টুকটুকের একটা টেডি বেয়ার ছিল। ছোটোবেলার কাজের মাসি দিয়েছিল প্রথম জন্মদিনে। সেটা দেখে মা-বাবা একটু মুখ টিপে হেসেছিল। অমন গাঢ় গোলাপি রঙ!
অতিথিরা সবাই চলে যাবার পর বাবা বলেছিল, “দেখো, রঙ ওঠে না তো? তারপর মেয়ের মুখ থেকে পেটে যাবে।”
মা বলেছিল, “দেখি জলে একটুখানি ধুয়ে!”
কিন্তু প্লাস্টিকের প্যাকেট খুলে মা চমকে বলেছিল, “এ কী! এটা কিসের গন্ধ?”
বাবা বলেছিল, “পেট্রলের! সরিয়ে রাখো, সরিয়ে রাখো! কী জানি কী দিয়ে তৈরি!”
মা বলেছিল, “এ বাবা! কালই আসবে, দেখতে না পেলে কী ভাববে?”
বাবা এবারে একটু রেগে বলেছিল, “ভাবুকগে! তাই বলে এটা টুকটুককে দিতে হবে না।”
মা আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু বারান্দার কাপড়-মেলার তারে টেডির দুই কানে দুই ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তারপরে ভুলে গেছিল ওটার কথা।
***
এসব কথা অবশ্য একবছরের টুকটুক জানত না। ও তার প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস, টিংটিং বাজনা আর লাল নীল পুতুলে আর আরও তিনটে টেডি নিয়ে মগ্ন। এসব কথা টুকটুক এখনও জানে না। জানবে কী করে? ওর মা-বাবা ছাড়া তো কেউ জানতও না। আর মা-বাবা তো কিছুদিন পরে ভুলেই গেছিল। তাই টুকটুককে কেউ বলেওনি।
তবে টেডি জানত। বলতেও পারত, কিন্তু টেডিরা কথা বলতে পারে না। তাই বলেনি।
কানে ক্লিপ লাগানো অবস্থায় টেডি ওখানেই ঝুলে রইল। প্রথম দিকে একটু ভয়-ভয় করছিল। বারান্দার সামনেটা খোলা, মনে হচ্ছিল, হঠাৎ যদি ক্লিপের মুঠো থেকে হাওয়ার টানে উড়ে বেরিয়ে যায়!
তারপরে ভয় করছিল কাকগুলোকে দেখে। তখন বসন্তকাল। সামনের পার্কের গাছে কাক বাসা বানাচ্ছে। এখান ওখান থেকে কাঠ, কাঠি, তারের টুকরো নিয়ে বাসা তৈরি করে, প্লাস্টিক, তুলো – এ সব নিয়ে এসে বাসায় রাখছে। আর টেডি ভয় পাচ্ছিল, ওকেও যদি টান মেরে নিয়ে যায়?
কাক আসেনি অবশ্য। তবে চড়াই এসেছিল। বিশাল জোরে কিচমিচ কিচমিচ করে ওর চারপাশে কাপড়-মেলা তারে বসেছিল। টেডি ভয় পায়নি। ভেবেছিল, ওরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। রাগ করেছিল, কিছু বলেনি। বলতেই তো পারে না।
কাজের মাসি পরদিন আসেনি। তারপরে আরও দু-দিন আসেনি। মা তিন দিন কাজে যায়নি। দ্বিতীয় দিনে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কেচে মেলতে গিয়ে দেখতে পেল গোলাপি টেডিটা। কাছে গিয়ে নাক লাগিয়ে গন্ধ নিয়ে অবাক হয়ে বলল, “আরে! গন্ধ নেই! শুনছ?”
টুকটুকের বাবা অফিস যাবার জন্য জামা পরছিল। বলল, “তাহলে উড়ে গেছে। পেট্রলের গন্ধ তো!”
মা বলল, “কী করি? কাল মাসি আসবে তো।”
বাবা নাক আর মুখ না খুলে ‘ঘোঁৎ’, না ‘ফোঁৎ’ কী বলে চলে গেল, মা বুঝল না। তাই ক্লিপ খুলে টেডিকে নিয়ে রেখে দিল টুকটুকের খেলনার আলমারিতে।
আলমারিতে কী অন্ধকা-া-া-া-র! টেডি তো ভয়েই সারা। তার ওপর, কালো মোটা গরিলাটা যখন গাঁ-গোঁ করে নাক ডাকতে শুরু করল, টেডি তো ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যায় আরকি!
পরদিন, মা অফিস যাবার পর, দুপুরবেলা টুকটুককে খাইয়ে দাইয়ে শোয়ানোর সময়, মাসি আলমারি খুলে টকটকে গোলাপি টেডিটা বের করে দিল। নতুন খেলনা পেয়ে টুকটুক আনন্দে মাতোয়ারা, দু-হাত বাড়িয়ে বলল, “গ্নুইইইই।” তারপর টেডিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। টেডিও আবার আলোয় বেরিয়ে খুব খুশি! ও-ও ওর লোমওয়ালা ছোট্টছোট্ট দুটো হাত দিয়ে টুকটুককে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধেবেলা মা ফিরে এসে কিছু বলল না, কিন্তু মাসি চলে গেলে পরে টুকটুককে বলল, “ওই টেডিটা নিয়ে খেলো না। রেখে দাও। আমি ওটা আলমারিতে রেখে দেব।” শুনে তো টেডির হয়ে গেছে! আবার ওই গোরিলার সঙ্গে! বাপরে। শুকনো মুখে টুকটুকের হাত জড়িয়ে ধরল।
টুকটুক হাত ধরাটা বুঝল কি না, কে জানে, জোরে মাথা নেড়ে বলল, “নান্নান্নান্নান্নান্না…”
টুকটুকের মা বলল, “ওটা ভালো না, দেখো, এই টেডিটা কী সুন্দর! ওর গায়ের রঙ বাদামী, নাক চোখ কালো…”
টুকটুক আরও জোরে মাথা নেড়ে বলল, “নান্নান্নান্নান্নান্না…”
টুকটুকের মা আলমারি থেকে একটা একটা করে খেলনা বের করে বলতে থাকল, “এটা নাও, এটা নাও…” কিন্তু টুকটুক খালি মাথা নাড়ে, আর বলে, “নান্নান্নান্নান্নান্না!”
বাবা ফিরলে মা বলল, “মাসি-ই বের করে দিয়ে গেছে। দেখো তো, নিতে পারো কি না?”
বাবা টুকটুকের পাশে বিছানায় বসে বলল, “এটা তোমার ভালো লাগে?”
টুকটুক বিছানায় গড়িয়ে পড়ে বলল, “গ্নিইইইইই!”
বাবা বলল, “এতই পছন্দ? থাক তাহলে!”
***
সেই থেকে টুকটুকের বিছানায়, ওর বালিশের পাশেই থাকে টেডি। একটু বড়ো হবার পর, কথা বলতে শুরু করার পর টুকটুক ওর নাম রেখেছিল, পিঙ্কি। সব খেলনা, সব পুতুল জানত, পিঙ্কি টুকটুকের প্রিয়। সারা দিন যাই খেলুক না কেন, যাই পড়ুক না কেন, রাতে শুতে যাবার সময় ওর পিঙ্কিকেই চাই। আরও বড়ো হয়ে ইশকুল থেকে ফিরে বিশ্রাম করার সময় পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে সারাদিনের গল্প শোনাত। কবে কোন টিচার বকেছে, কোন বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, কোন পরীক্ষা ভালো হয়েছে – সব বলত। কখনও টেডি ওকে বলে দিত ওর কী করা উচিত, কিন্তু টুকটুক শুনতে পেত না। টেডি কথা বলতে পারে না তো, তাই।
বড়ো হয়ে গেল টুকটুক। ওর সেই মাসি কবেই চলে গেছে কাজ ছেড়ে। পিঙ্কিও বুড়ো হয়েছে। ওর গোলাপি রঙ আর আগের মত উজ্জ্বল নেই। তবু ও এখনও টুকটুকের বালিশের পাশেই থাকে।
পড়াশোনা করতে টুকটুক বিদেশ চলে যাবার পর ওর মা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে সব পুতুল গুছিয়ে একটা বাক্সে ভরে রাখল। বিছানায় বসে ভয়ে ভয়ে পিঙ্কি দেখছিল। ওকেও ওই বাক্সে ঢুকতে হবে? এখন অবশ্য আগের মতো অত নেই – আলমারিটাও বই ভর্তি। গোরিলাটাও কোথায় গেছে কে জানে, তবু…
বিছানা ঝাড়তে এসে টুকটুকের মা পিঙ্কিকে তুলে নিল, তারপর কী ভেবে আবার রেখে দিল বালিশের পাশে। পিঙ্কি খুব আস্তে আস্তে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল, কেউ যাতে বুঝতে না পারে।
***
অনেক দূরের পথ। অনেক টাকা লাগে প্লেনের টিকিট কিনতে। টুকটুক ফিরল অনেক দিন পর। মা যত্ন করে ঘর গুছিয়ে রেখেছে আগের দিনই। লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকেই টুকটুক বলল, “মা-া-া-া, আমার পুতুলগুলো সব ফেলে দিয়েছ?
মা রান্নাঘর থেকে বলল, “দেখ, ওই কোণায় একটা কার্টনে রয়েছে সব।”
টুকটুক কার্টনের ঢাকনা খুলে বলল, “কই, এখানে তো…” বলে এক ঝটকায় বিছানার চাদরটা সরিয়ে দিয়েই, “পিঙ্কি!” বলে জড়িয়ে ধরল পিঙ্কিকে। এখন অবশ্য টুকটুক আর পিঙ্কির সঙ্গে কথা বলে না – বড়ো হয়ে গেছে কি না! কিন্তু পিঙ্কি কত কথা বলল! বলল, “তুমি কোথায় চলে গেছিলে? এখন এখানেই থাকবে? না কি আবার যাবে? আমাকে নিয়ে যাবে?”
টুকটুক অবশ্য উত্তর দিল না। শুনতেই পেল না। মা ডাকল বলে লুচি আলুর দম খেতে গেল।
***
টুকটুক একদিন আবার চলে গেল। এর পর আবার অনেকদিন পরে ফিরল। পিঙ্কি তখনও ওর বিছানায়, কিন্তু টুকটুক আর ওর দিকে তাকাল না। ওকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে ল্যাপটপটা বালিশের পাশে রেখে সিনেমা চালাল। ল্যাপটপের পেছনে পিঙ্কি কী করছে দেখলও না।
সেবার যাবার সময় মা বলল, “তোর ছোটোবেলার খেলনা, পুতুল, যা বাকি রয়েছে, সেগুলো কাউকে দিয়ে দেব? আমি একদল লোকের খোঁজ পেয়েছি – ওরা গরিবদের দেয়…”
বাক্সটা নিয়ে বেরোতে বেরোতে টুকটুক বলল, “ওই কার্টনটা তো গত তিন বছরে খুলেও দেখিনি। দিয়ে দাও।”
মা বলল, “আর পিঙ্কি?”
দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল টুকটুক। ল্যাপটপ-টা নিয়ে ব্যাগে ভরার পরে কেউ পিঙ্কিকে সোজা করে দেয়নি। চারটে খাটো খাটো হাত পা আকাশের দিকে তুলে শুয়ে আছে বালিশের পাশে।
মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে, দিয়ে দিও।”
***
বাইরের লোকগুলো যেদিন কার্টনের খেলনা, পুরোনো জামা, বিছানার চাদর, এ সব নিতে এল, পিঙ্কি রয়ে গেল বিছানার চাদরের নিচেই। ওরা একটা পেছন-খোলা অটোতে থলেতে সব বেঁধে নেবার পর মার খেয়াল হল, ছুটে গিয়ে জানলা দিয়ে পিঙ্কিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে, এই যে, এটাও নিয়ে যাও, এটাও…”
ওরা পিঙ্কিকে নিয়ে এসে এদিক-ওদিক দেখল। একজন বলল, থলের মুখের বাঁধাটা খুলি?”
অন্যজন বলল, “একটা টেডি বেয়ার, তাও আবার পিঙ্ক! ছাড় তো! এমনিই রেখে দে পেছনে।”
প্রথম জন তা-ও থলেগুলোর নিচে পিঙ্কিকে গুঁজে দিল। তারপর অটো চালিয়ে দিল। ওদের অফিস শহরের অন্য প্রান্তে।
ভারি থলের চাপে পিঙ্কির দম-বন্ধ লাগছিল। কিন্তু রাস্তায় অটোর ঝাঁকুনিতে থলেটা একটু একটু করে সরে গেল। পিঙ্কি সবে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে, এমন সময়, খালপাড়ে বড়ো ব্রিজটার নিচে একটা গর্তে পড়ে অটোটা এমন ঝাঁকুনি দিয়েছে, যে পিঙ্কি ছিটকে পড়েছে বাইরে।
খানিকক্ষণ হাঁপিয়ে পিঙ্কি বুঝল ও রাস্তায় পড়ে গেছে। আশপাশ দিয়ে বিশাল বিশাল গাড়ি ছুটছে। ও অবশ্য গাড়ি কী তাই জানে না! তা-ও ভয় করে বইকি!
রাস্তার ধারে, খালপাড়ে একটা ঝুপড়ির বাইরে ছোট্ট বাচ্চাটা হাত তুলে পিঙ্কির দিকে দেখিয়ে বলল, “গ্নুইইইইই!”
ওর দিদিও দেখেছিল অটো থেকে একটা টেডি পড়ে গেছে। গাড়ির ফাঁকে-ফাঁকে গিয়ে তুলে এনে দিল ভাইকে।
বাচ্চাটা দু হাত দিয়ে পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে লালাভরা মুখ লাগিয়ে বলল, “আব্লাব্লিব্লিব্লি!”
আরামে পিঙ্কির চোখ বুজে এল। ও-ও দু হাতে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ব্লিব্লিব্লিব্লি।”
কেউ শুনতে পেল না। টেডি বেয়ার তো কথা বলতে পারে না, তাই।
- কলকাতা মে, ২০১৭