আর কদিন পরেই যাদুঘর এর বাইরে তাদের আর দেখাই যাবে না। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেই এরা প্রায় আমাদের জীবনের অঙ্গ ছিল। আমি বলছি পোষ্ট কার্ডের কথা। একটা ঘি রঙের শক্ত কার্ড, কয়েক ইঞ্চি মাত্র লম্বা। অতি সামান্য দাম। অথচ কতো মহার্ঘ্য সব বার্তা নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যেত।
আমরা হলাম সেই বিচিত্র সময়ের মানুষ, যারা গরুর গাড়ী চেপেছিল আবার জেট প্লেনেও চাপছে। বাঁশ কলমে লিখেছি, আবার ল্যাপটপ স্মার্ট ফোনের কি বোর্ডেও এখন স্বচ্ছন্দ। আমরা ঠিক তালপাতায় লেখার পরের সময়ে লিখতে শুরু করে, এখন স্মার্ট ফোনে লিখছি। আমাদের প্রজন্মের এমন একশো একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়েই লেখা যায়। পোষ্ট কার্ডেএ মত একটা অধুনা বাতিল জিনিসের উত্থান পতন আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেল।
আমার বাবা, আমার জন্মের সময়ে সময়ে আমাদের গ্রামে পোষ্ট আপিস চালু করার জন্য প্রতিদিন পাঁচটা করে পোষ্ট কার্ড লিখে ডাকবাক্স ফেলতেন। আজ সেই পোষ্ট আপিসে চিঠি দেওয়া নেওয়া প্রায় উঠেই গেছে। বাবা সম্ভবত পাঁচ পয়সা দামে পোষ্ট কার্ড কিনতেন। তখনকার বাজার দরে পাঁচ পয়সায় একটা কাঠি আইসক্রীম পাওয়া যেত। ঐ জিনিস এখন পাঁচ টাকা দাম। বাবার লেখা শেষ যে পোষ্ট কার্ড আমার কাছে আছে সেটাও তেইশ বছর আগে পঁচিশ পয়সা দাম ছিল।
আমার কাছে এখনো যে এক- দুটো পোস্টকার্ড থেকে গেছে সেগুলোর দাম ২৫ পয়সা লেখা । আমি এই পোস্টকার্ডগুলো সম্ভবত দশ -পনের বছর আগে কিনেছি । একটা সময় ছিল যখন আমার ব্রিফকেসে এরকম দু’চারটা পোস্টকার্ড, দু’চারটা ইনলান্ড লেটার থাকতো। কোথাও কিছু সময় বসে সময় কাটাতে হলে, আমি ব্রিফকেস থেকে পোস্ট কার্ড বা ইনলান্ড লেটার বের করে লিখতে শুরু করতাম । এমনও হয়েছে, বাসের জন্য এক ঘন্টা অপেক্ষা করছি্, তারমধ্যে দুটো ইনলান্ড লেটার আর দুটো পোস্ট কার্ড লিখে ফেলেছি। এখন ওইভাবে কোথাও বসে সময় কাটাতে হলে আমি মোবাইলে লিখতে থাকি; এই যেমন এখন লিখছি।
ব্যক্তিগত চিঠি লেখা বন্ধ হয়েছে তাও প্রায় ১০ বছর হল। এখন চিঠি বলতে সরকারি কোনো কাজেই চিঠি লেখা হয়। সে চিঠি কম্পিউটারে লিখে প্রিন্ট করে নেওয়া হয়। তারপর খামে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শেষ সরকারি কাজে পোস্টকার্ডের ব্যবহার করেছেন আনন্দবাবু। আমরা বছর চারেক আগে সাপের কামড়ের একটি সমস্যার ব্যাপারে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, ওনাকে বেশ কিছু চিঠি পাঠাই। অনেক সংস্থা নিজেদের লেটারহেড-এ চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন। আনন্দবাবুকে দেখলাম মূল বক্তব্য একটি মাত্র পোস্টকার্ডে লিখে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। আরও কেউ এরকম পাঠিয়েছেন কিনা জানিনা। আমাদের সবারই তো এখন চিঠি লেখায় অনীহা। তার উপর, সাপের কামড়ের মত একটা একান্তভাবে গ্রামের সমস্যা নিয়ে, শহরের লোকেরা পঁচিশ পয়সাও খরচ করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।
আমার বাবা প্রায় জীবনের শেষ মাস পর্যন্ত পোস্টকার্ডে নিয়মিত চিঠি লিখেছেন। বিশেষ করে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা আর শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ডজন ডজন চিঠি লিখেছেন। বাবার এই বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা চিঠির মত আর একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের একটি চিঠি দেখলাম কদিন আগে। বাঁকুড়ার কিংবদন্তি ডাক্তারবাবু প্রফেসর সেনগুপ্ত স্যর-এর একটি বিজয়ার চিঠি তাঁর এক প্রিয় ছাত্র রেখে দিয়েছেন। এগুলি আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। এরকম একটি পোষ্ট কার্ড আমার কাছে আছে।
আমাদের মেদিনীপুর কুষ্ঠ আশ্রমের প্রাণপুরুষ স্বর্গীয়, অরুণ চক্রবর্তী মহাশয়ের এক দুটি পোষ্ট কার্ড আমার সম্পদ হিসেবে রাখা আছে। ঐ কুষ্ঠ আশ্রম এর আর এক প্রাণপুরুষ স্বর্গীয় রথীন ভাদুড়ী মশাই -এর একটি ইনল্যান্ড লেটার আমার কাছে আছে।
আমরা যখন হোস্টেল থেকে বা চাকরীস্থল থেকে বাড়ী আসতাম, ফিরে গিয়ে একটা পোস্টকার্ড অবশ্যই পাঠাতাম। ওটাকে বলা হত, পৌঁছ সংবাদ। বাবার শেষ যে চিঠিটা আমার কাছে এখনো আছে, সেটা তেইশ বছর আগে লেখা। গ্রামের বাড়িতে কীর্তন হয়েছে , সেই খবর। তারসাথে আমার কন্যার স্কুলে ভর্তির খবরে তাঁর আশির্বানী। আমার কন্যা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটা ভালো চাকরীতে যোগ দিয়েছে মাত্র একমাস আগে। এই সময় আবার চোখে পড়ল বাবার সেই চিঠি। সেখানে বাবা লিখেছেন, তোমার কন্যা তোমার মতই বড় হবে। বাক সিদ্ধ যোগীদের কথা শোনা যায়। আমার বাবা ও প্রায় পঞ্চাশ বছর বৈষ্ণব সন্যাসীর মত জীবন যাপন করেছেন। আমার কন্যার শিক্ষার শুরুতেই তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী পূর্ণ হয়ে গেল, এটা জানতে হলে তাঁকে প্রায় একশ কুড়ি বছর বেঁচে থাকতে হত। সংস্কার মুক্ত মন এসব মানতে রাজি নয়। কিন্তু প্রণম্য অরুণ বাবুর বলা সেই “সুকৃতী” পরবর্তি প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়; এটা আমার জীবনের পরীক্ষিত সত্য।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুকৃতী ব্যার্থতার এমন কত শত খবর ঐরকম এক একটা সামান্য পোষ্টকার্ডকে অসামান্য করে রেখেছে। কিন্তু মাত্র ক’বছর আগে লেখা আনন্দবাবুর একটা সামান্য পোষ্ট কার্ড হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা যুগান্তকারী কাজ শুরু করার স্ফুলিঙ্গ হয়ে আছে ; ভবিষ্যৎই তার উত্তর দেবে। পশ্চিম বাংলায় সাপের কামড়ের চিকিৎসার ইতিহাসে, ঐ একটা সামান্য পোষ্টকার্ডও একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে। আমার এই লেখা দেখে আরও হয়তো কেউ এমন একটা চিঠি আবারো পাঠাবেন। কে বলতে পারে একটা অচল সিকির দামের একটা পোষ্টকার্ডই আমাদের থমকে যাওয়া আন্দোলনটাকে একটা বিশাল শক্তি যোগাবে না!