করোনা নিয়ে যা লেখা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, ড্রপলেটের আয়তন কত, কি মাস্ক, কতক্ষণ মাস্ক, স্যানিটাইজার, কোভিড যোদ্ধা, কোভিড প্রোটোকল… বাপরে, এত ডাক্তারির কথা অডাক্তাররা আর কখনো জানেননি, আশা করবো আর কখনো জানতেও না হয়।
তবে একটা কথা এই সুযোগে বেশ প্রচলিত হয়ে গেছে। ‘সামাজিক দূরত্ব।’ যদিও কথাটা শারীরিক দূরত্ব হলে যথাযথ হতো, তবু বর্তমান প্রেক্ষিতে বোধহয় এই কথাটাই যুগের সাথে সাযুজ্য বজায় রেখেছে। স্মার্টফোন এসে আমরা যত ভার্চুয়ালে সামাজিক হয়েছি, ততই বাস্তবিকে প্রকৃত বন্ধুহারা এক একটি ঘাড়নিচু রোবটে পরিণত হয়েছি।
আমাদের সবার সমাজ এখন ফোনের মধ্যে। হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে আড্ডা দিতে গিয়ে সেই একই বন্ধুদের সাথে বাস্তবিকে আর দেখাই হয় না ।প্রতিবেশীর ফেসবুক না থাকলে তাকে চেনা মুশকিল, বাসে এখন আর সহযাত্রী হয় না, সবাই ফোনের দিকে তাকিয়ে কি যেন করে।
সম্ভবত এভাবে ভার্চুয়াল সমাজের বাসিন্দা হয়ে গিয়ে বাস্তবিকে আমরা বড় একা। ফোন ছাড়া আমরা এখন বড় দিশাহারা। যে কোনো জমায়েতে গিয়ে দেখুন,কেউ সেলফি তুলছেন, কেউ ভিডিও, কেউ সামাজিক মাধ্যমে ব্যস্ত আর কেউ ব্যক্তিগত বিশ্রম্ভালাপে। মোটমাট, ফোনের দিকে চোখ নেই এমন কাউকে দেখতে পাওয়া মুশকিল। ঘটনা এমন পর্যায়ে গেছে যে সামাজিক মাধ্যমে কিছুর উল্লেখ না থাকলে সত্যিই সেটা ঘটেছে কিনা সেটাতেই সন্দেহ থেকে যায়।
আগে টি ভি-কে ইডিয়ট বক্স বলা হতো, এখন ফোনকে স্মার্ট বলা হয়। কিন্তু আইনস্টাইনিয় সূত্রের মতো, যন্ত্রী ও যন্ত্রের মোট বোকামি ও বুদ্ধির পরিমাণ ধ্রুবক ও অপরিবর্তনীয়। অন্যভাবে বললে, আপনার যন্ত্রটির অ্যালগরিদম যতটা স্বতঃশিক্ষার্থী, মস্তিষ্ক ততটাই নতুন কিছুতে অনাগ্রহী ও অপারগ হবে।
একটা উদাহরণ দিই। বারো পনেরো বছর আগে আপনার প্রথম মোবাইল ফোনটি মনে করুন। চূড়ান্ত আনস্মার্ট, ফোনবুকে শুধু আদ্যক্ষর দিয়ে সার্চ করা যায়, এক একটা অক্ষর টাইপ করতে এক থেকে তিনবার বোতাম টিপতে হয়।
সে সময়কার কাছের লোকের ফোন নম্বর মুখস্ত থাকতো আপনার, কারণ ফোনে খুঁজে পাওয়া ঝকমারি। যেহেতু ক্ষমতা কম, যার তার নম্বর সেভও হতো না। এই এখন আপনি নিজেরটি ছাড়া যে কটি ফোন নম্বর মনে করতে পারবেন, সব সেই সময়ের ফোনের অবদান। বারবার ডায়াল করতে করতে আপনার স্মৃতির কোষগুলোতে তারা পোক্ত হয়ে বসে আছে।
এইবারে বর্তমানে আসুন। গত তিন বা চার বছরো আপনার প্রিয়জনের যে সব নম্বর হোয়াটসঅ্যাপের কনট্যাক্ট পেয়ে সেভ করেছেন, একটাও মুখস্থ বলুন দেখি।
যখন ফোনে ক্যামেরা ছিলো না, তখন নিশিদিন ছবি তোলা হিসিপটির মতো প্রাত্যহিক কাজ ছিলো না। তারপরে এলো সেলফি। মানুষ স্বভাবতই আত্মরতিপ্রবণ। যাকে যতই ভালোবাসুন, আপনার কাছে পৃথিবীর প্রিয়তম মানুষ আপনিই। আপনার সমস্ত কাজের নিঃশর্ত সমর্থককে আপনি রোজ আয়নায়, থুড়ি ফ্রন্টক্যামেরায় রোজ দেখেন। সুতরাং খচাখচ ছবিতে গ্যালারি ভরে উঠবে এ আর বেশি কথা কি!
এইবারে একটা হোমটাস্ক দিই। গ্যালারিতে থাকা তিনমাস আগের ছবিটিকে তোলার পরদিন থেকে ক’বার দেখেছেন?
দেখেননি তো? আর যে সব ছবি ভালোবেসে নাম লাগিয়ে ল্যাপটপ হার্ডডিস্কে ট্রান্সফার করেছেন, সেই স্মৃতিসরণীতে ক’পা হেঁটেছেন? হাঁটেননি, কারণ পরের সেলফির স্তুপে আগেরগুলো চাপা পড়ে গেছে। আপনার মস্তিষ্ক শুধু বর্তমানেই ফোকাস করতে করতে, অতীতরক্ষার ভার ফোন বা হার্ডডিস্ককে দিয়ে দিয়েছে।
আবেগ ও অভিমতের বহিঃপ্রকাশ এখন সামাজিক মাধ্যমেই, এমন কি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিও নাকি কার কতজন ফলোয়ার। স্বভাবতই সাধারণ লোক থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ‘সেলিব্রিটি’রা সবাই এই তুমুল ডেটাসুনামির অংশীদার। অমুক লোকটি কোন দলের সমর্থক, কি খেতে ভালোবাসেন বা তমুক বিষয় নিয়ে কি ধারণা পোষেন, সেটা বোঝার জন্য তাঁকে চেনার বা তার সাথে আড্ডার কোনো দরকার নেই, তার প্রোফাইলে ঘুরে বেড়ালেই হয়। কম্পিউটার থেকে ফোনে ফেসবুক এসে পড়ার পর ঘাড়নিচু মানুষের সংখ্যা যে কশো শতাংশ বেড়েছে, তা গবেষণার বিষয়।
এই পুরো ব্যাপারটাতে সুবিধা হয়েছে তিনটে গোষ্ঠীর। এক, যারা আপনার মগজের নিয়ন্ত্রণ চান। আপনার তাবত ইচ্ছে অনিচ্ছে আবেগ বিচ্যুতি বিশ্বাস ও বিতর্ককে এক জায়গায় পেয়ে, কোন অ্যালগরিদমে টোপ দিলে আপনি সে বঁড়শি কোঁত করে গিলবেন, সেটা জানা কোনো ব্যাপারই নয়। টোপ দিতে পয়সা লাগে, গুগল ফেসবুক ইত্যাদিকে মূল্য ধরে দিলে আপনার মতামত অমুকের পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়া এখন আর সমস্যা নয় মোটেই, সে আপনি যতই জেদী আর একগুঁয়ে হোন। অবশ্যই সেটা ঘটবে আপনার অজান্তে, এমন খবর এবং তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে যাতে আপনি অমুককে সমর্থন বা বিরোধিতা করা কর্তব্য মনে করবেন। দুই নম্বর গোষ্ঠী ব্যবসায়ী, তাঁরা আপনার পকেটের দখল চান। সহজ কিস্তিতে আপনার ঘরে পৌঁছে যাবে স্বপ্নের সব সরঞ্জাম, নিজের এবং প্রজন্মের তাবত আগামী সোপান স্থাপনের সমস্ত মালমশলা। ফোনের মধ্যেই এখন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সমস্ত সেভ করা, শুধু ওই একটা তিন অঙ্ক বসিয়ে বোতাম টিপলেই দুনিয়া আপনার মুঠঠি মে। অবশ্য আপনার ব্যাঙ্কের পাশবই ওনাদের তেলতেলে মুঠোতে, তাতে আর কি! তিন নম্বর গোষ্ঠীটি মূলত চোর বাটপার। একবার আপনার ফোনের দখল পেলে তার সাহায্যে আপনার ব্যাঙের আধুলি হস্তান্তরিত হওয়ার এখন সমূহ সম্ভাবনা।
কোভিডের চেয়েও ভয়ঙ্কর সংক্রামক এই নিচুঘাড় অসুখ। যতবার ফোনের দিকে ঘাড় নিচু হচ্ছে আমাদের , ততই সামাজিক দূরত্ব বেড়ে চলেছে পাশের লোকটির সাথে। আমরা প্রত্যেকে যে যার ফোনের মালিক নই, ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছি।
এই অসুখটা আর ছড়াতে দেবেন না। আমরা অ্যালগরিদমের বাইরেও কিছু,সেটা প্রমাণ করার সময় এসে গেছে।