কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসার লাগামছাড়া বিল, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে রোগী-পরিজনের ঘটিবাটি বিক্কিরি হওয়া – এসব কোনও নতুন কথা নয়। ভুক্তভোগীরা তো জানেনই, যাঁরা সরাসরি তেমন সমস্যায় পড়েননি, তাঁরাও জানেন।
এই বিপুল বিল-এর সামান্য কিছু অংশই ডাক্তারবাবুর পারিশ্রমিক – বিল-এর মোটামুটি আট-দশ শতাংশ – বিল-এর পরিমাণ যখন প্রচুর বেশি, তখন তার মধ্যে ডক্টর্স ফিজ-এর অনুপাত আরও কমে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচ শতাংশেরও কম – যদিও, পুরো বিলটিই করা যেতে পারে ডাক্তারবাবুর উৎকর্ষ বা দক্ষতার উপস্থিতির জন্যই।
ব্যাপারটা প্রায় আইপিএল-এর মতো। আইপিএল ঘিরে এই বিপুল বাণিজ্য সম্ভব হতে পারে স্রেফ রিঙ্কু সিং-দের ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার দক্ষতার সুবাদেই, যদি রিঙ্কুরা সে অনুপাতে সামান্য অর্থ পেয়ে থাকেন। (আইপিএল-এ অবশ্যই কিছু স্টার ক্রিকেটারও থাকেন, যাঁদের প্রাপ্যের পরিমাণ কম নয় – তেমনই হাতেগোনা কিছু ডাক্তারবাবুও আছেন, যাঁদের প্রাপ্য অর্থ কিছু কম নয়, অনেকে তো এমনকি হাসপাতালের লভ্যাংশও পেয়ে থাকেন, কিন্তু তাঁরা সত্যিই ব্যতিক্রম।)
সেক্ষেত্রে, হাসপাতালের লাগামছাড়া বিল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিপুল ক্ষোভ – এবং যেহেতু সেই খরচটা করানো সম্ভব হয় ডাক্তারবাবুদের সামনে রেখেই, সেই ক্ষোভের অভিমুখ প্রায়শই ডাক্তারবাবুদের প্রতি – সে নিয়ে ডাক্তারবাবুরা বিচলিত হবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। চিকিৎসার বিল কয়েক লক্ষ হলেও তাঁদের ভাগে জোটে সামান্য কয়েক হাজার মাত্র, এমন কিছু বলে নিজেদের প্রতি ধেয়ে আসা বর্শাগুলোকে যথাসাধ্য প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন, এমনও প্রত্যাশিত। তাতে ক্ষোভের প্রশমন হবে কি হবে না, বা ক্ষোভের বর্শা সঠিক অভিমুখে ধাবিত হবে কিনা – অর্থাৎ মানুষের অসুখের সুযোগ নিয়ে, চিকিৎসার মতো বিষয়কে ঘিরে যাঁরা মোটা ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, ক্ষোভটা তাঁদের প্রতি নির্দিষ্ট হবে কিনা – তা বলা মুশকিল, কিন্তু এই ক্ষোভের সঠিক লক্ষ্য যে ডাক্তারবাবুরা নন, এ কথাটা আরেকটু জোর দিয়ে বলা যেতে পারত।
কিন্তু, তাজ্জব ব্যাপার, অধিকাংশ ডাক্তারবাবুই সে রাস্তায় হাঁটেন না।
বরং, বাড়াবাড়ি বিল নিয়ে রোগী-পরিজনের ক্ষোভ প্রকাশ্যে এলে তাঁরা বিব্রত বোধ করেন। অনেকে তো পরিজনের প্রতি সহমর্মিতাবোধ থেকে, বা স্রেফ সমস্যাকুলের প্রতি ভদ্রতাবোধ থেকেও, আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে চুপ করে থাকাটা যে জরুরি, এমনটাও মনে করেন না (যদিও পাঁচতারা হাসপাতালে নিজের বা নিজেদের প্রিয়জনের চিকিৎসা করাতে গেলে সে অভিজ্ঞতা যে প্রায়শই তিক্ত, এটুকু তাঁরাও জানেন)। উলটে সেই বাড়তি বিল জাস্টিফাই করতে বসেন। কেউ কেউ তো এমনও বলে বসেন – ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে খাবার কি সস্তা হয়? সেখানে যদি খাবারের দাম দেখে প্রশ্ন না তোলেন, তাহলে পাঁচতারা হাসপাতালের বিল নিয়ে এত কথা কেন!!
এমনিতে ডাক্তারি বাদ দিয়ে আর পাঁচটা বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় অধিকাংশ ডাক্তারবাবুর যুক্তিবোধ নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো – কেননা, একটা বড় অংশের ডাক্তারবাবুর ধারণা, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং বাদে বাকি সব পেশার মানুষই সেসব পেশা বেছে নিয়েছেন, স্রেফ ‘জয়েন্টে পায়নি’ বলে – কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের উপমাটা, এমনকি ডাক্তারবাবুদের আন্দাজেও, শকিং।
কেননা, একটা বিলাসিতা, আরেকটা জরুরি প্রয়োজন, বা নেসেসিটি। পাঁচতারা, বা যেকোনও রেস্টুরেন্টে, খেতে যাওয়াটা – শখ। হাসপাতালে যেতে হওয়াটা – বাধ্যতা। পকেটে পয়সা না থাকলে সচরাচর কেউ রেস্টুরেন্টে খেতে যায় না – রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে দেউলে হয়ে গেছে, এমন ঘটনাও আমার জানা নেই – কিন্তু প্রিয় মানুষটা অসুস্থ হলে, তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টায় মানুষ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেন না, যেকোনও মূল্যে তাঁকে সুস্থতায় ফেরাতে চান। এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মুনাফা আদায় যদি অমানবিক হয়, অসহায়তাটা না বুঝতে পারাটাও কোনও মনুষ্যোচিত আচরণ নয়।
আসলে, দিনকে দিন, বিভিন্ন কারণে – চিকিৎসকদের প্রতি আমজনতার তিক্ত মানসিকতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই – ডাক্তারবাবুরা, প্রায় গুটির মধ্যে আবদ্ধ সিল্কের পোকার মতো, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। এতে দুপক্ষেরই ক্ষতি। আমজনতারও, ডাক্তারবাবুদেরও। আমজনতার – কেননা, চিকিৎসা তো বটেই, আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের হয়ে কথা বলতে পারতেন যাঁরা, তাঁদেরই প্রতি অবিশ্বাস রোগী-পরিজনকে আরও অসহায় করে ফেলছে। ডাক্তারবাবুদেরও – কেননা, দুঃসময়ে যাঁরা পাশে থাকতে পারতেন, সেই পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্নতা তাঁদের স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল করে ফেলছে।
কিন্তু, নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়!
একজন চিকিৎসক – খবরের কাগজেই দেখলাম – পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষমেশ মারা গিয়েছেন। অপারেশন ও তার পর বিভিন্ন কমপ্লিকেশন – প্রায় মাসখানেক ভর্তি ছিলেন। বেঁচে ফেরেননি। কিন্তু মৃত্যুর পর দেহ ছাড়তে রাজি হয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কেননা, প্রায় এক কোটি টাকার কাছাকাছি বিল পরিজন তখনই মেটাতে পারেননি। স্বাস্থ্যভবনের হস্তক্ষেপে দেহ ছাড়া হয় – যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান যে, পরিজন নাকি শববাহী যান জোগাড় করতে পারেননি বলেই দেহ ছাড়া যায়নি – মৃত চিকিৎসক উত্তরবঙ্গের একটি জেলার স্বাস্থ্য-সহআধিকারিক ছিলেন, স্বাস্থ্যভবন থেকে বিল মিটিয়ে দেওয়া হবে, হাসপাতালকে এমনটাই জানানোর পরেই ‘বডি’ ছাড়া হয়েছে, যদিও খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্যভবন কর্তৃপক্ষও নাকি বিল-এর পরিমাণ দেখে রীতিমতো ভড়কে গিয়েছেন।
তো, রোগী-পরিজনের কাছে এমন অভিজ্ঞতা কিছু নতুন নয়। সে নিয়ে ডাক্তারবাবুরা খুব সরব হয়েছেন, এমন খবর নেই।
এবারে জনৈক ডাক্তারবাবুই যখন রোগী, তাঁর পরিজনের অভিজ্ঞতাও একইরকম। ডাক্তারবাবুরা কি নিজেদের পেশার আরেকজনের এমন পরিণতিতে নড়েচড়ে বসবেন?
সম্ভবত, না। একই গাছের বিভিন্ন ডালে অজস্র গুটিপোকার বাস হলেও, গুটিপোকা কি কখনও সমাজবদ্ধ প্রাণী হতে পারে!!