তখন ইন্টার্নশিপ করছি। এন আর এসের ইমার্জেন্সীতে ইভনিং ডিউটি। যাঁরা হসপিটালে কাজ করেন, তাঁরা জানেন যে দুপুর ২ থেকে রাত ৯ টার এই সময়টায় ইমার্জেন্সিতে রোগীর চাপে দম ফেলার সময় হয় না। আমরা চার ইন্টার্ন, এক হাউসস্টাফ আর মেডিসিনের পিজিটি দৌড়াদৌড়ি করে সব রোগীদের দেখার চেষ্টা করছি। এমন সময় এক ভদ্রলোক এলেন, বছর ৫০ বয়স; সাথে এক কিশোর (সম্ভবত ছেলে)। ভদ্রলোক বললেন বুকে চাপ ব্যথা হচ্ছে। বুকের কোন জায়গায় ব্যথা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতে বুকের ডান দিকে হাত দিয়ে দেখালেন। মাথার মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা আছে কিনা সাজাচ্ছিলাম, ডান দিকে ব্যথা শুনে ইন্টার্ন -সুলভ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হার্টবার্নের কথাও ভাবতে লাগলাম। ভাবার সাথে সাথে হাতও চালাচ্ছি , ততক্ষণে ব্লাডপ্রেসার, পালস মাপা হয়ে গেছে। স্টেথোস্কোপটা বুকের বাম দিকে হৃদপিন্ডের জায়গায় বসালাম। পরিচিত লাব-ডুবের আওয়াজ মনে হলো অনেক ক্ষীণ, যেন অনেক দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। হয় স্টেথোস্কোপ নয় নিজের কান, কোনো একটা খারাপ হচ্ছে ধরতে হয়। ইন্টার্নশিপের প্রথম ছয় মাসে ৩ টে স্টেথোস্কোপ হারিয়ে নতুন কেনা ৪ নম্বর স্টেথোস্কোপের ভুল ধরতে মন সায় দিল না, তার থেকে নিজের কান খারাপ হচ্ছে ধরে নেওয়াও মানসিকভাবে স্বস্তিজনক। রোগীকে শুইয়ে পেট টিপে দেখছি , কী মনে হলো রোগীর বুকের বাম দিকে হাত দিয়ে হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি দেখতে গেলাম। নেই। এটা তো হওয়ার নয়। জ্যান্ত মানুষের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি নেই! রোগী মনে হয় আমার ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে কিছু আঁচ করেছিল, বলে উঠলো, “ডাক্তারবাবু, আমার হৃদপিণ্ড কিন্তু ডান দিকে”।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সজারুর কাঁটা’ গল্পে আততায়ী রাতের অন্ধকারে সজারুর কাঁটা বুকের বামদিকে ঢুকিয়ে হৃদপিন্ড ভেদ করে খুন করত। তিন তিন বার একই পদ্ধতিতে খুন করে চতুর্থ বার ব্যর্থ হয়। কারণ চতুর্থজনের হৃদপিন্ডটা বুকের ডান দিকে। ব্যোমকেশের গল্পে আমার হাতেখড়ি দিদির মুখে শোনা এই গল্পটা দিয়েই।
ডাক্তারি পড়তে এসে এই সম্বন্ধে বিশদে পড়েছিলাম। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ডেক্সট্রোকার্ডিয়া। বিরল এই শারীরিক অস্বাভাবিকতা দেখা যায় ১ শতাংশেরও কম মানুষের মধ্যে। কিছু মানুষের শুধু হৃদপিণ্ড ডানদিকে থাকে। কিছু মানুষের লিভার, স্প্লীন ও পৌষ্টিক তন্ত্রের বাকি অংশও নিজেদের জায়গা বদল করে, যথা ডানদিকের লিভার বামদিকে, বামদিকের স্প্লীন ডানদিকে চলে আসে। তখন আবার এর নাম পাল্টে হয়ে যায় সাইটাস ইনভারসাস। মায়ের পেটে ভ্রূণ অবস্থায় থাকাকালীন সম্ভবতঃ জিনগত কিছু প্রভাবে অঙ্গাদি নিজের স্বাভাবিক জায়গা ছেড়ে উল্টোদিকের স্থান অধিকার করে (মিরর ইমেজ)। কিছু মানুষের নানারকম শারীরবৃত্তীয় সমস্যা দেখা যায়; কিছু মানুষ সারাজীবন স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন, নিজেদের শরীরের মধ্যের অস্বাভাবিকতা টেরেও পান না।
রোগীর কথা শুনে হতবাক আমি স্টেথোস্কোপটা বুকের ডানদিকে বসালাম। পরিচিত লাব-ডুব ভেসে এলো। রোগীর সাথে থাকা রাশি রাশি রিপোর্ট ঘেঁটে বাকি প্রমাণ পেলাম। রোগীকে সেদিন আর ভর্তি করতে হয়নি, ইমার্জেন্সীতেই ওষুধ পেয়ে সুস্থ বোধ করতে বাড়ি চলে যান। ও হ্যাঁ, ইসিজিও করিয়েছিলাম; সব ইসিজির লিড উল্টো বসিয়ে। ড্রেনে পড়ে হাত-ভাঙ্গা মাতাল, প্রেমের ফাঁদে পড়ে কবজিকাটা ব্যর্থ প্রেমিকের ভিড়ে ভর্তি ইমার্জেন্সীতে সেদিন আমার মনে গল্পদাদুর আসর বসেছিল। কিছু গল্প গল্প হলেও সত্যি হয়।