সময়টা একদম ভালো যাচ্ছে না অনিন্দ্যর। জ্বর থেকে উঠতে না–উঠতেই আবার একটা উটকো সমস্যা। আজ দিন পাঁচেক হল নীচের ঠোঁটের ডানদিকে একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে। প্রথমে ফুলে লাল হয়ে চুলকোতে শুরু করেছিল দু’দিন থেকে। কালো হয়ে গেছে জায়গাটা। প্রথমে ভেবেছিল পিঁপড়ে বা পোকা–টোকা কামড়েছে বোধহয়। কিন্তু না, তলপেটেও একটা দাগ হয়েছে একই রকম।
ক’দিন এটা–সেটা লাগিয়ে যখন কোনো লাভ হল না, তখন অনিন্দ্য গেল ডাক্তারবাবুর কাছে। ডাক্তারবাবু মানে ডা মৈনাক গুপ্ত। ত্বক–বিশেষজ্ঞ।
দাগ দুটো দেখলেন ডাক্তারবাবু। প্রথমে এমনি, তারপর ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও দেখে নিলেন একঝলক। তারপর হাসলেন।
কী ওষুধ খেয়েছিলে, অনিন্দ্য? জ্বর হয়েছিল নাকি?
অবাক হল অনিন্দ্য। গোয়েন্দা, না ডাক্তার!
–হ্যাঁ, মানে, ওই পাড়ার ওষুধের দোকানের জহরদা, ও–ই দিয়েছিল জ্বরের ট্যাবলেট। সাদা মতন।
–ওই ট্যাবলেট থেকেই এই গন্ডগোলটা হয়েছে।
–মানে! ওষুধ খেয়ে? এটা ওষুধ থেকে হয়েছে?
-ঠিক তাই অনিন্দ্য। এটা ওষুধ থেকেই হয়েছে। এটাকে বলে ফিক্সড ড্রাগ ইরাপশন। কিছু নির্দিষ্ট ওষুধে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এই উৎপাতটি ঘটে বলে ‘ফিক্সড’ কথাটা বলা।
–কী ওষুধে হয়েছে, ডাক্তারবাবু?
–তোমার ক্ষেত্রে হয়তো সালফা ড্রাগস অথবা ব্যথা কমার স্যালিসাইলেট জাতীয় ওষুধ থেকে হয়েছে। তবে এছাড়া আরও বেশ কিছু ওষুধে হতে পারে এফ. ডি. ই.। যেমন—টেট্রাসাইক্লিন, ব্যথা কমার অক্সিফেনবুটাজোন অথবা ক্লোরডায়জিপক্সাইড, বারবিচুরেট বা ফেনলফথ্যালিন । আবার ক্লোরোকুইন, কুইনিন, এসিটামিনোফেন থেকেও হতে পারে। তবে সবার যে একই ওষুধে হবে, তা কিন্তু নয়।
–তবে কী করব অসুখ করলে? অনিন্দ্যর জিজ্ঞাসা।
–ওষুধ খাবে, তবে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো। কারণ এটা না হয় অল্পের ওপর দিয়ে গেল, ওষুধ খেয়ে বড় ধরনের বিপদও কিন্তু ঘটতে পারে।
–বড় ধরনের বিপদ?
–হ্যাঁ, যেমন ধরো এক্সফোলিয়েটিভ ডার্মাটাইটিস। সারা শরীর জুড়ে চামড়া উঠে গিয়ে বিপদ হতে পারে।
–তাই নাকি! কোন ওষুধে?
–ওষুধ? ওই যা বললাম মোটামুটি তা–ই। এছাড়া পেনিসিলিন, কার্বামাজেপাইন, ক্লোরোপ্রোমাজিন, আয়োডাইন ইত্যাদি।
–আর কী হতে পারে ডাক্তারবাবু ওষুধ থেকে? দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল অনিন্দ্য।
হাসলেন ডা গুপ্ত।
–হতে পারে আরও অনেক কিছু। যেমন ধরো, পেনিসিলিন থেকে হওয়া প্রাণসংশয়কারী অ্যানাফাইল্যাক্টিক রিঅ্যাকশন অথবা আমবাত থেকে অ্যাঞ্জিওইডিমা, ঠোঁট–মুখ ফুলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে। অথবা ধরো, ফোস্কা—সারা গা জুড়ে। এরিথিমা মাল্টিফর্মি থেকে সাংঘাতিক স্টিভেনস–জনসন সিনড্রোম সবই সম্ভব।
মাথা ঝিমঝিম করছিল অনিন্দ্যর।
কী সব নাম, ডাক্তারবাবু!
–হ্যাঁ অনিন্দ্য, শুধু নাম নয়, রোগগুলিও মারাত্মক। তবে আমি কিন্তু তোমাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য এত কথা বলছি না। বলছি তোমাকে সচেতন করতে। সাবধান করতে।
–হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারছি। শুকনো হাসার চেষ্টা করল অনিন্দ্য।
–তারপর ধরো, কিছু ওষুধ খেয়ে হতে পারে ফোটো অ্যালার্জি জাতীয় কিছু অসুখ। ক্লোরথায়াজাইড, ক্লোরপ্রোপামাইড, ন্যালিডিক্সিক অ্যাসিড, সিপ্রোফ্লক্সাসিন খেয়ে ত্বক হয়ে যেতে পারে আলোক বা সূর্য–সংবেদী। চুলকে, লাল হয়ে ফোস্কা পড়তে পারে শরীরের উন্মুক্ত অংশে। কিছু ওষুধে কালো হয়ে যায় গায়ের রঙ। ম্যালেরিয়ার ওষুধ, ক্লোফাজিমাইন, অ্যামিওডারোন এইসব ক্ষেত্রে দায়ী।
–এছাড়া? অনিন্দ্যর উৎসাহ বেড়েই চলেছে।
–আমবাত হতে পারে ব্যথার ওষুধ খেয়ে। অথবা আরও কিছু অন্য ওষুধ থেকে। মুখে ঘা তো হতেই পারে ডাইলানটিন, বিসমাথ, মিথোট্রিক্সেট জাতীয় ওষুধ থেকে। চুলের রঙ বদলে যেতে পারে কার্বামেট, ক্লোরোকুইন বা ক্লোরপ্রোমাজিন থেকে। আবার গ্যাংগ্রিন হতে পারে কুমারিন থেকে।
–গ্যাংগ্রিন? সে তো সাংঘাতিক ব্যাপার, ডাক্তারবাবু! চোখ বড়–বড় হয়ে যায় অনিন্দ্যর।
–তা তো নিশ্চয়ই, তাহলে আরেকটা অসুখের নামও জেনে রাখো। সেটা আরও সাংঘাতিক। তার নাম টক্সিক এপিডার্মাল নেক্রোলাইসিস বা সংক্ষেপে TEN। হাইড্রালাজিন, আইসোনিয়াজিড, অ্যাসিটাজোলামাইড, অ্যালোপিউরিনল, বারবিচুরেট, কুইনিডিন, বোরিক অ্যাসিড পাউডার, কার্বামাজেপাইন, স্যালিসাইলেট, পেনিসিলিন, ফেনাইলবুটাজোন, আসলে এগুলো খুব শক্তিশালী ওষুধ। সাধারণ ফেস–ক্রিম আদৌ নয়। বন্ধুদের বোলো এসব, কেমন?
–হ্যাঁ, ওষুধের দোকানের জহরদাকেও বুঝিয়ে বলতে হবে, এভাবে ওষুধ না দিতে।
–ঠিক তাই, অনিন্দ্য।
–আর ডাক্তারবাবু, আমার ঠোঁটের দাগটা?
–ওটা সেরে যাবে। এই যে তোমাকে ওষুধ লিখে দিয়েছি। আর শুধু এরপর থেকে একটু সচেতন থেকো ওষুধের ব্যাপারে। কোন ওষুধে তোমার অ্যালার্জি সেটা জেনে রাখাই ভালো।
হাসি ফুটল অনিন্দ্যর মুখে।
সচেতনতার হাসি।