এর আগের দুটি পর্বে আলোচনায় দেখেছি, গুটিবসন্ত হল আজকের কোভিড-১৯ এর মতোই একটি ভাইরাসঘটিত ছোঁয়াচে রোগ। ছোঁয়াচে রোগগুলোর মধ্যে গুটিবসন্ত এতাবৎ ইতিহাসে বিশ্বের সবথেকে বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অন্তত তিনহাজার বছর ধরে মানুষের এই রোগ ঠেকানোর মতো উপায় ছিল না। অবশেষে সাধারণাব্দ ১৮০০ সাল নাগাদ এডোয়ার্ড জেনার-এর টিকা আবিষ্কৃত হয়, আর তার ১৭০ বছর পরে গুটিবসন্তকে পুরো নির্মূল করা গেল। তবে প্রাচীনকালে ভারত ও চীনে গুটিবসন্তের রস সুস্থ মানুষের দেহে ঢুকিয়ে, কম মারাত্মক রোগ তৈরি করে ভয়াবহ রোগ আটকানোর প্রথা ছিল। স্বয়ং জেনার সেই প্রাচীন টিকা নিয়েছিলেন তাঁর বালক বয়সে। আজ আসব জেনার-এর আবিষ্কারের বিবরণে।
গোয়ালিনীর গর্ব আর জেনার–এর হাতে টিকার দাগ
ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে বহুবছর ধরে ভাবছিলেন। তাঁর ছোটবেলায় এক গোয়ালিনীর মুখে শুনেছিলেন— “আমার গুটিবসন্তের ভয় নেই, কেননা আমার গো-বসন্ত (কাউপক্স) হয়ে গেছে।” এ-কথাটা যে ইংরেজ বা ইউরোপীয় ডাক্তাররা কেউ জানতেন না, তা কিন্তু নয়। অনেকেই জানতেন। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে তাঁরা তেমন তলিয়ে ভাবেননি। কেন ভাবেননি সেটা আমরা পরে দেখব। তার আগে “টিকা আবিষ্কার” জিনিসটা কী, রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’-এর সঙ্গে তার কিছুমাত্র মিল আছে কিনা, সেটা একবার দেখি।
ফ্র্যান্সিস গ্যালটন-এর একটি বহুশ্রুত উদ্ধৃতি জেনার-এর আবিষ্কার প্রসঙ্গে বেশ জুতসই। উদ্ধৃতিটি হল, বিজ্ঞানে কোনো নতুন জিনিস প্রথমবার ভাবতে পেরেছেন বলেই তাঁকে সেই জিনিসটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। কৃতিত্ব তাঁরই যিনি বিশ্বের দরবারে আবিষ্কারটি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইংরাজিতে বললে, “In science credit goes to the man who convinces the world, not the man to whom the idea first occurs.”। কথাটা অন্যভাবে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝব, ইংরেজ গোয়ালা–গোয়ালিনীদের ’বিশ্বে’ গো–বসন্ত হলে গুটিবসন্ত হয়না, এটা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অথচ তার কৃতিত্ব কেউ পায়নি। কোনটা বিজ্ঞান আর কাদের হাতে পড়লে সাধারণ জ্ঞান বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হয়ে ওঠে, আপাতত আমরা সে প্রশ্নে ঢুকছি না। । শুধু লক্ষ্য করব, গোয়ালাদের এই জ্ঞান কোনো ব্যক্তিগত আবিষ্কার ছিল না, ছিল গোষ্ঠিগত জ্ঞান। এই গোষ্ঠিগত জ্ঞান ছিল বলে গোয়ালারা গো-বসন্ত আছে এমন গরু হয়তো ইচ্ছে করেই ঘাঁটত যাতে নিজের শরীরে গো-বসন্ত হয়। এই জ্ঞান তখনও ওদেশের চিকিৎসক সমাজের ছিল না। অন্যদিকে, শরীরে গুটিবসন্ত রোগের বীজাণূ চামড়া কেটে প্রবেশ করালে মৃদু গুটিবসন্ত হয়ে মারাত্মক বসন্তের হাত থেকে রেহাই মেলে, এটাও ছিল আরেক গোষ্ঠিগত বা ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান, যা ভারত-চীন থেকে খুব সম্ভবত তুরস্ক হয়ে ইউরোপে ঢুকেছিল। সে-জ্ঞানটিও কিন্তু বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত ছিল না, এমনকি টিকাকরণের মূলনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিললেও একে টিকা বলে ডাকাই হল না। ভাষা বড় জটিল আবরণ।
আমরা এবার জেনার-এর কাহিনীতে আসি। তিনি গোয়ালা-গোয়ালিনীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং পর্যবেক্ষণ করে নজর করলেন যে, এদের অনেকের চামড়ায় ছোট গুটি মত বেরোয়, সামান্য একটু রোগ হয় এবং তা সেরে যায়, কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় না। তিনি দেখলেন, দুধের বাঁটের কাছে গরুরও এই ধরনের কিছু গুটি হয়। এই রোগটি হলো কাউপক্স বা গো-বসন্ত। জেনার ভাবলেন, আচ্ছা, এই গো-বসন্তের রস চামড়া কেটে শরীরে ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়? যদিও এর কার্যপ্রণালী খুব ভালো করে বোঝা যায়নি, তবে আমরা এখন যুক্তিসঙ্গত অনুমান করতে পারি, ঠিক কী কারণে একজন মানুষের গোবসন্ত হলে তার স্মলপক্স বা গুটি বসন্ত হয় না, বা হলেও কম তীব্র হয়। গো-বসন্ত এবং গুটিবসন্ত এ-দুয়ের বীজাণু বা ভাইরাসের গঠন কাছাকাছি। তাই একবার গো-বসন্ত হলে শরীরের গো-বসন্তের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে তা স্মলপক্স জীবনকে আটকে দেয় বা তাকে বেশি ক্ষতি করতে দেয় না। তবে এ নিয়ে অন্য মতও আছে, সময় হলে পরে আলোচনা করা যাবে।
১৭৯৬ সাল, ঠিক ২২৪ বছর আগে আজকের মতোই এক মে মাসের দিন। সারা নেমস (Sarah Nelms) নামে এক তরুণী গোয়ালিনীর হাতে একটা গো-বসন্তের গুটি দেখে রেখেছিলেন জেনার।
সেই গুটি থেকে রস (তখনকার ভাষায় লিম্ফ) নিয়ে জেমস ফিপস (James Phipps) বলে আট বছরের এক বালকের হাতে জেনার টিকা দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাততম টিকা। কয়েকদিনের মধ্যে ছেলেটির একটু জ্বর হল, বগলে সামান্য ব্যথা। ন’দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা বোধ হতে শুরু করল, আর খিদে কমে গেল। কিন্তু পরের দিন তার শরীর প্রায় সুস্থ। এর দু’মাস পরে জেমস ফিপস-এর শরীরে জেনার গুটিবসন্তের রস প্রবেশ করিয়ে দিলেন—এটা অবশ্য কোনো নতুন পদ্ধতি নয়, ভারত-চীন-তুরস্ক হয়ে ইংল্যান্ডে আসা ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি। তারপর অধীর প্রতীক্ষা। কোনো রোগলক্ষণ দেখা দিল না।
প্রসঙ্গত জেমস ফিপস-এর বাবা ছিল গরীব ভূমিহীন চাষী, জেনার তাঁকে নিজের বাগানের মালির কাজ দেন। চতুর্থ পর্বে আমরা দেখব জেনার-এর টিকা কতটা তাড়াতাড়ি গৃহীত হল।
তথ্যসূত্র
(Edward Jenner and the history of smallpox and vaccination, Stefan Riedel, https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1200696/)
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
১) জেমস ফিপস-কে এডোয়ার্ড জেনার-এর প্রথম টিকাদান
২) মানুষের হাতে গো-বসন্তের গুটি