আমাদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের indoor-এ তিনজন মানুষ ছিলো, হয়তো সব সরকারি হাসপাতালেই এমন কিছু মানুষ আছেন, জীবনের প্রবাহে ভাসতে ভাসতে যে মানুষগুলো psychiatry ward-এ এসে পৌঁছেছিলেন… তারপরে থেকে গিয়েছেন বহু বছর! আমাদের বর্ধমানের ওয়ার্ডেও এমন তিন জন ছিলেন! আজকে তাদের গল্প লিখবো!
একজনের বুদ্ধি একদমই বাচ্চাদের মতন… আর সেই ছিলো সবচেয়ে মজার… মেহের-কে (নাম- পরিবর্তিত, অথবা ওর আসল নাম আমরা কেউ জানিনা ) আমি ভালোবেসেই ফেলেছিলাম, ওর চেয়ে সরল ভাবে আমি আর কাউকে হাসতে দেখিনি… যখন প্রথম পিজি করতে ঢুকলাম, পায়ে একটা বড়ো non-healing ulcer, বহুবার dressing করেছি, সেও বহুবার বাথরুমে গিয়ে পা-ভিজিয়ে, সেই ড্রেসিং নষ্ট করেছে! আবার আমরা “এবার কিন্তু পা কেটে ফেলবো তোমার” বলে ভয় দেখিয়ে আবার ড্রেসিং করেছি! এই প্রক্রিয়া ছয় মাস মতন চললো!! কিন্তু ওই ব্যথা নিয়েও সে রাউন্ডের সময় বড়ো সরল ভাবে হাসতো… কখনো কখনো অবশ্যই অদ্ভুত জিনিসের বায়না করে কান্নাকাটিও করতো… এই যেমন উৎসবের আগে সব রুগীর বাড়ি যাওয়া দেখে, সে একদিন বায়না করলো, “আমি বাড়ি যাবো, আমার দাদা এসেছে “… সেই কান্নার চোটে এক একসময় রাতের সিস্টার দিদির ঘুমের বারোটা বেজে যেত! রাউন্ডে গিয়ে ওকে পাত্তা না দিলেই বিরক্ত করতো! সব রুগী দেখার আগে অবশ্য ওর সাথে একটু গল্প করলে, আর বিশেষ বিরক্ত করতো না! একদিন বিকেলে একটু সেজেগুঁজে রাউন্ডে গিয়েছিলাম, সে ঠিক খেয়াল করেছে, “ও দিদি, আজ সেজে এসেছো যে, তোমাকে সেই লাগছে”
আরেকজনের নাম ছিলো ফারাহ… শুনেছি সে সবচেয়ে পুরোনো আবাসিক… ওর জীবনের গল্প আমার ভাসা ভাসা শোনা, পুরোটা জানা থাকলে হয়তো আরেকটা বড়ো গল্প হয়ে যেত… কিন্তু সে গল্প আমার সম্পূর্ণ জানা নেই… বছর চল্লিশের মেয়েটা ওয়ার্ডে থাকতে থাকতে সবার প্ৰিয় হয়ে গিয়েছিলো… ওর TB ধরা পড়লো, বেশ কিছুদিন অসুস্থ… ওর কাগজপত্র নিয়ে Chest এ গিয়ে কথা বলে এলাম… ওদের তো বাড়ির লোক নেই, আমরাই বাড়ির লোক! এরপরে সমস্যা হলো সে কিছুতেই TB-র ওষুধ খাবেনা… প্রতিদিন সিস্টার, GDA দাদা সবার অনেক তোয়াজ করে তাকে ওষুধ খাওয়াতে হয়… আমাদের, এমনকি ভিসিটিং স্যারদেরও ফারাহকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য ওকে ঘুষ দিতে হয়েছে… “এই দিদি পয়সা দো না “… রাউন্ডে গেলেই ২/৫ টাকার coin ঘুষ দিয়ে ওকে ওষুধ খাওয়ানো হতো!! নইলে সে কিছুতেই ওষুধ খাবে না!!
আর এদের সবার মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, নির্বিবাদী মানুষ সুনীপা (নাম-পরিবর্তিত)। বয়স পঞ্চাশ, রোগা, নির্বিবাদী, চুপচাপ জানলার বাইরে চেয়ে থাকা মানুষ… বেশি কথা বলতো না… সামান্য ডিপ্রেশন ছাড়া বেশি কিছু ছিলোও না… মুঙ্গেরের কোথাও একটা ওর বাড়ি, সে সম্পূর্ণ ঠিকানা বলেছিলো আমাদের, লেখালিখি করে তার বাড়িঘর খুঁজে তাকে বাড়ি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলাম আমরা… হয়তো বছর বছর নতুন PGT-রা একবার করে সেই চেষ্টা করে… কিন্তু না, জীবনের যে প্রবাহে ভেসে সুনীপা আমাদের ওয়ার্ডে এসে পৌঁছেছিলো, আমারা স্রোতের বিপরীতে ভেলা ঠেলে ওকে আবার ওর “বাড়ি” পৌঁছে দিতে পারিনি… পদ্ধতির জটিলতা, বাড়ির লোকের অনীহা, সর্বোপরি বর্ধমান মেডিকেল কলেজের psychiatry ward-এর এক কোনায় পড়ে থাকা নীরব নিরীহ সামান্য সুনীপা-র জন্য এতো ঝক্কি পোহাবে কে??
তবে সুনীপা, ফারাহ, মেহের, ওদেরও নিজেদের জীবন ছিলো, ওরা পরস্পরকে ভালোবাসতো, আর আমরাও ওদের ভালোবাসতাম! সিস্টার দিদিদের বাড়ি থেকে ওদের জন্য special তরকারি এসেছে, পুজোয় চাঁদা তুলে নতুন জামা কিনে দেয়া হয়েছে ওদের জন্য…. এমনকি ওদের জন্য তেল, সাবান এসবের আয়োজন ও করা হতো, সবই সিস্টার দিদিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে…
প্রায়ই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখতাম বিকেলে ঠিক কেউ না কেউ চপ বা ঘুগনি এনে দিয়েছে, কোনোদিন দেখতাম এদের কেউ বায়না করছে, “দিদি একটা মাকড়ি দাও না গো”, কোনোদিন কেউ বলছে, “এ দিদি মোবাইল মে গানা লাগাও না”… ফারাহ যখন TB-র জন্য অন্য ওয়ার্ডে গিয়েছে, মনে হয় এক/দুদিনের জন্য, ওর যখন শরীর ভালো নেই… উদাসীন, কম কথা বলা সুনীপা আমায় এসে জিজ্ঞেস করতো, “ও কব্ আয়েগা? ও কাহা হায়?”
কে বলে ভালোবাসা নেই এই পৃথিবীতে? ভালোবাসা আসলেই খুব অপ্রত্যাশিত জায়গায়, অপ্রত্যাশিত ভাবে বর্ষিত হয়…. যে সিস্টার দিদি ওদের জন্য মনে করে তরকারি নিয়ে আসতেন, যে GDA দাদা ওদের জন্য চপ নিয়ে আসতেন, যে ডাক্তারবাবু পরিবারের থেকে দূরে থাকাকালীন ওদের সাথেই উৎসবের কেক মিষ্টি ভাগ করে নিতেন… তাঁদের কারোর এসব করার কোনো প্রফেশনাল দায় ছিলো না… ছিলো শুধুই ভালোবাসা
জীবনের গল্প