই 50 কোটি মানুষের মাত্র 2.5% হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা তাই প্রায় 48.75 কোটি মানুষের ভর্তি হবার সম্ভাবনা নেই। অথচ, তাদের প্রিমিয়াম যথারীতি সরকার দেবে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বেসরকারি হাতে চলে যাবে। যারা স্বাস্থ্য অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন তারা দেখিয়েছেন যে কিভাবে এইভাবে হাজার হাজার কোটির সরকারী অর্থ হাত বদল হয়ে বেসরকারি কোম্পানির কাছে চলে যায়।
এমন নয় যে 48.75 কোটি মানুষের কোন অসুখ করবে না। তারা বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, পেট থেকে হার্টের ব্যামোও হতে পারে। কিন্তু তাদের, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। এখন দেশে যে সব রোগব্যাধিতে মানুষ ভোগেন সেগুলি হল জীবনশৈলী ঘটিত অসুখ- সারা জীবন ধরে এগুলি বয়ে বেড়াতে হয়। যেমন, ডায়াবেটিস, প্রেসারের অসুখ, হাঁপানি, বাত, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, নানা ধরনের অসুখে ভুগে হাসপাতালে ভর্তি না হলেও সারা বছরের চিকিৎসা খরচের প্রায় 70% এতেই খরচ হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হলেও রোগীকে তার পকেট থেকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। তার পরিমান ও প্রতি 100 টাকায় 70 টাকা রোগীর নিজের।
স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর একটা তফাত আছে। দেশের সরকার একটা চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরী করেছে- তা দুর্বল, সমস্যাদীর্ণ, ভুলে ভরা, নির্মম ও আমলাতান্ত্রিক। তবু একটা পরিকাঠামো আছে। আমাদের দরকার যা তার তুলনায় সেই পরিকাঠামো অত্যন্ত অপ্রতুল। কিন্তু, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরো দুর্বল। চিকিৎসক যাকে বলেন প্রতিরোধ মূলক ও নিরোগ রাখার জন্য নানারকম ব্যবস্থা- সেগুলি কোথায় আদপে নেই, কোথাও অত্যন্ত দুর্বল। একটা উদাহরণ দিলে সুবিধা হয়। দেশের দুই তৃতীয়াংশ বয়ঃসন্ধির কন্যারা রক্তাল্পতায় ভোগেন। তাদের জন্য মাথাপিছু পঞ্চাশ পয়সা খরচ করলেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিবাহিতা মহিলাদের পরিবার কল্যাণ কর্মসূচি তেমন সুবিধা করতে পারে নি। মহিলাদের গর্ভধারণের আগে ফলিক এসিড দরকার। তা গরিব মহিলারা পান না- তিনটি আবশ্যিক চেক আপ যথাযথ হয় না। একশো শতাংশ শিশু এখনো টিকাকরণ কর্মসূচির আওতায় আসতে পারে নি। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র সব জায়গায় নেই। থাকলেও শিশুদের যে ক্যালরি ও অন্য পরিষেবা দেওয়া দরকার সেগুলো তারা পায় না। মিড ডে মিলে তার অনেকটা প্রোটিন ও ক্যালরি দরকার সেগুলোও তারা পায় না।
এগুলি খুব প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক প্যাকেজ অথচ কোন ইন্সুরেন্স প্যাকেজে এগুলি নেই। তাই, ইন্সুরেন্স কখনো দেশের মানুষের সামগ্রিক সুবিধা করে না। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তা থেকে উপকৃত হন কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সমাজের জন্য তা খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ নয়। সরকারের তাই নিজস্ব পরিকাঠামো দরকার। সেই পরিকাঠামো শক্তিশালী হতে হবে ও সর্বত্র সমমানের হতে হবে। হতে হবে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। এই রকম একটি পরিকাঠামোর জন্য কত খরচ হবে?
সরকারের কাছে এই দাবী পেশ করলে তারা বলেন তাদের অর্থ নেই, যেন এর জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হবে। ডঃ শ্রীনাথ রেড্ডির হাই লেভেল এক্সপার্ট গ্রুপ একটি হিসাব করে বলে যে এই ধরনের ন্যূনতম পরিকাঠামো তৈরী করতে হলে সরকারের খরচ হবে জিডিপির মাত্র 2.5%। কোন সরকার এই সামান্য খরচ করতে রাজি নন। অথচ, তার বহুগুণ অর্থ ব্যয় হয় শিল্পপতিদের ভর্তুকি দিতে, বড়লোকদের লোন মোছা বাবদ প্রতিবছর সরকারের লক্ষ কোটি খরচ হয়ে যায়। এছাড়া আছে নানারকম অপ্রয়োজনীয় খরচ। মূর্তি বানানো, মন্দির মসজিদে বানানো, হজ সাবসিডি, তীর্থ যাত্রার সাবসিডি জন্য, ভিআইপি দের সুরক্ষার জন্য, তাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য সরকার অকাতরে খরচ করে চলেছে। অথচ, যখন স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামোর প্রশ্ন আসে তারা নির্বাক হয়ে নির্বিকল্প সমাধি প্রাপ্ত হন।
কোভিড চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে কেন সরকারী পরিকাঠামো চাই। কেন শুধু চিকিৎসা নয়, পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দরকার। কেন রেল বেসরকারি হাতে দিলে তা আখেরে সমাজের ভালো হবে না। কেন কয়লা খনি বেচতে দেওয়া যাবে না, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্স থেকে ভারত পেট্রোলিয়াম কেন সরকারী ক্ষেত্র গুলো কে বাঁচাতে হবে। কোভিড চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। আমরা কি কিছু শিখছি?