রাজ্যবর্ধনের মহাপ্রয়াণের পরে ছয়মাস অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। পুষ্যভূতির রাজসিংহাসনে হর্ষবর্ধনের অভিষেক, তাঁহার ইচ্ছানুযায়ী নিতান্ত অনাড়ম্বরভাবে সংঘটিত হইয়াছে।
অকালমৃত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার অনুজ আদিত্যবর্মা হর্ষের মিত্রতা এবং বশ্যতা উভয়ই স্বীকার করিয়া লইবার পরে মৌখরীরাজ্যের স্বতন্ত্র শাসক হইতে নিতান্ত অনাগ্রহী হইয়াছিলেন। অতঃপর সমগ্র মৌখরী সাম্রাজ্য পুষ্যভূতি রাজত্বের সহিত যুক্ত হইয়াছে এবং হর্ষবর্ধন তাঁহার রাজধানী স্থানীশ্বর হইতে কান্যকুব্জে স্থানান্থরিত করিয়াছেন।
কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা নির্বিঘ্নে আপন রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। হূণগণ গান্ধার প্রদেশের বাহিরে আসিয়া আর পুষ্যভূতি সাম্রাজ্য আক্রমণের দুঃসাহস করে নাই। সেনাপতি ভণ্ডী, পূর্বতন গুপ্তসম্রাট মহাসেনগুপ্তের পুত্র তথা বর্তমান পুষ্যভূতিরাজ্যের মহামন্ত্রী মাধবগুপ্ত, রাজ্যবর্ধনের প্রিয় বয়স্য দণ্ডাধিনায়ক ভূষণবর্মার কৌশলী পরামর্শ এবং সদাসতর্ক পরিচালনায় রাজ্যের পঙ্কনিমজ্জিত রথচক্র পুনরায় ঘূর্ণায়মান হইয়াছে।
তথাপি পরমভট্টারক সম্রাট হর্ষবর্ধনের মনে স্বস্তি ফিরিয়া আসে নাই।
তাহার মূল কারণ দুইটি।
প্রথমত, বিগত কয়মাসে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের পক্ষ হইতে কোনও আক্রমণসঙ্কেত বা ষড়যন্ত্রের আভাসমাত্র পুষ্যভূতি গূঢ়পুরুষদের জ্ঞাত হয় নাই। চিরশত্রুর হিরণ্ময় নীরবতা এতই অস্বাভাবিক, যে হর্ষের হৃদয়াকাশ সর্বদাই প্রবল সংশয়ের মেঘে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিত। তাঁহার অজ্ঞাতসারে চতুর বাঙ্গালী অন্তরালে বসিয়া কোন নূতন কূটকৌশলের মাধ্যমে না জানি কত কুটিল চক্রান্ত করিতেছে! অজানিতের আশঙ্কায় নবীন রাজা সর্বদা তটস্থ হইয়া থাকিতেন।
হর্ষের মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যের দ্বিতীয় কারণটি পারিবারিক।
ভগ্নহৃদয় রাজ্যশ্রী প্রতিনিয়ত আপন দুর্ভাগ্যকে দায়ী করিয়া হৃতস্বাস্থ্য হইতেছেন। তাঁহার দেহবল্লরী কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীয়মানা শশিকলার তুল্য দিন দিন কৃশ হইতেছে। তিনি কোনওদিন সামান্য আহার গ্রহণ করেন, কোনওদিন উপবাসে থাকেন। রাজ-অবরোধে তাঁহাকে শাসন করিবার কেহ নাই, দাসীগণ তাঁহাকে সমীহ করিয়া চলে — তাহারা বড়জোর উপরোধ করিতে পারে, তাঁহার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিবার শক্তি বা দুঃসাহস দাসীদিগের নাই।
একদিন মধ্যাহ্নে মহারাজ হর্ষ রাজান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, তাঁহার আদরিণী ভগিনী মুষ্টিভর শাকান্ন দিয়া ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। পার্শ্বস্থিত রৌপ্যস্থালীতে নানাবিধ আহার্য সজ্জিত রহিয়াছে, রাজ্যশ্রী দৃকপাত না করিয়া দাসীকে তাহা ফিরাইয়া লইবার আদেশ করিলেন।
হর্ষ ব্যথিত হইয়া কহিলেন — “এইরূপ সামান্য পরিমাণ খাদ্যগ্রহণ করিয়া তুমি কতকাল জীবনধারণ করিবে ভগিনী? তোমার দেহ শীর্ণ হইতেছে, গাত্রবর্ণ পাণ্ডুর, দিনে দিনে তুমি হীনবল হইতেছ, আর তো চাহিয়া দেখিতে পারি না।”
রাজ্যশ্রী ক্লান্ত ক্ষীণস্বরে বলিলেন — “আপনি বৃথা চিন্তা করিতেছেন রাজন! আমি সুস্থ আছি। ভাগ্যদোষে মাতা, পিতা, স্বামী, পিতৃতুল্য অগ্রজ সকলকে হারাইয়া যতটা সুস্থ থাকা সম্ভব, তাহার অধিক সুস্থ আছি।”
হর্ষ বুঝিলেন, ভগিনীর মর্মবেদনা অসহ হইয়াছে, নচেৎ এমন মর্মান্তিক করুণ বাক্য কোনও রাজকুমারী কেন উচ্চারণ করিবেন?
তিনি ব্যথিত হইয়া কহিলেন –“কেন এমন ভাবিতেছ? সেই দৃষ্টিকোণে তো আমিও মাতা, পিতা, ভ্রাতাকে হারাইয়াছি — আমার অন্তর্বেদনা তোমার তুলনায় কোনও অংশে ন্যূন নহে। তাহা বলিয়া প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করিতে তো পারি না — আত্মাকে ক্লেশ দিয়া কি সিদ্ধিলাভ হইবে রাজ্যশ্রী?”
রাজ্যশ্রী পূর্ববৎ শ্রান্তকণ্ঠে বলিলেন –“আমার জীবনে কল্পান্ত সেইদিন আসিয়াছিল মহারাজ, যেদিন স্বামীর রক্তাক্ত মৃতদেহ চাক্ষুষ করিয়াছিলাম। এক্ষণে আমার নশ্বর শরীর কেবল চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে, ছয়মাস পূর্বেই আমার হৃদয়ের মরণ হইয়াছে” — তাহার পরে একটু বিরতি লইয়া ধীরে ধীরে কহিলেন — “অনুজার প্রতি স্বাভাবিক মমত্ববশত আপনি ভাবিতেছেন আমি ইচ্ছা করিয়া খাদ্যগ্রহণ করিতেছি না, কিন্তু ইহা অর্ধসত্য। খাদ্যে আমার রুচি নাই। বহুকাল যাবত আমার ক্ষুধাবোধ লোপ পাইয়াছে।”
বয়োজ্যেষ্ঠা দাসী হিমদত্তা অকুস্থলে উপস্থিত ছিল। সে সাহস করিয়া অগ্রবর্তী হইয়া কহিল –“হাঁ মহারাজ। দেবী সত্য কহিতেছেন — তাঁহার ক্ষুধামান্দ্যের প্রকোপ প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাইতেছে, আমিষ নিরামিষ কোনও আহার্যগ্রহণেই তাঁহার বিশেষ প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায় না।”
হর্ষ উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। উত্তেজিত স্বরে তিনি হিমদত্তাকে উদ্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন — “এতদিন সংবাদ দাও নাই কেন? কঞ্চুকীকে শীঘ্র উপস্থিত হইতে বলো”।
রাজার আহ্বানে অন্তঃপুরের কঞ্চুকী আসিয়া উপস্থিত হইলে, তিনি রাজবৈদ্য পাণ্ডুদাসকে তাঁহার সমীপে দ্রুত আনয়ন করিবার আদেশ দিলেন।
এইবার রাজ্যশ্রী যখন কথা বলিলেন, তাঁহার কণ্ঠ কিছু কঠিন শুনাইল।
তিনি দৃঢ়স্বরে বলিলেন — “ক্ষমা করিবেন রাজন, অন্তঃপুরে রাজা ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষ-প্রবেশের অনুমতি দিতে আমি অক্ষম। ইহা ব্যতীত আরও একটি আপত্তির কারণ রহিয়াছে। কোনও পুরুষ বৈদ্য আমার চিকিৎসা করিবে, ইহাতে আমি সম্মত নহি।”
রাজা হতাশ হইয়া কহিলেন –“এ কি বিড়ম্বনায় ফেলিলে ভগিনী? এক্ষণে নারী চিকিৎসক কোথায় পাইব?”
হিমদত্তা হর্ষের কিছু নিকটে আসিয়া হ্রস্বকণ্ঠে কহিল — “কান্যকুব্জের কথা বলিতে পারি না মহারাজ। তবে এক নারীর কথা শুনিয়াছি, স্থানীশ্বর নগরীর দক্ষিণপ্রান্তে তাহার বাস। উত্তম চিকিৎসক বলিয়া তাহার খ্যাতি ছিল।”
হর্ষ অবজ্ঞাভরে কহিলেন –“হয়তো প্রসবে সাহায্যকারিণী কোনও ধাত্রী অথবা মন্ত্রসিদ্ধা দেয়াসিনী হইবে! আমার ভগিনীর ধাত্রী নহে, চিকিৎসকের প্রয়োজন।”
হিমদত্তা তথাপি কহিল — “সেই নারী পিশাচসিদ্ধা দেয়াসিনী নহে, রীতিমতো চিকিৎসা করিয়া থাকে রাজন! তাহার পিতা ধন্বন্তরী বৈদ্য ছিলেন — কন্যাটি ভেষজবিদ্যার শিক্ষায় পারদর্শিনী বলিয়া শ্রবণ করিয়াছি।”
হর্ষ কিছু বিস্মিত হইলেন। তাহার পরে গাত্রোত্থানপূর্বক ভগিনীর নিকট বিদায় লইলেন।
সেই রাত্রে রাজপ্রাসাদে আপন বিশ্রামকক্ষে উপবিষ্ট হইয়া রাজা হর্ষবর্ধন মহামন্ত্রী মাধবগুপ্তকে স্থানীশ্বর হইতে হিমদত্তা উল্লিখিত বৈদ্যকন্যার সন্ধানপূর্বক তাহাকে কান্যকুব্জে আনয়নের যথাবিধ ব্যবস্থা করিবার আদেশ করিলেন।
দীপান্বিতার কান্যকুব্জে আগমনের অনধিক দুই সপ্তাহ পরের কথা।
স্বল্প হইলেও রাজকুমারী রাজ্যশ্রীর ক্ষুধাবৃদ্ধি হইয়াছে। মৃগমাংস স্পর্শ না করিলেও তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলাহার করিতেছেন, শীতল তক্রপানেও তাঁহার অরুচি কথঞ্চিৎ দূরীভূত হইয়াছে।
দীপান্বিতা কেবল উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসায় বিশ্বাসী ছিল না, তাহার পরিচর্যা পদ্ধতি কিছু ভিন্ন প্রকৃতির — সে সম্ভাব্য রোগীর মনোজগতের সহিত নিবিড় সম্বন্ধ গঠন করিয়া চিকিৎসা করিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করিত। ইহাতে যেমন ঔষধ সেবন করাইতে সুবিধা হয়, তেমনই বৈদ্য এবং রোগীর মধ্যে বিশ্বাস গাঢ় হইবার ফলে রোগীর দেহে ভেষজের কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, আরোগ্য ত্বরান্বিত হয়। ইহা সে তাহার ধন্বন্তরী পিতার নিকট শিখিয়াছিল।
সুতরাং অনুমান করা কঠিন নহে, যে দেবী রাজ্যশ্রীর ক্ষুধামান্দ্যের উপশমে অশ্বগন্ধা, বিদরী, পিপ্পলী প্রভৃতি ভেষজ ব্যতিরেকে দীপান্বিতার স্নিগ্ধ, মধুর সাহচর্যেরও যথেষ্ট অবদান ছিল।
একপক্ষকাল রাজ্যশ্রীর সঙ্গ করিয়া দীপান্বিতা বুঝিয়াছিল, বৌদ্ধধর্ম তাঁহাকে প্রবলরূপে আকর্ষণ করিয়াছে — তিনি উক্ত ধর্মে দীক্ষিত হইতে আগ্রহী।
অন্তঃপুরে বাস করিয়া রাজ্যশ্রীর পরিচর্যা করিলেও, দীপান্বিতা স্বাধীনভাবে রাজ অবরোধের বাহিরে অবলীলায় যাতায়াত করিত। রাজনির্দেশে কেহ তাহাকে কোনওরূপ বাধা দেয় নাই।
একদিন একটি ভেষজের সন্ধানে নগরীর বিপণি অঞ্চলে ঘুরিয়া দীপান্বিতা সংবাদ সংগ্রহ করিল যে নালন্দা মহাবিহারের আচার্য শীলভদ্র এবং জনৈক বিদেশী পরিব্রাজক ভিক্ষু পুষ্যভূতিরাজের সহিত সাক্ষাতের অভিলাষে কান্যকুব্জে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।
সে স্থির করিল, মহাস্থবির শীলভদ্রের সহিত দেবী রাজ্যশ্রীর সাক্ষাৎ যাচ্ঞা করিয়া রাজা হর্ষবর্ধনের নিকট আপন প্রার্থনা ব্যক্ত করিবে।
ধারাবাহিক বিষণ্ণতা সুস্বাস্থ্যের অনুকূল নহে। শীলভদ্রের মুখনিঃসৃত বুদ্ধের করুণাবাণী শ্রবণ করিয়া রাজ্যশ্রীর বিষাদসিঞ্চিত হৃদয়ে যদি নূতন আশার সঞ্চার হয়, তবে তাঁর জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পাইবে, দেহেও নূতন বলের সঞ্চার হইবে, এমত আশা করা অন্যায় হইবে না।
অতঃপর, রাজান্তঃপুরে আচার্য শীলভদ্রকে আমন্ত্রণের আবেদন লইয়া একদিন পূর্বাহ্নে দীপান্বিতা রাজা হর্ষবর্ধনের দর্শনভিক্ষা করিয়া মন্ত্রণাকক্ষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল।
কিছু পরে দ্বারপাল তাহাকে রাজার সমীপে আনিয়া উপস্থিত করিল। নতমস্তকে রাজাকে অভিবাদন জানাইয়া দীপান্বিতা হর্ষবর্ধনের মুখপানে চাহিল।
সমগ্র পারিপার্শ্বিক মুছিয়া অপূর্ব জ্যোতির্বলয় বেষ্টিত একখানি অপরূপ মুখচ্ছবি তাহার সম্মুখে জাগ্রত হইয়া উঠিল। অগ্নিসম্ভূত! পরমেশ্বরের স্বহস্ত অঙ্কিত মঙ্গলচিহ্নের স্বাক্ষর বহনকারী সেই প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসা, করুণাঘন আয়তাক্ষের সহিত দীপান্বিতার পুনর্পরিচয় ঘটিল। অনাস্বাদিত প্রীতির আবেশে তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া গেল। পুষ্যভূতি রাজ্যের সমস্ত প্রজার ঐহিক কল্যাণের আকর এই বলিষ্ঠ নৃপতির সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার সামান্য নারীহৃদয়ের দুই কূল যেন বিপুল প্রেমের প্লাবনে ভাসিয়া গেল, সে কোনওমতেই আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, রাজার পদপ্রান্তে ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল।
যখন বাহ্যজ্ঞান ফিরিয়া আসিল, দীপান্বিতা শুনিল হর্ষবর্ধন কহিতেছেন —
“তুমি সুদক্ষা বৈদ্য বটে — আমি ভগিনীর স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করিয়া প্রীত হইয়াছি।
যাহা তোমার প্রাপ্য বলিয়া বিবেচনা করো, স্বচ্ছন্দে তাহা যাচনা করিতে পারো। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই।”
দীপান্বিতা সকৌতুকে উত্তর করিল — “যাহা চাহিব, তাহাই দিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন মহারাজ? পারিবেন কি?”
হর্ষবর্ধনের ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হইল। নারীর পারদর্শিতা স্বীকার করিতে তাঁহার কুণ্ঠা নাই, কিন্তু তাহার অলজ্জ প্রগলভতা তিনি সহ্য করিতে পারেন না।
তিনি গম্ভীরকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন — “নিতান্ত অপ্রাপ্য বস্তু না হইলে তোমার আবেদন অবশ্যই অনুমোদিত হইবে।”
দীপান্বিতা রাজার ক্ষোভ অনুমান করিয়াছিল, এক্ষণে দণ্ডায়মান হইয়া করজোড়ে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে কহিল — “বাচালতা ক্ষমা করিবেন রাজন! আমি আপনার নিকট রাজ্যের হিন্দু বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকল ধর্মাবলম্বী প্রজার স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার প্রত্যাশা করি। অকারণ পশুহত্যা, রাজ্যরক্ষার প্রয়োজন ব্যতীত নিরর্থক যুদ্ধবিগ্রহ যেন চিরতরে বন্ধ হয়। ত্রিভুবনেশ্বর তাঁহার কোনও সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না — তিনি সকলেরই পিতা। আপনি সেই মহাকারুণিক জগৎপিতার সাক্ষাৎ প্রতিভূ, রাজা। আপনার রাজত্বে সকল জীবের, মনুষ্য, পশু, পক্ষী — সকলের সুস্থভাবে বাঁচিবার অধিকার আপনি সুনিশ্চিত করুন। নিরন্ন যেন আহার পায়, অসুস্থ যেন চিকিৎসা পায়, মুমূর্ষু জীব যেন মরিবার পূর্বে অন্তিম সেবা পায়, আপনার নিকট এইমাত্র প্রার্থনা রহিল। দেবী রাজ্যশ্রীর অসুস্থতার সফল পরিচর্যায় এইটিই আমার কাম্য একমাত্র পারিশ্রমিক।”
হর্ষবর্ধন নির্বাক হইয়া শুনিতেছিলেন। দীপান্বিতার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন পার্থিব মন্ত্রণাকক্ষের অভ্যন্তরে অপূর্ব, অবাস্তব এক মায়াজাল সৃষ্টি করিতেছিল।
রাজা আশ্চর্য হইয়া এই অদ্ভুত রমণীকে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করিতেছিলেন। ধীরে ধীরে হর্ষের চক্ষে তাঁহার চারিপাশের পার্থিব জগৎ অস্পষ্ট হইয়া গেল। তিনি সতৃষ্ণ নয়নে এই ব্যক্তিত্বময়ী, সাধারণদর্শনা, ধীময়ী রমণীর স্নেহকোমল মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। ইহার বচনে যেন সুধা বর্ষিত হইতেছে। অপরদিকে দীপান্বিতাও তাহার অন্তরের ঈশ্বরকে প্রাণ ভরিয়া প্রত্যক্ষ করিতেছিল — অদ্য তাহার কোনও কুণ্ঠা, লজ্জা, সংশয় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
উভয়ের দৃষ্টিতে এক যেন অপরূপ অদৃশ্য সেতুবন্ধ রচিত হইয়া গেল।
অষ্টাদশবর্ষীয় তরুণ সম্রাট একজন একবিংশতিবর্ষীয়া কৌলীন্যহীন, অসবর্ণা নারীর নিকট আপন হৃদয় হারাইলেন।
অনেকক্ষণ পরে ঈষৎ স্খলিত স্বরে হর্ষ প্রশ্ন করিলেন — “তোমার নাম কি?”
সুমিষ্টকণ্ঠে উত্তর আসিল — “রাজাধিরাজ, আমার নাম দীপান্বিতা।”
হর্ষবর্ধন স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় কহিলেন — “না, তোমার নাম দীপান্বিতা নহে। স্মরণ রাখিও, অদ্য হইতে তুমি রত্নাবলী।”
(ক্রমশ)