জ্বর-জ্বর লাগছে, কাঁপুনি একটু একটু, কোমরের এক পাশে বা দুপাশেই ব্যথা? হয়তো আপনার কিডনির জীবাণুসংক্রমণ বা পায়েলোনেফ্রাইটিস হয়েছে। এ রোগের উপসর্গ খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়ঃ—
- কোমরের পাশে বা পেছনে, জননাঙ্গের কাছে ব্যথা হয়।
- বেশি জ্বর হয়, তাপমাত্রা ৩৯.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১০৩.১ ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি উঠতে পারে।
- ঠান্ডা লাগে, কখনও কাঁপুনি দেয়।
- খুব দুর্বল বা ক্লান্ত লাগে।
- খিদে কমে যায়।
- অসুস্থ বোধ হয়।
- পাতলা পায়খানা হতে পারে।
সঙ্গে মূত্রথলির সংক্রমণ সিস্টাইটিস বা মূত্রনালির সংক্রমণ ইউরেথ্রাইটিস থাকলেঃ
- মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা বা জ্বালা করা।
- বারবার মূত্রত্যাগ করা, প্রস্রাব পেলে ধরে রাখতে না পারা।
- মূত্রত্যাগ করেও যেন মূত্রথলি খালি হল না এমন মনে হওয়া।
- প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া।
- ঘোলাটে বা দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব।
- তলপেটে ব্যথা।
শিশুদের কিডনির সংক্রমণে অতিরিক্ত কিছু উপসর্গ থাকতে পারেঃ
- উদ্যমের অভাব।
- বিরক্তিভাব।
- খেতে না পারা, বমি হওয়া।
- যতোটা বাড় হওয়া উচিত, ততোটা না বাড়া।
- পেটে ব্যথা।
- জন্ডিস।
- বিছানায় প্রস্রাব করা।
জ্বর আছে, পেটে-কোমরের নীচে বা জননাঙ্গে ব্যথা বা মূত্রত্যাগের ধরনে কোনও পরিবর্তন দেখলে ডাক্তারের কাছে যান। কিডনির অধিকাংশ সংক্রমণেই দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করার দরকার যাতে কিডনির ক্ষতি না হয়ে যায় বা রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। জ্বর আর ব্যথা কমানোর জন্য বেদনানাশকেরও দরকার পড়ে।
কিডনির সংক্রমণের চিকিৎসা
- বাড়িতে থেকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ৭ থেকে ১৪ দিন দেওয়া হয়। প্রস্রাবের কালচার-সেন্সিটিভিটি পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। এই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করার পর সাধারণত সিপ্রোফ্লক্সাসিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়, রিপোর্ট আসার পর প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বদল করা হয়। তবে মহিলাদের গর্ভাবস্থায় এই ওষুধ দেওয়া হয় না। তাঁদের দেওয়া হয় সেফালেক্সিন।
- জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামলই নিরাপদ। আইবুপ্রোফেন বা অন্য কোনও অস্টেরয়েড প্রদাহরোধী ওষুধ কিডনির সংক্রমণে ব্যবহার না করাই শ্রেয়, সেগুলোতে কিডনি আরো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।
- কিডনির সংক্রমণে ওয়েস্টার্ন ধরনের টয়লেট সীটে বসে মূত্রত্যাগের চেষ্টা না করাই ভালো, তাতে মূত্রথলি পুরো খালি না হওয়ার সম্ভাবনা।
- জল ও অন্য তরল খেতে হয় বেশি মাত্রায়। তাতে শরীরে জলের অভাব হতে পারে না আর প্রস্রাবের তোড়ে ব্যাক্টেরিয়াও কিডনি থেকে বেরোতে থাকে।
- আর দরকার বিশ্রাম। কিডনি সংক্রমণে মোটামুটি ২ সপ্তাহ সময় লাগে কাজে ফেরার মতো সুস্থ হতে।
কিডনির জীবাণুসংক্রমণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার দরকার হয় তখন, যখন রোগীর মূত্রতন্ত্রে কোনও গঠনগত বা অন্য সমস্যা আছে যা থেকে জীবাণুসংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
- পুরুষদের মধ্যে কিডনির সংক্রমণ খুব কম হয়, তাই তেমন হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হয়।
- মেয়েদের দু’বার বা তার বেশিবার কিডনি সংক্রমণ হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।
- শিশুদের কিডনি সংক্রমণ হলে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসা করানোই ভালো।
হাসপাতালে ভর্তি চিকিৎসা করানোর দরকা্রঃ
- রোগীর শরীরে জল কমে গেলে।
- রোগী যখন জল বা ওষুধ গিলে খেতে পারছেন না।
- দ্রুত নাড়ীর গতি, জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া – এইসব সেপ্টিসিমিয়ার উপসর্গ থাকে যদি।
- গর্ভাবস্থায় তাপমাত্রা যদি খুব বাড়ে।
- রোগী যদি আগে থেকেই দুর্বল থেকে থাকেন।
- অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি অবস্থার উন্নতি না হয়।
- রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি আগে থেকেই কম থাকে।
- মূত্রতন্ত্রে যদি পাথর বা ক্যাথিটার থেকে থাকে।
- রোগীর যদি ডায়াবেটিস থাকে।
- রোগীর বয়স যদি ৬৫ বছরের বেশি হয়।
- পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ থেকে যদি কিডনির কার্যক্ষমতা কম থেকে থাকে।
কিডনির সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিরায় ড্রিপ লাগানো হয় যাতে রোগীর জলশূন্যতা না হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক যাতে শিরা দিয়ে দেওয়া যায়। নিয়মিত রক্তপরীক্ষা ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে শরীরের অবস্থা দেখা হয়, দেখা হয় অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে কিনা।
বেশির ভাগ রোগী চিকিৎসায় সাড়া দেন। জটিলতা কিছু না থাকলে ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া যায়। ড্রিপ খোলার পর ইঞ্জেকশনের বদলে মুখে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়।
কিডনির জীবাণুসংক্রমণের জটিলতা
জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি শিশুদের, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের, গর্ভবতী মহিলাদের, ডায়াবেটিস মেলিটাস, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ও সিকল সেল অ্যানিমিয়ার রোগীদের, কিডনি প্রতিস্থাপনের পর (বিশেষত প্রথম ৩ মাস), প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন রোগীদের, হাসপাতালে থাকাকালীন কিডনির সংক্রমণ হয়েছে এমন রোগীদের। যেসব জটিলতা হতে পারে, সেগুলো এইরকমঃ
- কিডনিতে ফোঁড়া—কিডনির কোষকলার ভেতর পূঁজ জমে। এমনটা বেশি হয় ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগীদের। ফোঁড়া হলে রক্তে জীবাণুসংক্রমণ হয়ে প্রাণসংশয় হতে পারে। ছোট ফোঁড়া শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। বড় ফোঁড়া হলে সূঁচ ফুটিয়ে পূঁজ টেনে বার করতে হয়।
- সেপ্সিস বা রক্তে জীবাণু ছড়িয়ে পড়া—প্রাণসংশয় হতে পারে এমনটায়। এক্ষেত্রে আইসিইউ-তে ভর্তি করে চিকিৎসা করাই শ্রেয়।
- কিডনির তীব্র সংক্রমণ যাতে কিডনির একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়।
- কিডনির বিকলতা—যাতে ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের দরকার হতে পারে।
- এছাড়া উচ্চরক্তচাপ, সময়ের আগে প্রসবযন্ত্রণা ও প্রসব হতে পারে।
কিডনির জীবাণু সংক্রমণের উপসর্গ, চিকিৎসা নিয়ে তো জানলেন। এবার জানা যাক কী কারণে এই সংক্রমণ হয়।
কিডনির সংক্রমণ হয় ব্যাক্টেরিয়া মূত্রনালী দিয়ে ঢুকে মূত্রথলি দিয়ে গবিনী (ইউরেটার) হয়ে যখন কিডনিতে পৌঁছায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ব্যাক্টেরিয়া হলো ই. কোলাই। ই. কোলাই থাকে আমাদের খাদ্যনালীতে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে শৌচ করার সময় মলদ্বার থেকে এই জীবাণু মূত্রনালীর মুখে এসে পৌঁছতে পারে। এমনটা হতে পারে যৌনসংসর্গের সময়েও। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে চামড়ার ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ থেকে রক্তবাহিত হয়ে জীবাণু কিডনিকে সংক্রামিত করতে পারে – তবে এমনটা হয় যে সব মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব কমজোর, কেবল তাদেরই।
কাদের কিডনি সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি?
মহিলা ও শিশুদের কিডনি এবং মূত্রতন্ত্রের অন্য সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
মহিলাদের মলদ্বার ও মূত্রনালীর ছিদ্র খুব কাছাকাছি, তাই মলদ্বার থেকে হঠাৎ করে মূত্রনালীতে জীবাণু ঢোকার সম্ভাবনা বেশি।
মহিলাদের মূত্রনালী দৈর্ঘ্যেও পুরুষের মূত্রনালীর চেয়ে অনেক ছোটো। পুরুষের মূত্রনালী লিঙ্গের মধ্যে দিয়ে যায়, মহিলাদের তা নয়। তাই মহিলাদের মূত্রথলিতে সহজেই জীবাণু পৌঁছে যেতে পারে। আর তা থেকে উঠতে পারে কিডনিতে।
এছাড়া যেসব ক্ষেত্রে কিডনি সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি সেগুলো হলঃ
- যখন কোন কারণে মূত্রতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ অবরুদ্ধ—কিডনিতে পাথর, প্রস্টেট গ্রন্থি বাড়া।
- যে সব শিশুরা কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগে, তাদেরও ঝুঁকি বেশি।
- জন্মগত ভাবে যদি মূত্রতন্ত্রে কোনও অস্বাভাবিকত্ব থাকে।
- এমন অবস্থা যাতে মূত্রথলি পুরো খালি করা যাচ্ছে না, যেমন—মেরুদন্ডের আঘাত। এতে জীবাণু বংশবৃদ্ধি করার ও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ বেশি পায়।
- রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি কম থাকে, যেমন টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলিটাসে, ক্যানসারের কেমোথেরাপির পরে।
- প্রস্টেট গ্রন্থির সংক্রমণ (prostatitis) থাকলে জীবাণু কিডনিতে ছড়িয়ে যেতে পারে।
- যদি মূত্রনালীতে ক্যাথিটার লাগানো থাকে।
- মহিলা, যাঁরা যৌনসম্পর্কতে সক্রিয়— কেননা যৌনসম্পর্কের সময় মূত্রনালী উত্তেজিত হয়, তাতে জীবাণু মূত্রথলিতে উঠতে পারে।
- পায়ুকামী পুরুষ।
- গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক যে পরিবর্তনগুলো হয় তার ফলে প্রস্রাবের গতি শ্লথ হয়ে যায়, তার ফলে জীবাণু কিডনিতে ছড়িয়ে যাওয়া সহজতর হয়।
- কোনও কোনও দেশ বা সমাজে মেয়েদের যৌনাঙ্গ কাটা হয়, তাও কিডনির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
দেখা যায়ঃ
- কিডনি সংক্রমণে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় প্রায় ছয়গুণ বেশি আক্রান্ত হন।
- কমবয়সী মহিলারা আক্রান্ত হন বেশি, কেন না তাঁদের যৌন সক্রিয়তা বেশি।
- শিশুরা আক্রান্ত হয় যদি তাঁদের মূত্রতন্ত্রে জন্মগত অস্বাভাবিকত্ব থাকে। অনেক ক্ষেত্রে মূত্রথলি থেকে প্রস্রাব কিডনির দিকে ফিরে যায়, যার ডাক্তারী নাম vesico-ureteric reflux, তাতেও কিডনি সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
কিডনি সংক্রমণ কি ঠেকানো যায়?
কিডনির জীবাণু সংক্রমণ ঠেকাতে জননাঙ্গ, মূত্রনালী ও মূত্রথলিকে জীবাণুমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হয়ঃ
- জল এবং অন্য তরল খেতে হয় বেশি করে।
- প্রস্রাব পেলেই তা ধরে না রেখে ত্যাগ করা উচিত।
- মলত্যাগের পর শৌচ করার সময় হাত সামনে থেকে পিছনে নিতে হয়, উল্টোটা করলে জীবাণু মূত্রনালীতে ঢোকার ঝুঁকি বাড়ে।
- রোজ স্নানের সময় এবং যৌন সংসর্গের পর যৌনাঙ্গ ভালো করে পরিষ্কার করতে হয়।
- যৌনক্রিয়ার পর মূত্রত্যাগ করে মুত্রথলিকে খালি করতে হয়।
- মহিলা হলে পশ্চিমী কেতার টয়লেটে বসে মূত্রত্যাগ না করাই ভালো, কেনা না সেই অবস্থানে মূত্রথলি অনেক সময় পুরোটা খালি হয় না।
- কোষ্ঠবদ্ধতা এড়াবার জন্য খাদ্যে আঁশের পরিমাণ বাড়াতে হয়, জল বেশি খেতে হয়। প্রয়োজনে মল নরম রাখার ওষুধ খেতে হয়।
- যৌনক্রিয়ার সময় কন্ডোম ব্যবহার করলে তা যেন পিচ্ছিল (lubricated) হয়, কন্ডোম পিচ্ছিল না হলে মূত্রনালী বেশি উত্যক্ত হয়। কন্ডোমে যেন শুক্রাণুনাশক (spermicide) না থাকে, কেন না শুক্রাণুনাশক ব্যাক্টেরিয়ার বংশবৃদ্ধি বাড়াতে পারে।