- গতকাল ছেলেটার সাত নম্বর অপারেশনের সেলাই কাটলাম। আঠেরো বছর। ছিপছিপে। চৌকো মুখ। উজ্জ্বল চোখ।
যদিও পরপর অপারেশনের ধাক্কায় এবং তার আগে দুর্ঘটনার আতঙ্কে- চোখের উজ্জ্বলতা ম্রিয়মান। যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট করে ভর্তি হয়েছিল- মাথায় চোট, খুলিতে রক্ত জমাট, চোয়াল ভাঙা, ডান কাঁধের হাড় ভাঙা, কব্জির হাড় ভাঙা, হাতের আঙুলের হাড় ভাঙা, পায়ের পাতা ভাঙা, কলার বোন ভাঙা। পাঁজরের চারটে হাড় ভাঙা – সঙ্গে বুকের মধ্যে রক্ত জমে ছিল।
এইসব ভয়ঙ্কর চোট হয়েছিল মোটরবাইক দুর্ঘটনায়। নিছক দুর্ঘটনা, নাকি স্টান্টবাজি- জানি না। দুর্ঘটনার সংখ্যার বিচারে আমরা, অর্থোপেডিক সার্জেনরা, যত দুর্ঘটনার ফলাফলকে মোকাবিলা করি- তার অন্ততঃ আশি শতাংশ বাইক থেকে উদ্ভূত।
আমরা এখানে যাকে বাইক বলি, সেটা আসলে মোটরবাইক। ইউরোপ-আমেরিকায় ‘বাইক’ বলতে ‘বাইসাইকেল’ বোঝায়। এই তথাকথিত ‘বাইক’ বা ‘মোটরবাইক’ বা ‘মোটরসাইকেল’-এর ধারণাটা এসেছিল প্রাচীনকালের ঘোড়সওয়ার থেকে।
দ্রুতগামী হতে গিয়ে মানুষ ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমে শিকার, মাল পরিবহন, তারপর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধ – সবেতেই শত্রুদমনে শুরু হল ঘোড়ার ব্যবহার। শত্রুর থেকে দ্রুততর হতে হবে- এই হচ্ছে টেকনিক। পৃথিবীর প্রতিটি সৈন্যবাহিনীতে একটা করে ঘোড়সওয়ার বাহিনী থাকত। তারা শত্রুর এলাকায় আরো দ্রুত প্রবেশ করে যুদ্ধজয়, রাজ্যবিস্তার, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ এসবে পারঙ্গম হয়ে উঠল।
এরপর এল মধ্যযুগীয় নাইট। এশিয়াতে মঙ্গোলিয়ার প্রান্তরে উদিত হল ভয়ানক চেঙ্গিস খান। সে তার সম্পূর্ণ সৈন্যবাহিনী ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিল। তার কোনো পদাতিক বাহিনী বা নৌবাহিনী ছিলই না। বলা হত, মঙ্গোলরা ঘোড়ার পিঠেই জন্মায়, ঘোড়ার পিঠেই মরে।
চেঙ্গিসের এই ঘোড়সওয়ার সৈন্যবাহিনী ১২ এবং ১৩ শতকে এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে দেশে দেশে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ স্থল সাম্রাজ্য- হ্যাঁ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা মাথায় রেখেই বলছি। কোরিয়া থেকে হাঙ্গেরি- বাল্টিক থেকে প্যাসিফিক।
তারা শুধু যে যুদ্ধ করেছে তা-ই নয়, ইউরোপের দেশে দেশে পৌঁছে দিয়েছে চীনের রেশম, পোর্সেলিন, কাগজ আর বারুদ। এশিয়া থেকে ইউরোপ- তৈরি হয়েছিল বাণিজ্যপথ-সিল্করুট। জি’য়ান-কাশগর-খোরাসান-তুর্কমেনিস্তান- বাকু হয়ে।
ঘরের কাছে এতকিছু ঘটলেও ভারতবর্ষ কিন্তু প্রথম দিকে এই যজ্ঞে ছিল অনুপস্থিত। কারণ দুটো। এক, উত্তুঙ্গ হিমালয়। দুই, ভারতবর্ষের গাঙ্গেয় অববাহিকা কোনদিনও ঘোড়ার স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষেত্র ছিল না।
হ্যাঁ, ঘোড়া ছিল ভারতবর্ষেও। সিন্ধু সভ্যতার পর থেকে। তবে তা কখনই স্তেপ, মধ্য এশিয়া বা আরবী ঘোড়ার মত তেজী নয়। তাই ভারতবর্ষ বার বার পদানত হয়েছে ঘোড়ার ক্ষুরের নীচে, গতির পিছে।
মধ্যযুগের শেষে রেনেসাঁ। ইউরোপে যন্ত্রসভ্যতা এল। রথ বদলে গেল মোটরগাড়ীতে। ঘোড়া হল বাইসাইকেল। তারপর মোটর সাইকেল।
ভারতে ভাল ঘোড়া জন্মায় না- কালে কালে এই খামতি আমরা ঢেকে দিয়েছি টু-হুইলার আর মোটর বাইক দিয়ে। ভারতবর্ষ এখন পৃথিবীর বৃহত্তম টু-হুইলার প্রস্তুতকারক এবং বাজার। ঘোড়ার ক্ষুরের নীচে পৃথিবী পদানত করে ইতিহাসের দিক নির্দেশ করতে না পারি, আমাদের দিগ্বীজয়ী বাইক বাহিনী – দিকে দিকে ধূলো উড়িয়ে ভোটলুঠ, দাদাগিরি, বোমাবাজি, দাঙ্গা, ডাকাতি, গণধর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ময়দানে দখলদারি কায়েম করেছে। এটাই বা কম কি!
দেখ, কোত্থেকে কোথায় চলে এলাম? সেই ধান ভানতে শীবের গীত! বরং নিজের গল্প বলি।
গল্প এক
শনিবার রাত বারোটা। দুটো অপারেশন সেরে বিশ্ববাংলা সরণি বেয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছি। ড্রাইভার বেচারাকে ছেড়ে দিয়েছি। তার তো আর ডাক্তারদের মত পাপগ্রহে জন্ম নয়! সে সপ্তাহান্তে বৌ-বাচ্চার সাথে দুটো শাকভাত খাবে- তাতে বাধা দিই কেন!
উইপ্রো-র সামনের ফ্লাইওভারটা রাত এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে নীচে দিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছি। এমন সময় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ দুজন আমাকে ঈশারায় ডাকল। রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ। আস্তে আস্তে ব্যারিকেড খুলে দিল।
‘যান।’
‘আমি ভাবলাম, ফ্লাইওভার বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘বন্ধ। তবে তা বাইকের জন্য।’
‘তার জন্য এত ওয়াটার টাইট ব্যারিকেড?’
‘এরকম ওয়াটার টাইট না করলে বড়লোক বাবা-মায়ের উচ্ছন্নে যাওয়া হার্লে ডেভিডসন, বুগাতি আর এনফিল্ডের ধাক্কায় সকালে আর জ্যান্ত বাড়ি ফিরতে পারব না !’
গল্প দুই
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বাইক। ফিমার বোন ভাঙা। অপারেশন করছি।
রুক্ষ গলা। ‘ভাল করে অপারেশন করুন। তাড়াতাড়ি হাড় জোড়ার ব্যবস্থা করুন। পরীক্ষার পরে যেন বাইক চালাতে পারি!’
শীতল হুমকি দিচ্ছে ‘পেট টিপলে তখনো অন্নপ্রাশনের ভাত বেরোয়’- এমন কচি ছেলে। হুমকি আমার খুব বিরক্ত লাগে – বিশেষতঃ ক্ষমতাহীনের হুমকি।
‘অপারেশনের পরে একটু সুস্থ হলেই তোকে পুলিশের হাতে দেব।’
ছেলেটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘কেন, আমি কি করলাম।’
‘আঠেরো বছরের আগে বাইক চালিয়েছিস কেন?’
বাবা দুবাই-তে চাকরি করে। অঢেল রোজকার। আল্লে আদর দিয়ে পনেরো বছর বয়সে ছেলেকে বাইক কিনে দিয়েছে! মা আর মামাকে বুঝিয়ে সেই বাইক বিক্রি করিয়ে তবে রোগীকে অশোকনগরের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম- মনে আছে।
গল্প তিন
স্লিপ ডিস্ক। সার্জারি করেছি। পরদিন সকালে রাউন্ডে।
‘ডাক্তারবাবু কবে থেকে বাইক চালাতে পারব?’ কবে থেকে হাঁটতে শুরু করব- এ প্রশ্ন নয়! কবে থেকে বাইক চালাতে পারব?
বললাম, ‘মায়ের পেট থেকে যখন বেরিয়েছিলি, তখন পেছনে কি বাইক লাগানো ছিল?’