কোনও আত্মহত্যার খবর এলেই ফেসবুকে একধরনের বিকৃত সহমর্মিতাবোধের বন্যা বয়ে যায়। বিশেষত, আত্মহত্যার যদি কোনও রগরগে কারণ (পরকিয়া প্রেম ইত্যাদি) খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে তো এই প্রায়-মর্ষকামী সহমর্মিতা একেবারে অসহনীয় লেভেলে পৌঁছে যায়।
ইশ! কী হয়েছিল?
ইশ! আগে থেকে কেউ বুঝতে পারেনি!
ইশ!… আজকাল সবাই কেমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে যাচ্ছে… কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি সেই ছেলেবেলার পাড়া… কোথায় হারিয়ে গেল সেই পাড়াতুতো জ্যেঠুরা, যারা ইত্যাদি প্রভৃতি… কেউ যেন আর কারও বন্ধু নয়… সবাই কেমন যেন ইয়ে… ইত্যাদি প্রভৃতি…
মুশকিল হলো, এঁদের এই যাবতীয় “সহমর্মিতা” “উৎকণ্ঠার” মধ্যে একটা দ্বিচারিতা রয়েছে। যাকে আরও উপযুক্ত বাংলায় বলতে হলে বলতে হয় ঢ্যামনামো।
কেননা, যাঁরা এমন করে বিচলিত হওয়ার ভান করছেন, তাঁদের অধিকাংশই অপরের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবেন না, সচরাচর অপরের অসময়ে পাশে থাকেন স্রেফ চাটনি খবর সর্বাগ্রে পাওয়ার আশায়।
এবং এঁরা যদিও বারবার গলা কাঁপিয়ে ‘’আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি” বলে থাকেন, আদতে এঁরা আবার প্রাইভেট স্পেস-এর সার্বভৌমত্বে বাড়াবাড়ি রকমের আস্থা রাখেন (যদি না চাটনি খবরের আশায় অপরের ব্যক্তিজীবনে উঁকি দেবার সুযোগ পান)।
আজ তো আরও চরম “সহমর্মিতা” দেখলাম। একেবারে ডাক্তার-তুল্য প্রেসক্রিপশন। বাউল-সাধুসন্তরা কি আত্মহত্যা করেন? তাহলে? আত্মহত্যা এড়াতে চাইলে ওই পথ ধরুন।
সিরিয়াসলি, এরকম সদুপদেশ একজন ডাক্তারবাবু দিচ্ছেন এবং বাকিরা সেসব হুলিয়ে শেয়ার করছেন! সাধে কি বলি, আশেপাশের অধিকাংশ ডাক্তারবাবুদের কাণ্ডজ্ঞান তথা লজিক-জ্ঞানের যা লেভেল, তাতে… নাহ্, থাক… অকারণ শত্রু বাড়িয়ে লাভ নেই!
না, সাধু-সন্ন্যাসীদের হেয় করছি না। তবু একেবারে গোদা অঙ্কে বলতে গেলে বলা যায়, আপনি যদি পাঁচশজন সাধারণ মানুষ চেনেন, সন্ন্যাসী চেনেন পাঁচজন – এবং সেই পাঁচশজনের মধ্যে দুজনকে যদি আত্মহত্যা করতে দেখেন, তাহলে হিসেবটা দাঁড়ায় আড়াইশোয় এক – সন্ন্যাসী তো মোটের উপর চেনেনই পাঁচজন, তা-ও আবার অল্পস্বল্প চেনা, তাঁরা কীসে কীভাবে কোথায় মারা যান সেসব আপনি মোটেই জানেন না!
আর যদি ধরেই নিই, যে সন্ন্যাসী হওয়াটাই (নিদেনপক্ষে গভীর আধ্যাত্মিক হওয়াটাই) আত্মহত্যা নিবারণের একান্ত উপায় – তাহলে হৃদরোগ নিবারণের জন্য হৃদযন্ত্র বাদ দেওয়ার প্রেসক্রিপশনটাই বা খারাপ কী?
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
…
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।”
এর বিপরীতে প্রেসক্রিপশন, জীবনের জটিলতা কাটাতে, ইহকালকে স্রেফ পরকালের প্রস্তুতি হিসেবে যাপন করার? না, মানে, কথাগুলো সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে লিখেছেন তো?
নাহ্! লেখাটা খুব তিক্ত হয়ে যাচ্ছে। পড়ে কেউ আহত বোধ করলে মাফ করে দেবেন, প্লিজ! আজ সত্যিই মাথা কাজ করছে না। রাগ হচ্ছে, হতাশ লাগছে, অক্ষম একটা অভিমান হচ্ছে – ভুলভাল কথা বলে বসলে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ।
আসলে, আজ যাকে হারিয়েছি, তাকে ভাইয়ের মতো না বলে ভাই বলা-ই ভালো।
সবার সঙ্গে মিশে থাকত সে। সবার বিপদে-আপদে দৌড়ে আসত সে। অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামার ব্যাপারে সবসময় এক-পা বাড়িয়ে থাকত সে।
সবসময় তাকে দেখেছি হাসিমুখে।
সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে। এবং আর অনেক ক্ষেত্রে যেমন হয়, তাদের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। সেই প্রেম টলেনি এতটুকু। সন্তান পরীক্ষায় চমৎকার ফল করেছে – সেখানেও হতাশার সুযোগ ঘটেনি।
আর হ্যাঁ, জীবনে বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার ছিল না। মস্ত ফ্ল্যাট বা চমকে দেওয়া গাড়ি বা ফিবছর বিদেশে ছুটি কাটানো – এসব তার স্বপ্ন ছিল না। কাজেই, তার স্বপ্নপূরণের জন্য যেটুকু প্রয়োজন, অন্তত তেমন আয় তার ছিল – অনটনের প্রশ্ন ছিল না।
এবং সবার বিপদে-আপদে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবার আগে প্রায় অযাচিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার গুণ ইদানীং অতিবিরল – কিন্তু সেই অতিবিরল শ্রেণীর মানুষগুলোর পাশে মানুষ সাধারণত থাকে, অন্তত এই অতিবিরল শ্রেণীভুক্ত মানুষগুলো সেই অর্থে একা হয়ে যান না, অন্তত আমাদের মতো আত্মকেন্দ্রিক প্রাণীদের মতো একা হয়ে যান না (অথচ, তার পরও এঁরা কখনও কখনও একাকিত্বে ভোগেন – মানসিক অবসাদের খেলা এমনই অদ্ভুত – আমার ভাইটি যেমন…)।
তবু সে…
কাব্যি করে বললে বলতেই পারি…
“…বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো…
…এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;…”
কিন্তু যার কথা বলছি, সে মাঝেমধ্যে “বেরসিক” ছদ্মনাম ব্যবহার করত। তার কাছ থেকে পাওয়া আমার শেষ উপহারটিতেও ওই “বেরসিক”-ই লেখা।
তাই বেরসিকের মতো বলি,
অবসাদ বা ডিপ্রেসন কোনও নিজেনিজেই বা সৎসংসর্গে কাটিয়ে ওঠার ব্যাপার নয়। ডায়াবেটিস বা হাঁপানির মতোই, ডিপ্রেসনও অসুখ। এবং ডায়াবেটিস বা হাঁপানির মতোই, সময়ে চিকিৎসা না করালে ডিপ্রেসনও প্রাণঘাতী। আর পাঁচটা অসুখে যেমন, ওষুধপত্র ও চিকিৎসার সঙ্গে নিয়ম মেনে চলা জরুরি – ডিপ্রেসনেও চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সাহচর্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিকিৎসাটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কাউকে অবসাদগ্রস্ত মনে হলে তার পাশে থাকুন – তার একাকিত্ব ও হতাশা দূর করুন – কিন্তু অবশ্যই তাঁকে ডাক্তার দেখাতে বলুন।
আর যা-ই করুন, হুল্লোড় ইত্যাদি করতে করতে – বা আধ্যাত্মিকতার ক্লাস করতে করতে – তিনি নিজেনিজেই ডিপ্রেসন কাটিয়ে উঠবেন, এমন অলীক আশায় ভুগবেন না।
আর হ্যাঁ, এটাও মনে রাখুন – কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদকে কিছু কারণ বা পরিস্থিতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও অনেক ক্ষেত্রেই, হয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, অবসাদ বা ডিপ্রেসনের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এবং কারণ খুঁজে না পাওয়া যাওয়ার অর্থ তাঁর অবসাদটা দুঃখবিলাস, এমন কখনোই নয়।
সর্বশেষত, ডায়াবেটিস হাঁপানি ক্যানসার কিংবা ডিপ্রেসন – হাজার চিকিৎসা বা অসুস্থ মানুষটি ও পরিজনের হাজার চেষ্টার পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারও কারও অসুখ সারে না। তার অর্থ কিন্তু এমন কখনোই নয়, যে, অসুস্থ মানুষটি বা তার পরিজনের তরফে সদিচ্ছার কোনও অভাব ছিল।
শোকের মুহূর্তে সহমর্মিতার ভান করে নিজেদের জ্ঞানের ঝাঁপিটি না হয় এখনই উপুড় না করলেন! দুটো দিন সবুর করুন, আপনিও থাকছেন আর ফেসবুকও থাকছে – সামনের সপ্তাহে না হয় আপনার বাণীর আলোকে উদ্দীপিত হওয়া যাবে!
পুনঃ- বইটা হাতে ধরিয়ে সে ভারি লাজুক মুখে বলেছিল – তুমি কিন্তু বইটা পড়ে, মানে যদি আদৌ পড়ো, আমাকে জানাবে তোমার কেমন লাগল।
বই পড়ে ভালো লাগার কথা বিস্তারে লিখব ভেবেছিলাম। মানে, একেবারে পাঠপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বড় করে লেখা। গুছিয়ে লিখব, আরেকটু গুছিয়ে লিখব এরকম করতে করতে আদৌ আর লেখা হলো না। ভালো লাগার কথাটা জানানোও হলো না তাকে। নিজের ব্যাপারে সঙ্কুচিত ভাইটা সেভাবে আর জিজ্ঞেস করেনি – সঙ্কোচ বোধ করত হয়ত – আর জিজ্ঞেস করার প্রশ্নও রইল না।
ক্ষমা করে দিও 🙏…বুঝিনি আমিও 💔 ভালো থেকো বন্ধু 💝