উত্তর শহরতলিতে বুড়োদাদুর বাড়িতে থাকাকালীন, পুজো যে আসছে সে কথা বোঝবার উপায় বা বয়স কোনোটাই ছিল না আমার। শুধু পরিষ্কার দিন থাকলে, মানে বৃষ্টিবাদলা না হলে, কোনো একটা রোববার মা আর বাবার হাত ধরে নিউমার্কেটে বাজার করতে যাওয়ার তোড়জোড় আরম্ভ হলেই বুঝতাম, পুজো আসছে।
হগ সায়েবের বাজারের ভিতরে ‘দয়ারামে’র শাড়ির দোকান থেকে মাকে পিওর সিল্ক কিনে দেবে বাবা। আমি বাবার আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখব, মা আগ্রহভরে এক একটা শাড়ি হাতে নিচ্ছে, তারপরেই দামের ট্যাগ দেখে সরিয়ে রাখছে।
আমার উদ্বেগ বেড়ে উঠত ধীরে ধীরে, কিন্তু দেখতাম প্রত্যেকবারই সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েই ফেলতো মা, ঠিক কিনে নিতো একখানা কমদামী পিওর সিল্ক।
‘ছেড়ে দাও, হাতিবাগান থেকে তাঁতের শাড়িই কিনে নিই এবার’ বললে বাবার শ্যামল মুখখানি আরো অনুজ্জ্বল হয়ে উঠবে, জানত নিশ্চয়। তাই আপস করত কি কোথাও? জানার আর কোনো উপায় নেই আজ।
আমার জন্য কিন্তু ফ্রিল দেওয়া পলিয়েস্টারের ফ্রক কেনা হতো ‘ম্যাডাম’ থেকে। মাকে জীবনেও কেনা ব্লাউজ পরতে দেখিনি। বছরে দু’তিনখানি ব্লাউজ হলেও মা তৈরি করাতো সেগুলো। রক্সি সিনেমার ওখানে মফতলালের বড় শো রুমে ঢুকতাম আমরা, ‘মহাদেবীয়া অ্যান্ড মেহতা’। মায়ের ব্লাউজের কাপড়ের দাম চুকোনোর ফাঁকে বাবাকে দেখতাম শার্টের পিসের দরদাম করছে।
মাসতুতো ভাই দুটোর জামা প্যান্টও কেনা হতো নিউমার্কেটের দোকানেই। কিন্তু দিদার সরুপাড় সাদা ধুতি আর দুগ্গাঠাকুরের শাড়ি মা কিনতো শ্যামবাজারের ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি থেকে। তারপর বাগবাজার বাটা থেকে আমার জুতো কিনে, ‘আপ্যায়নে’র চন্দ্রপুলি বাক্সে ভরে আমরা হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে পড়তাম আটাত্তর নম্বর বাসে। সন্ধ্যে ঘন হতে, সে বাসের ভিড়ও পাতলা হয়ে এসেছে তখন।
পুজোয় বাবার তিনদিন ছুটি থাকত। মা অষ্টমীর দিন মামার বাড়ি থেকে দেওয়া তাঁতের শাড়িটি জড়িয়ে নন্দীদের বাড়ি অঞ্জলি দিতে যেত। ফিরে এসে মাংসভাত রান্না করবে। একবার নন্দীদের বুড়োকর্তা ঘোমটাবিহীন মাকে দেখে ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমাকে চেনা চেনা লাগছে, তুমি কাদের বাড়ির গো বৌমা?’
মা সপ্রতিভভাবেই বলেছিল, ‘আমি মন্মথনাথ ব্যানার্জির পুত্রবধূ, ওঁর ছোটছেলের বউ — এই তো তিনটে বাড়ি পরেই আমাদের বাড়ি।’
বুড়োকর্তা ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন — ‘অ, তুমিই সেই কলেজ পাশ মেয়ে বুঝি? তাই বলি, অকাতরে শ্বশুরের নাম মুখে এনে ফেললে, কটুর বউই হবে’।
কটু আমার বাবার ডাকনাম।
মা আর কখনো নন্দীদের বাড়ি পুজো দিতে যায়নি। গাবু চাটুজ্যেদের মস্ত পোড়ো বাড়িটা পেরিয়ে, দত্তদের আমবাগান ছাড়িয়ে, ইলিয়াস রোডে পড়ে, অনেকটা হেঁটে, ছাতাপড়া বাঁড়ুজ্জেদের বাড়ি যেত অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে। ওখানে নবমীর দিন মোষবলি হতো — আমাকে কোনোদিন নিয়ে যায়নি মা। আমি আমাদের পুরোনো ভাড়াটে বিক্রমদা-রূপাদিদের মুখে শুনেছিলাম।
তখন কাছাকাছির মধ্যে লাইব্রেরির মাঠের পুজো ছাড়া আর কোনো বারোয়ারি পুজো ছিল না।
তাই অষ্টমীর সন্ধেবেলা রিকশায় চাপিয়ে বাবা আমাকে এনটিসির মাঠের দুগ্গাঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত।
নবমীতে মামার বাড়ি ওয়েলিংটনে যেতাম। ওখানে পায়ে হাঁটা দূরত্বে অনেক পুজো হতো। বাবা ঘুরিয়ে আনত লেবুতলা পার্ক, জলকল আর কলেজ স্কোয়ার।
আমি হাঁ করে রমেশ পালের তৈরি ঠাকুর দেখতাম — তেজে, দীপ্তিতে, আত্মবিশ্বাসে চকচক করছে মৃন্ময়ী দেবীর চোখমুখ।
মনে মনে তুলনা শুরু হয়ে যেত আমাদের মফস্বলী পাড়ার ঠাকুর আর কলকাতার সিমলেপাড়া আর চালতাবাগানের ঠাকুরের।
মাসতুতো ভাই দীপটু শিখিয়েছিল — ‘গর্জন তেল জানিস তো গুগাদিদি, কুমোরটুলিতে তৈরি ঠাকুরের মুখে ওরা গর্জন তেল মাখিয়ে দেয় — ওইজন্য অত চকচক করে। অসুরটাকে অবধি মাখায় — সবজে রঙটা কেমন ঝকঝক করে, দেখিসনি? শুধু সিংহটাকে মাখায় না। কেশরগুলো নেতিয়ে যাবে না? তাই —‘
আমি দেখতাম, বাড়ির সরকার চুলার আঁচে মা তাওয়ায় অল্প তেলে পরোটা ভাজছে, মটরের ঘুগনির সঙ্গে খাওয়া হবে রাত্তিরে। মায়ের মুখটা বিনা গর্জন তেলেই কেমন চকচক করছে, মায়ের মধ্যেও তো দুর্গাঠাকুর আছে — সব্বার মায়ের মধ্যে থাকে, নয়ত বিসর্জন হয়ে গেলে কি ঠাকুর হারিয়ে যায়? যায় না তো।
দিদার কাছে বিজয়া করতে যাওয়া মানেই চারুর দোকানের কচুরি-তরকারি আর মাতৃভোগ — সেই ভাজা মিষ্টির অনুপম স্বাদ এই বুড়োবয়সেও আমার রসনা ছুঁয়ে রয়েছে।
প্রত্যেকবারই সেই দেবভোগ্য চ্যাপ্টা পান্তুয়া আরেকটা করে চাইতাম আর দিদার আক্ষেপ শুনতাম — “চেরো-টা একেবারে চামার হয়ে গ্যাছে, আর বছরও এর চেয়ে বড় সাইজ ছিল মাত্তিভোগের”।
ছোটমাইমার রান্নার হাত ছিল অপূর্ব। ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’ এর তালে তালে মামার বাড়ির নারকেল নাড়ু আর ঘিয়েভাজা কুচো নিমকির সুবাস এখনো ধাক্কা মেরে ফেরে স্মৃতির দরজায়।
কবে মরেহেজে গিয়েছে আমার সেই স্বর্ণালি শৈশব। আমার বুড়োদাদুর বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। গাবু চাটুজ্যেদের পোড়ো বাস্তুভিটায় এখন সাপ আর তক্ষকের বাস। নন্দীদের বাড়ি সন্ধ্যারতি হয় কি না খবর রাখি না আর। এনটিসির মাঠটাই উবে গিয়েছে। পুজোটাও। হগ মার্কেটে যাই না বহুকাল। ম্যাডাম বা দয়ারাম এখন আর নেই বোধহয়। কিংবা আছে। অন্য কোথাও, অন্য অবয়বে। মামার বাড়িটা দুশো বছরের বংশগৌরব পাঁজরে গেঁথে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনো। দিদা নেই, মামা নেই, মাইমা নেই।
নষ্টচরাচরে এখন শুধুই তিলান্নের ঘ্রাণ। আলোর উৎসব আসছে। আসছে শারদীয়া দুর্গাপূজা। পাড়ায় পাড়ায় ঊর্ধ্বমুখী বাঁশের কঙ্কাল আকাশের দিকে বুভুক্ষুর মতো হাত বাড়িয়ে কাকে যেন খুঁজছে।
আশ্বিনের প্রসন্ন শারদপ্রাতে আলোকমঞ্জীর বাজিয়ে মা আসছেন। তাঁর পরনে শুভ্রবেশ, এলোকেশী মায়ের হাতে বরাভয় মুদ্রা, গর্জন তেল মাখা মুখখানি চকচক করছে তেজে, দীপ্তিতে, আত্মবিশ্বাসে।
কিন্তু কোন শিল্পী চক্ষুদান করেছেন মায়ের? রক্তঝরা চোখেও এতটুকু ম্লান হয়নি তো জ্যোতির্ময়ীর দৃষ্টি!
না, আজ আর ব্যক্তিগতভাবে কিছুই চাওয়ার নেই আমার জগজ্জননীর কাছে।
এই আত্মবিস্মৃত, আত্মঘাতী, নরকপথযাত্রী জাতিকে তরিয়ে দেবার শক্তি যদি তোমার থাকে মা, তাহলে সেই শক্তিকে পূর্ণরূপে বিকশিত করার ক্ষণ এসে গিয়েছে।
‘অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়’
আনন্দম।