মে মাসের লক্ষনৌ-এর বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমে চোখ মুখ জ্বালা করছে। সামনে টুলে বসা ময়লা ধুতি আর ফতুয়া পরা মাঝবয়েসী মানুষটাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম “নভেম্বর মাসে আপনার ক্যান্সার ধরা পরেছে দুসপ্তাহ বাদে রেডিওথেরাপি র ডেট পেয়েছিলেন, আসেননি কেন? জানেন এখানে ডেট পাওয়া কত মুশকিল? এখন আপনার ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়েছে এখন সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার আর চান্স নেই,তখন তো ছিল। কত করে তো বোঝালাম। ছমাস ক্যান্সার নিয়ে কেউ বসে থাকে?” আমার গলায় হতাশ উষ্মা।
“কা করে সাহাব ররীব আদমি হ্যায়, মজদুরি করতে হ্যায়, দুন মাহিনা ইহা রাহে তো খায়েংগে ক্যায়া। কোই একঠো দাবাই দেইন দো, লেকে ঘর জায়েইন।”
তারপর থেকে অনেক বার শুনেছি
অপুষ্ট বাচ্চা পেট ফোলা পেটে জল, খেতে দাও না?
“কা করে সাহাব, গরীব আদমি হ্যায়”
এতদিন ধরে ব্লিডিং হচ্ছে, দুবছর ধরে ডাক্তার দেখাওনি কেন? “কা করে বাবু গরীব আদমি হ্যায়”
এতটুকু বাচ্চা স্কুলে না পাঠিয়ে চা বেচতে পাঠিয়েছ?
“কা করে সাহাব্ গরীব আদমি হ্যায়”
এরা সব মেনে নেয়। এরা জানে মেনে নিতে হবে। এরাই আমার দেশের ৭০%। এরা জানে মুম্বাই থেকে ছাপড়া বউ বাচ্চা নিয়ে পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে
“কা করে সাহাব, গরীব আদমি হ্যায়”
এরা জানে পথে অনেকে মারাও যাবে।
“কা করে সাহাব গরীব আদমি হ্যায়”
এরা জানে পেটের দায়ে ভয়ংকর করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে কাজে যেতে হবে। অনেকের করোনা হবে। অনেকে মারাও যাবে। তা মেনে নেবে বইকি “কা করে সাহাব গরীব আদমি হ্যায়”
এরা জানে হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না। মেঝেতে শুয়ে মরতে হবে। মেনে নেবে। “কা কারে সাহাব, গরীব আদমি হ্যায়”
এরা জানে রাস্তায়, বাসে, ভিড়ে, কাজে যেতেই হবে। সরকার বলবে কাজে আসতেই হবে কিন্তু যানবাহনের ব্যবস্থা করবে না। এদের দেখিয়ে জাল ভেন্টিলেটর কেনা হবে। এদের ঝড়ের ক্ষতিপূরণের টাকা মেরে দেওয়া হবে। এরা মেনে নেবে। এদের টেস্ট হবেনা। এরা মেনে নেবে। “কা করে সাহাব গরীব আদমি হ্যায়”।
ধর্মগুরু রা করোনা নিয়ে ব্যবসা করবে। করোনা মায়ের দয়া ভেবে এরা ভুলে থাকবে পরিজন বিয়োগ এর শোক। “কা কারে সাহাব গরীব আদমি হ্যায়”।
আর এরা যে মেনে নেবে সরকার জানে। নেতারা জানে। তাই সরকার হঠাৎ করে এমন ভাব করে যেন করোনার আর ভয় নেই। সরকার জানে তার বন্ধুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। একজন দুজন ভি আই পি এখনো ইনফেক্টেড হবে, তা ওটুকু ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। তাদের জন্য প্লাজমা থেরাপি আছে, ভেন্টিলেটর আছে। ভাগ্যিস করোনা প্লেনে চেপে এসেছিল, পায়ে হেঁটে এলে যেটুকু হয়েছে তাও হতো না। কেননা আমাদের দেশের মানুষ তো মেনে নেবে সব।
“কা করে সাহাব, গরীব আদমি হ্যায়”।
এইটুকু পড়লেই, অনেকটা দেখা যায়।
অনেক ধন্যবা।
সত্যিই নিদারুণ এক সমাজ ব্যবস্থা।
আমাদের স্মৃতিও ক্ষণস্থায়ী।
এবং আমরা, সিংহ ভাগ জনতা আত্মসুখীও।