ইদানিং দুমদারক্কা করোনা হচ্ছে লোকজনের। দিব্বি একদিনের জ্বরের পর হাসিমুখে থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে আউটডোরে গা চিপকে নিশ্চিন্ত সমস্যার এলোমেলো উপাখ্যান শোনায় তারা।
গ্যায় প্যায় ব্যথা। পাইখানা শক্ত। নাকে গন্ধ নাই। ক্ষুধা নাই ডাক্তার বাবু। ভাল্লাগতাসেনা কিস্যু।
আমি চমকাই। বুকের ঘসঘষানী শুনতে চেষ্টা করি স্টেথোস্কোপ বাগিয়ে। চকিতে মাপতে থাকি স্যাচুরেসন। কভিড নাইন্টিন, ডি ডাইমার, সিআরপি, ইত্যাদির ফর্দ ঝোলাই বিচ্ছিরি কদর্যতায়। সে কিন্তু বিড়বিড় করে। ব্যথাডা কমায় দেন বাবু। কাম কাজ নাই। বইসা বইসা কয় দিন খামু। কন…
বলিনা। কিছুই বলিনা। শুধু একের পর এক দিশাহীন প্রেসক্রিপশনের ঘসঘষানী ক্লান্ত করে দেয়। তাও লিখি। ভয়ে ভয়ে ওপিডি সেরে রওনা দিই বাড়ির রাস্তায়। হিমের পরশের সাথে হুটহাট এসেপরা বৃষ্টি তে পকৃতিও কনফিউসড।
শরৎ এসেছে। বর্ষাও যায়নি পুরোপুরি। রাধানগর বাস স্ট্যান্ডের কাছে এন নাইন্টিফাইভ, ফেস শিল্ড ভেদ করে ছাতিম ফুলের গন্ধ আসে নাকে। মনটা ভালো লাগে। গন্ধ আছে। সে আছে। বুঝি সবটাই। এটা বুঝি যে কিস্যু জানিনা রোগটার। গন্ধ থাকুক বা না থাকুক সে থাকতেই পারে। তবু মিথ্যে সান্ত্বনার মত ভালোথাকার গলতফেমি নিয়ে বেশ থাকি।
ভালো না থাকা ছাড়া উপায়ই বা কি আছে।
বিশ্বজিৎ দা অপথালমোলজিস্ট। কলিনারায়ানপুরে এলে মাঝে মধ্যে আসে আমাদের বাড়ি। চা খেতে খেতে গল্প হয়। সেও আমারই মত চা রসিক। বা বলা ভালো এককাঠি উপরে। হোয়াইট টির পেলব চুমুকে আলটাগরায় সে ঢেউ খেলানো স্বাদ পায় বুনো চা বাগানের পরিতক্ত গুড়ির। কিংবা কষ কষ তিত কুটে অনুভূতির। কথায় কথায় কথা বাড়ে। গন্ধের গল্পের সাথে এসে যায় শিউলী। ভাটুল। ছাতিম ফুল। হাস্নুহানা।
সে তার গল্প বলে। কিভাবে শিউলীর গন্ধে খুলে যায় একটা জানলা। ক্লাস টেন। উঠোনের টপ টপ শিউলীর সাদা বোঁটা। একটা ঘোলাটে একশো ওয়াটের ফিলিপস বাল্ব। বারান্দায় বসে বসে টেস্ট পেপার। উপপাদ্য এইসব।
ঠিকই তো। প্রতিটি গন্ধ আসলে একেকটি পাসওয়ার্ড। কত কি খুলে যায় লহমায়।
ভাদ্রের আকাশ উজাড় রোদ উঠলে আমাদের তক্তপোস থেকে বের হত শীতের পোশাক। পুরনো জামাকাপড়। সেই জামাকাপড়ের ভাঁজ থেকে গড়িয়ে আসা ন্যাপথালিনের গন্ধ পেলেই বুঝতাম পুজো আসছে। সর্বসাকুল্যে প্রত্যেক বছরে পাওয়া একটাই নতুন জামাটা বরাদ্দ অষ্টমীর জন্য। আগের বারের জামা প্যান্ট ভাদ্রের রোদ্দুর মেখে নতুন হয়ে উঠতো। সপ্তমীর জন্য।
প্রতিবার। ট্রেনে বাসে প্যাকেট বন্দী ন্যাপথালিন আমাকে মনে করায় এইসব।
তখন সবে সবে লক ডাউন। দুর দুরান্ত থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে চলে আসছে নিজেদের ঘরে। এমনি এক সন্ধ্যায় পুলিশের ভ্যানে চেপে কঙ্কালসার এক মাঝবয়েসী এসেছিল হসপিটালের ইমার্জেন্সীতে। দীর্ঘ যাত্রায় ফোস্কা পরা পা। ঘামে জবজব জামা প্যান্ট। ময়লাকীর্ণ পুঁটুলি। এক অদ্ভূত যন্ত্রণাময় গন্ধ কোলাজ। মেদিনীপুর থেকে হেঁটে হেঁটে মালদা যাওয়া মানুষটার গন্ধ চাবিতে জানি না কোন কোন গল্প সাজিয়ে রাখছে করটেক্স।
পৃথিবীর সব গন্ধ একেকটা গল্পের পাসওয়ার্ড।
এসব ছাইপাঁশ ভাবি। একটা সন্ত্রস্ত আউটডোরে থুতনীতে মাস্ক। নিশ্চিন্ত মানুষ, ভয় পাওয়া মানুষ, খুঁতখুঁতে মানুষ, ছাতিম ফুল। বৃষ্টি গন্ধ। শিউলী গন্ধ। এইসব হাজারো গন্ধকোলাজ জমিয়ে রাখে যে গল্পের পাস ওয়ার্ড..
সত্যিই আমি ভুলে যেতে চাই। সব গল্প মনে রাখতে নেই।
অসামান্য অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন