মনোরোগের ডাক্তারের কাজ তো মানুষের জীবন আর জীবনের গল্প নিয়েই, সেই গল্পগুলোই একসাথে সাজিয়ে লিখে রাখবো ভাবছি….এই গল্পটা আমার PG-র সময়ের গল্প, তখন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ-এ পিজি করছি…. একদিন OPD -তে –
– কে রুগী?
– এই যে ম্যাডাম ইনি। আমার স্ত্রী।
– কতদিনের অসুখ?
– তা ম্যাডাম চোদ্দ বছর দেখাচ্ছি! একবার স্ট্রোক-এর মত হয়েছিল, তারপর থেকেই এরকম।
– এখন কেমন আছেন?
– ওই তো আগের মতোই, আগে অনেক ভুল বকত, পালিয়ে যেত, আরো কত কি করত! এখন সেসব নেই, চুপ করে এক জায়গায় বসেই থাকে, কথা বলে না!
-নিজের কাজ নিজে করতে পারেন? স্নান করা, জামাকাপড় পড়া ইত্যাদি।
-না, সেসব কিছু পারেনা, সবই আমায় করে দিতে হয়। দেখুন না খাওয়া টা একদম কমে গেছে, চেহারাটা কেমন দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আপনি দেখুন!
-আচ্ছা অসুখটা শুরু হওয়ার আগে কেমন ছিলেন? তখন সব করতে পারতেন?
-হ্যা, তখন তো একদম ভালো। এই মানুষটার সাথেই তো কতদিন সংসার করলাম….!
-আচ্ছা, আপনি রুগী কে ওই চেয়ার টায় বসিয়ে, একটু অপেক্ষা করুন, আপনার রুগীকে একবার, পাশের ঘরে sir কে দেখাব, ভীড়টা একটু ফাকা হোক। বসুন।
এরপর ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীকে চেয়ারে বসিয়ে, তার হাতটা ধরে, মাটিতে বসে রইলেন, পাছে যদি পড়ে যান উনি! দেখলাম, মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, বেশীরভাগই যার একতরফা কথা, উত্তর নেই! মহিলা বসে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে চোখ মেলে!!
খুব সাধারণ এক দম্পতি!!!
এই চৌদ্দ বছর, এই মানুষটি প্রত্যেক মাসে স্ত্রীর ওষুধ নিতে আসেন! কখনও তাকে সঙ্গে নিয়ে, বা কখনও একা! প্রতিদিনকার দেখাশোনা, যত্ন, খাওয়ানো! ঠিক একটি শিশুর মতই ওনার পরিচর্যা করতে হয়!! অথচ কোন অভিযোগ নেই, বিরক্তি নেই!! এতোদিনে এটুকু বুঝেছেন, উনি আগের অবস্থায় আর কখনই ফিরে যাবেন না। তাই ওনার খুব সামান্য দাবি, “না খেলে শরীরটা যে আরো খারাপ হয়ে যাবে, একটু কিছু এমন ওষুধ দিন না,যাতে খিদে হয়, যেন একটু খাওয়াতে পারি! “
“ভালোবাসা” মানে কি??
ওরা Valentine’s day-র নাম শোনেনি , কিন্তু ওরা “ভালোবাসা” মানে জানে!!!
না, Candle light dinner নয়, Archie’s এর gift নয়, Valentine’s Day-র Date নয়…. !!
ভালোবাসার মানে, হাতের উপর রাখা এমনই একটি বন্ধুত্বের হাত, চিরকালীন বন্ধুত্বের বন্ধন…..!!!
“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহয নয়, সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয় “– হ্যা, হয়ত সহজ নয়, তবু আছে, আজও আছে…. 