২০২০-এর প্রথম দিনে ‘ডাক্তার ডায়ালগ’ নামক পোর্টালটির আত্মপ্রকাশ মূলত কিছু চিকিৎসকের মহৎ উদ্যোগ। এটিকে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের একটি নতুন হাতিয়ারও বলা যেতে পারে। কেননা এই পোর্টালের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা। তবে মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য নতুন মাধ্যমের ব্যবহার করা হলেও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকে নতুন বলা যাবে না। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের এক বিরাট ইতিহাস আছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার অবকাশ এখানে নেই। তাই কিছু ব্যক্তির কথা বলা হবে যাঁরা জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক স্তরে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথমেই যাঁর কথা বলতে হয় তিনি হলেন ডেভিড ওয়ার্নার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ শাসন থেকে মুক্তি পেতে থাকে। কিন্তু স্বাধীন হলেও এই দেশগুলি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে, এর মধ্যে অন্যতম ছিল জনস্বাস্থ্যের সমস্যা। এই প্রেক্ষিতে ওয়ার্নার লাতিন আমেরিকায় এক বিরাট জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ওয়ার্নার চেয়েছিলেন গ্রামের মানুষ যেন নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান করতে পারে। তিনি বলেছিলেন ‘স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রচারে তখনই সুস্থ অবস্থা আসবে যখন চিকিৎসাবিদেরা নেতৃত্বাধীন থাকবেন আর নেতৃত্ব দেবেন গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মীরা।’ মেক্সিকোতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন Project Piaxtla। এখানে ছিল স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৯৭৫ সালে হেসপেরিয়ান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। যেখান থেকে বেরিয়েছিল তাঁর ‘Where There is No Doctor’ নামক বইটি, যেটি সমগ্র বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিল এবং এই বইটি একাধিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। বাংলায় অনূদিত বইটির নাম ‘যেখানে ডাক্তার নেই’। এই বইটি এখনও সমপরিমাণে প্রাসঙ্গিক। এছাড়া হেসপেরিয়ান ফাউন্ডেশন থেকে ডেভিড ওয়ার্নারের লেখা আরও অনেক বই প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি পঞ্চাশটির বেশি দেশে কাজ করেছেন এবং ২০০০ সালে বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেখানে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
লাতিন আমেরিকার মতো আন্দোলন দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের পথিকৃৎ কর্মী হলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে বসবাসকারী কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক ছুটে এসেছিলেন নিজ দেশে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা সেই সময় গড়ে তুলেছিলেন ফিল্ড হাসপাতাল। দেশের স্বাধীনতার পর ফিল্ড হাসপাতাল থেকেই জন্ম হয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের। সংগঠনের নামকরণ সম্পর্কে জাফরুল্লাহ বাবু বলেছিলেন ‘সংগঠনের নাম ঠিক করার জন্য গিয়েছিলাম মুজিব ভাইয়ের (মুজিবর রহমান) কাছে। শেষে নাম ঠিক হলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কেননা গণস্বাস্থ্য নামটার মধ্য দিয়ে আমাদের বিরাট কর্মক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে, যেটা জনস্বাস্থ্য শব্দের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামকরণ হলে সরকারী উদ্যোগ মনে হতে পারে।’
এবার আসি ভারত প্রসঙ্গে। ভারতে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অমিত সেনগুপ্ত, অনন্ত ফাড়কের মত ব্যক্তিরা। তবে সমগ্র ভারতে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসের বয়স একটু কম হলেও বাংলায় জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাস বেশ পুরনো। যার সূচনা বিংশ শতকের প্রথমেই। প্রথম দিকের এই জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন স্বাস্থ্য সমাচার পত্রিকার সম্পাদক কার্তিকচন্দ্র বসু ও ম্যালেরিয়া নিবারণী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই দুই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা অন্য কোথাও করা যাবে। চলুন আমরা স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে কয়েকজন ব্যক্তির অবদান সম্পর্কে জেনে নিই দিকে নজর রাখি। এক্ষেত্রে প্রথমেই যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা হলেন সুখময় ভট্টাচার্য, জ্ঞানব্রত শীল এবং সুজিত কুমার দাশ। এই তিনজনের নামের সাথে আমার প্রথম পরিচিতি হয় গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ পড়ে। দু’দশক আগে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন আমার স্যার অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে সুখময় ভট্টাচার্য এবং জ্ঞানব্রত শীল নামে এই দুই ডাক্তারের উদ্যোগে আশির দশকে গড়ে উঠছিল ‘নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ (১৯৮৩)। আরেক সংগঠন পথচলা শুরু করেছিল এই সময়, যাঁরা চাইছিল ওষুধ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে। সেই সংগঠনের নাম ‘ড্রাগ অ্যাকশন ফোরাম’ (প্রতিষ্ঠা ১৯৮৪, পঞ্জিকরণ ১৯৮৬)। ডাক্তার সুজিত দাশ ছিলেন সেই সংগঠনের অগ্রনায়ক। এই সংগঠনের সঙ্গে আরও কিছু ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, যেমন– পীযুষকান্তি সরকার, স্মরজিৎ জানা প্রমুখ।
এই ডাক্তাররা মানুষের মধ্যে থেকে কাজ করতে চেয়েছিলেন। জ্ঞান শীল বলেছেন ‘আমি দুর্ভিক্ষকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। ক্ষুধার জ্বালা কাকে বলে সেটা আমি জানি। তাছাড়া দেখেছি স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতার জন্য বা চিকিৎসার অভাবে এদেশে অনেক মানুষ মারা যায়। তাই আমরা দুই বন্ধু কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে আমরা যে খুব বেশি কিছু করতে পেরেছিলাম সেটা বলব না।’ তবে তাঁরা একসময় কাজ বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু কেন নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন খুব বেশি কাজ করতে পারে নি, সেই ইতিহাসের অনুসন্ধান পরে করব।
সত্তরের দশকে সমজ বদলের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে অনেক ডাক্তারি ছাত্রও কেরিয়ারের কথা না ভেবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁরা জনসেবার আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। এই ধরণের এক ব্যক্তি হলেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য। তবে সেই আন্দোলনের ব্যর্থ হলেও আন্দোলনের কর্মীরা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। জয়ন্ত ভট্টাচার্য এখনও অল্প অর্থে রোগী দেখেন। যেমনটা করতেন কার্তিকচন্দ্র বসু। আসলে বিশ্বায়ন সৃষ্ট ভোগবাদ এই ধরনের মানুষের কাছে মাথা নত করেছে।
নব্বইয়ের দশকের শেষে পশ্চিমবঙ্গের জনস্বাস্থ্য আন্দোলন যখন ঝিমিয়ে পড়ছে তখন জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন বেশকিছু চিকিৎসক। যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পুণ্যব্রত গুণ। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে এই মানুষটির হাতেখড়ি হয়েছিল ছত্তিশগড়ে শংকর গুহনিয়োগীর নেতৃত্ব গড়ে ওঠা শহিদ হাসপাতালে। শংকর গুহনিয়োগীর মৃত্যুর পরও তিনি ওখানে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলেন। এরপর তিনি এরাজ্যে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে হাত লাগান। তিনি কোনওদিন সরকারী-বেসরকারী চাকরির বা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেষ্টা করেন নি। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তিনি মাত্র ১০০০ টাকা ভাতায় কাজ শুরু করেছিলেন শহিদ হাসপাতালে। আসলে অর্থ তাঁর কাছে প্রধান নয়, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে থেকে কাজ করা। কখনও কখনও মনে হয় ইনি যেন ‘হাটে বাজারে’ উপন্যাসের সেই সদাশিব ভট্টাচার্য। ডাক্তারি পাশ করার পর জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকেই তিনি ধ্যান-জ্ঞান করেছেন। একটা সময় তিনি অসুখ-বিসুখ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ থেকে প্রকাশিত স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হলেন তিনি। সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগে তিনি প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া তিনি লিখেছেন স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশ কিছু বই, যেমন—ওষুধ-বিষুধ, সাধারণ কিছু অসুখবিসুখ। যে বইগুলি মানুষকে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার দাবি রাখে।
পুণ্যব্রতবাবু পশ্চিমবঙ্গে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন কারণ তিনি পাশে পেয়েছেন অমিতাভ চক্রবর্তী, সুমিত দাশ, সিদ্ধার্থ গুপ্ত, জয়ন্ত দাসের মত চিকিৎসকদের। সিদ্ধার্থ গুপ্ত লেখালিখির মাধ্যমে এরাজ্য তথা দেশে জনস্বাস্থ্যের দুর্দশার চিত্র জনসমক্ষে বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আজ যখন চিকিৎসক-রোগীর মধ্যেকার সম্পর্কে ফাটল ধরেছে সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আরেকজন চিকিৎসকের নাম এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি হলেন অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত। যিনি ডাক্তারি পাশ করার পর দক্ষিণ ২৪ পরগণার বেলপুকুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন এবং সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে দরিদ্র জনগণের সেবা করেছেন। তিনি প্রতিকূলতাকে কিভাবে জয় করেছিলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা ‘এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প’ নামক বইটিতে। যে বইটি পড়লে একজন ডাক্তারের প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে যায়। সাথে সাথে এই প্রবীণ চিকিৎসকদের আদর্শ বেশ কিছু তরুণ চিকিৎসকদেরকেও প্রভাবিত করেছে। আর তাই তাঁরা আজ বড়দের হাতে হাত মিলিয়ে পথ চলার অঙ্গীকার করেছে।