গতকাল কাজে বেরোচ্ছি। সিঁড়িতে পা রেখেই দেখলাম লম্বা মত এক যুবক মুখে মাস্ক ছাড়াই ফোনে কথা বলতে বলতে আমার আগে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। আমার মুখে মাস্ক ও ফেসশিল্ড। তবু একটু থমকে গেলাম। যুবকটি নীচে নেমে আবাসনের সিকিউরিটি স্টাফকে দেখে পকেট থেকে মাস্ক বের করে মুখ ঢাকলো।
এরকম অভিজ্ঞতা আপনাদের সবার নিশ্চয়ই দিনে পাঁচবার করে হয়। কি জানি কার সাথে লুকোচুরি খেলে এরা!
এবছর এপ্রিল মাস। মুম্বাই এর ধারাভি বস্তিতে প্রবল সংক্রমনের আশঙ্কা। কলকাতার বেলগাছিয়া বস্তি নিয়ে জনগণ ও প্রশাসনের তীব্র আশঙ্কা। ওখানে ছোটছোট ঘরে ৬-৭ জন মানুষ বাস করে। একই কল-বাথরুম ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। কি করে সংক্রমন ঠেকাবে এরা? মিডিয়া এবং গুজববিলাসী কিছু লোক প্রচারে প্রচারে জনসাধারণের রোম খাড়া করে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিল। আমার এক বন্ধু যিনি বেলগাছিয়া অঞ্চলে ফ্ল্যাটে থাকেন, আপাততঃ তল্পিতল্পা গুটিয়ে বর্ধমানে দেশের বাড়িতে চলে গেলেন। তাঁর ব্যবসায়িক বন্ধু ফ্যামিলিশুদ্ধ করোনা হয়ে অশেষ ভোগান্তির শিকার- তার পূর্ণ বিবরণ তিনি শুনেছেন। সুতরাং, আপাততঃ বেলগাছিয়া অঞ্চল থেকে পাততাড়ি।
আমার আর এক বন্ধু, বেলগাছিয়াতে যাঁর পৈতৃক বাড়ি, বলেছিলেন- ‘ছোটবেলা থেকে দেখছি তো, এখানে কিন্তু অত খারাপ কিছু হবে না। কন্ট্রোল হয়ে যাবে।’ রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তিনি যুক্ত। বস্তিতে ত্রাণকাজের অভিজ্ঞতা আছে। তবুও তার আশ্বাসে আমি ভরসা করি নি।
কিন্তু এই দ্বিতীয় বন্ধুটিই ঠিক আন্দাজ করেছিলেন। দেড়মাস বাদে দেখা গেল, কি ধারাভি, কি বেলগাছিয়া- দু’জায়গাতেই সংক্রমণ কমেছে। এলাকার সাধারণ মানুষ প্রশাসনের সহায়তায় সুশৃংখল ভাবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, টেষ্ট ও কনট্যাক্ট খুঁজে, আইসোলেট করে, হাত ধুয়ে, মাস্ক পরে সংক্রমণকে আপাততঃ বশে এনে ফেলেছে।
অন্যদিকে আলিপুর ও কলকাতার অন্যান্য মধ্যবিত্ত ও অভিজাত অঞ্চলে নিজস্ব বড় বাড়ি, বড় বড় ফ্ল্যাট, বাংলো, ডুপ্লে, পেন্টহাউসে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। কেন?
কারণ এরা সবজান্তা, নিয়ম ভাঙার দলে। তারা মাস্ক পরবে না, দূরত্ববিধি মানবে না, জিমে- রেস্তোঁরায় যাবে, মিটিং করবে, পার্টি করবে, দলবেঁধে চায়ের দোকানে আড্ডা মারবে, সকাল-বিকেল বেড়াতে এবং বাজার করতে বেরোবে। বাড়িতে করোনা হলে বাড়ির লোকেরা আইসোলেশনে থাকবে না। উপরমহলে প্রতিপত্তি খাটিয়ে স্বাভাবিক ঘুরে বেড়াবে। কেউ বারণ করলে তাকে ভীতু, অপদার্থ বলে উপহাস করবে, তর্ক করবে। এমনকি চড়াও হবে।
কারণ কমবয়স হলে এদের ধারণা, ‘আমার সংক্রমণ হবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি হয়েও যায়- মরব না। সুতরাং, কিছু মানব না।’ বেশী বয়স হলে ‘যা হয় হবে। অতশত মানা যায় না। হলে পরে টাকাপয়সা আছে, স্বাস্থ্যবীমা আছে। বড় কর্পোরেট হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাব।’
কর্পোরেট হাসপাতাল দিয়ে যে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এমার্জেন্সী ও অতিমারী সামলানো যায় না, তারজন্য সরকারের তরফে সঠিক জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা এবং তার কঠোর বাস্তবায়ন, জনসাধারণের তরফে অবাধ্যতা বর্জন করে শৃংখলা অর্জন করা যে খুব জরুরী- একথা এরা বোঝে নি। তাই মুম্বাই-দিল্লী-বেঙ্গালুরু- কলকাতার অভিজাত অঞ্চলগুলোতে সংক্রমণের গ্রাফ ক্রমশঃ উর্দ্ধমুখী।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ভুল পরিকল্পনা, তথ্য চেপে রাখার প্রবণতা, সময়মত সুরক্ষাবিধি লাগু করায় গাফিলতি তো আছেই। তার সঙ্গে বেশ কিছু মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাবান মানুষের সবজান্তা এবং যথেচ্ছাচারী মনোভাব সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী।