আকাশে বাতাসে এখন সাজো সাজো রব। যে কোনো বাঙালির জীবনে সেই আদি অকৃত্রিম দুর্গোৎসবের আকর্ষণ তো আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। তবে এবারের পুজোর আবেদন যেন কেমন মিইয়ে যাওয়া। অন্তত আমার কাছে। মহামারীতে ত্রস্ত মানুষের জীবনে এই পুজো বোধহয় নতুন কোন বার্তা বয়ে আনতে পারলো না।
আজ সকালে হাসপাতালে যাবার পথে দিগন্তবিস্তৃত সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠিক এই কথাই মনে হচ্ছিল। রাসবিহারী কানেক্টরের দুই পাশে বাঁশের লম্বা ব্যারিকেডে ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে ফুটপাত। অ্যাক্রোপলিস মলের চারিধার সেজে উঠেছে মায়ের মুখের ব্যানার আর ফেস্টুনে।
যোগাড় যন্ত্র আজকেই যেন প্রায় শেষ। হিসেব করে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না দুর্গাপুজোর আর ঠিক কতদিন বাকি! নাকি আমাদের মত হাসপাতালে কাজ করা ডাক্তারদের ফেলেই শুরু হয়ে গেছে এইবারে মায়ের উৎসব। পুজো তো সবারই তাই না!
এসব ভাবতে ভাবতেই হোয়াটসঅ্যাপে এক বন্ধুর কাছ থেকে আসা একটা মেসেজ দেখছিলাম। একটি খবরের কাগজের স্ক্রীনশট। সেখানে লিখছে যে আমাদের রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা নাকি বেসরকারি হাসপাতালে নন-কোভিড ডাক্তারদের অনুরোধ জানিয়েছেন তারা যেন পুজোর সময় কলকাতা ছেড়ে কোথাও না যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরো অনুরোধ জানানো হয়েছে যেন সেই সমস্ত ডাক্তারদের ফোন নাম্বার রেখে দেওয়া হয়। তারা আশঙ্কায় আছেন যে পুজো দেখার এই ভিড়ের চাপে হাসপাতালে হাসপাতালে নাকি কোভিডের চাপ অনেক বাড়তে চলেছে পুজোর পর।
ভারি অদ্ভুত লাগলো একথা পড়ে। সবার আগে এটাই মনে হল যদি মহামারী বেড়ে যাওয়ার সত্যিই এত চিন্তা থাকে তাহলে সকলের আগে বারোয়ারী পুজোটা বন্ধ বা নিদেন পক্ষে ছোট করার নির্দেশ দিচ্ছেন না কেন সরকার বাহাদুর?
পুজোতে যে মণ্ডপে মণ্ডপে ভীড় সামলানো যাবে না, আর তার ফলে কোভিড যে অট্টহাসি হাসবে সেটা বোঝার জন্য তো আই এ এস পরীক্ষায় পাশ করার কোন প্রয়োজন নেই। তাই না?
আর এই মূহুর্তে নন-কোভিড বলে তো কোন হাসপাতালেই আর কিছু বাকি নেই। সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার সব কোভিডে মিলেমিশে চাটনি হয়ে গিয়েছে সেই কবেই।
তাছাড়া এই করোনাতে অনেক বেশি সংক্রামিত হয়ে চলেছেন নন কোভিড ডাক্তাররা। অন্তত আমাদের হাসপাতালের স্ট্যাটিসটিকস সেই কথাই বলছে। কাজেই সবাই এখন ফ্রন্টলাইন কোভিড ওয়ার্কার। পাড়ার জেনারেল ফিজিশিয়ান থেকে শুরু করে হার্ট অথবা নিউরোসার্জন কাউকেই কোভিড ছেড়ে কথা বলছে না। তাই সবাইকেই চিকিৎসা করতে হচ্ছে কোভিডের। অন্তত একটা লেভেল অবধি।
আপামর জনসাধারণের মুখের সামনে পুজোর গাজর ঝুলিয়ে পাবলিককে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। অথচ ডাক্তারদের বলছেন আপনারা শহর ছেড়ে যাবেন না। ডাক্তার তথা সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের যে আপনারা মানুষ বলেই গণ্য করেন না এটা তার একটি বড় প্রমাণ।
তবে ডাক্তারদের কথা ছাড়ুন। তাদের শহীদ হওয়া তো এখন জনগণ দিব্যি মেনে নিয়েছে। মিলিটারিও তো যুদ্ধে কত মারা যায়। তাই না। ওইরকম একবার ‘জনগণমন’ গেয়ে দিলেই তো যাবতীয় দায়িত্বের ল্যাঠা চুকে যায়। পাবলিককে তো আর চিকিৎসা করতে যেতে হচ্ছে না!
তবে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়ে মহামারীর চাপ এতটাই বাড়তে পারে যে হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না, এই সমস্ত জেনেও ঢালাও বারোয়ারি পুজায় যে সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চলছে তার ফল কিন্তু ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের শরীর বেয়ে তাদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যাবে ভাইরাস। তাদের মাধ্যমে অসুস্থ হবেন বয়স্করা। বেড বা চিকিৎসা না পাওয়া গেলে মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করবে। হাতের বাইরে চলে যাবে মহামারী। এইসব দ্বিচারিতার কথাই ভাবছিলাম সারাদিন।
হাসপাতালে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিস্টাররা ধীরে ধীরে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া শুরু করেছেন। বিশেষত নর্থ ইস্টের মেয়েরা। প্রায় সাত মাস এই করোনায় দৈনিক প্রাণপণ পরিশ্রম করার পর। তবে এই চলে যাওয়ার কারণ কেউ জানাচ্ছে না। জানি না পুজোর পরে মহামারী চেহারার কথা ভেবে কিনা! অথবা হয়তো কোন হতাশা ঘিরে ধরেছে তাদেরকেও!
এর মধ্যেই একটা ইমার্জেন্সি অপারেশন চলছিল আমাদের। কোভিড টেস্ট পাঠিয়ে থিয়েটারে নেওয়া হয়েছিল রোগীকে। মস্তিষ্কের মধ্যে রক্ত জমে প্রায় অচৈতন্য হয়ে যাওয়া পেসেন্ট।তাড়াতাড়ি অপারেশন করে রক্ত বের না করে দিলে প্রাণসংশয় হতে পারে ভদ্রমহিলার। অপারেশনের শেষের দিকে খবর এলো কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ।
এর আগেও করেছি অনেক ইমার্জেন্সি অপারেশন বিগত সাত মাসে। অনেক রোগী পজিটিভ হয়েছেন অপারেশন করার বেশ কিছুদিন পরে। তবে থিয়েটারে পজিটিভ এই প্রথম। কিন্তু নিয়মমতো কোয়ারেন্টাইন অনেকদিন আগেই উঠে গেছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। তবুও পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে আইসোলেট করা শুরু করেছি বাড়িতে।সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে এক্সপোজড হওয়ার হাই ভাইরাল লোডের চিন্তা তো থাকছেই। হ্যাঁ, পিপিই ব্যবহার করা সত্ত্বেও।
আমার সিনিয়রের পরিবারে আবার রয়েছেন তার বৃদ্ধা মা। তার বিপদের কথা ভেবে সিনিয়র ইতিমধ্যেই অন্যত্র থাকার বন্দোবস্ত করছেন নিজের। অন্তত সামনের বেশ ক’টা দিন। যদিও এসব নিয়েও হয়তো আমাদের করতে হবে ইমারজেন্সি সার্জারি। প্যানডেমিকে এটাই নাকি দস্তুর। তাই এবারের দুর্গাপুজোটা একদমই অন্যভাবে শুরু হতে চলেছে আমার।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গোটা রাসবিহারী কানেক্টর দেখলাম পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আমাদের বাড়ির কাছের একটি বড় পুজো মণ্ডপের আজকে নাকি উদ্বোধন। এক সঙ্গীত মুখর পরিবেশে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই ‘ভাঁড়ের পুজোর’ কর্তাব্যক্তিরা।ইতিমধ্যে সকালের ব্যারিকেডগুলির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।সেখানে ইতস্তত উঁকিঝুঁকি মারছে পাবলিক। সবাই অপেক্ষা করে আছেন রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রীর। একটু পরেই ফিতে কেটে হৈ হৈ করে শুরু হয়ে যাবে এবারের দুর্গাপুজো।
ভাবছিলাম আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা বোধহয় অন্য কোন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেছি আজ এই ক’মাসে। চারিদিকে এই বাঁধনছেঁড়া আনন্দের মাঝে এখন বড় বেমানান লাগে নিজেদের। নিরন্তর এই চাপ নিয়ে নিয়ে আর দ্বিচারিতা দেখতে দেখতে কোথাও মনে হয় মানসিক অবসাদ গ্রাস করতে শুরু করছে আমাদেরকেও। তবুও লড়াই চালিয়ে যাবো আমরা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও।
আপনারা সুস্থ থাকুন সকলে। পুজো কাটুক সাবধানে।