আজ রবিঠাকুরের জন্মদিন। আজ বৃষ্টি হবে। ছোটবেলায় এই ঘটনাক্রম ছিল অবশ্যম্ভাবী। কারণ সেই দিনটা যে ছিল আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের।
সেই সন্ধ্যার তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত অনেক আগে থেকেই।পয়লা বৈশাখে নতুন বছর ঘুরলেই পাড়ায় পাড়ায় প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালনের।
খুব ছোট থেকে প্রতি বছরে ঘটে যাওয়া এই সব সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাগুলি মনের গভীরে আজও দাগ কেটে রয়ে গেছে আমার।উৎসবের আমেজে এই বার্ষিক ‘ঠাকুর’ পুজো তখন হয়ে উঠতো সার্বজনীন।
সেইদিন সকাল থেকেই সাজো সাজো রব।এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে তক্তাপোশ নামছে সিঁড়ি বেয়ে। পাড়ার ছেলেরা গলদঘর্ম, হৈ হৈ ব্যাপার। মোড়ের মাথার একচিলতে মাঠে বা প্রয়োজনে রাস্তার উপরেই গোটা কয়েক তক্তাপোশ বিছিয়ে তৈরী করা হবে স্টেজ। মঞ্চ বাঁধার জন্য পাড়ার ডেকরেটরের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিয়ে আসা হয়েছে বাঁশ, নারকেলের দড়ি আর গোবিন্দ দাকে।
গোবিন্দদা কর্মকুশলী মানুষ। দুর্গাপুজোর ম্যারাপ বাঁধার কারিগর। একাই একশো। দড়ি দিয়ে উঁচুনিচু তক্তাপোশগুলিকে একত্রিত করে বেঁধে ফেলতো মঞ্চ। পায়ার তলায় লাগিয়ে দেওয়া হত ইঁটের টুকরো। যাতে মোক্ষম সময়ে নড়বড়ে না হয়ে যায় কাঠের তক্তাপোশ।
কাঠফাটা দুপুরে কয়েকটি বাঁশের উপর একরঙা কাপড় লাগিয়ে বানিয়ে ফেলতো ‘চালা’। আমাদের সন্ধ্যার স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড।
আমরা তখন কোনো এক বাড়ির বারান্দার ছায়ায় বসে, নাটকের শেষ মহলা সারতে সারতে কান পেতে শুনতাম সেই বাঁশে পেরেক মারার শব্দ। ঠক ঠক ঠকাস।
গোবিন্দদা সামান্য কিছু পয়সাতেই খুশি। যেমনটি দিতে পারে পাড়ার ছেলেছোকরার দল! কয়েকদিন ধরে সেই উদ্দেশ্যেই যে চাঁদা তোলা হয়েছে পাড়ার বাড়িগুলি থেকে।আর সাদা ইনভিটেশন কার্ডে সুন্দর করে হাতে লিখে বানানো হয়েছে আমন্ত্রণ পত্র। বড়ো থেকে ছোটো সবার প্রয়াস মিলে গেছে রবি বন্দনায়।
অনুষ্ঠান সূচীতে উদ্বোধনী সঙ্গীত,নৃত্যনাট্য আর ফিলার হিসাবে পাড়ার ছোটদের কবিতা এবং গান। সব বয়সের সব ধরনের কুচোকাঁচাদের জন্য মঞ্চের দুয়ার আজ অবারিত । কারোকে না বলা যাবে না।আজ যে সেই ঠাকুরের জন্মদিন।
মঞ্চের এককোনে সাদা চাদরের টেবিলে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ, দুপাশের ফুলদানিতে রজনীগন্ধা ফুল। ছবি থেকে নিবিষ্ট মনে শুনছেন অনুষ্ঠান। সবশেষে রাখা হয়েছে মূল আকর্ষণ নাটক।পাড়ার নব্যযুবাদের উৎসাহে।
তবে তার আগে নৃত্যনাট্য। শ্যামা, চণ্ডালিকা, কিংবা পূজারিণী। বিশেষ নিবেদন মেয়েদের তরফে। মনে আছে পাড়ার মহিলা মহলের এই মহলার মধ্যে একবারই স্থান পেয়েছিল ছেলেরা। তাপস দা, ‘পুজারিণী’তে রাজার ভূমিকায়। আমাদের খুব হিংসে হয়েছিল সেবার। সেই অজাতশত্রুর একটি লাইনের ডায়ালগও জুটে ছিল তার কপালে। কিন্তু স্টেজে উঠেও, রিহার্সালের মতোই তার সেই সংলাপ সঠিক বলা হলো না। সেই হাস্যকর দৃশ্য আমার এখনো মনে আছে।
তবে সেই দিনটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই মেয়েদের জন্য। মায়েদের লাল পাড় সাদা শাড়িতে মেয়েরা হয়ে উঠতো অনন্যা। আটপৌরে পাশের বাড়ির মেয়েটিকেও যেন মনে হতো অন্য গ্রহের।একদিনেই কত বড়ো হয়ে যেত সকলে। রবি ঠাকুরের গানে আর নাচের ছন্দে আবিষ্ট করে রাখত সমস্ত দর্শকদের। কোন আলো যে সে সন্ধ্যায় লাগতো আমাদের সকলের চোখে, তা বোঝার আগেই সম্মোহিত হয়ে যেতাম।
এখনো এই মাঝ বয়সে এসে সেই সন্ধ্যার মায়াবী আলো, লাউড স্পিকারে ভেসে যাওয়া সুরের মূর্ছনা, রজনীগন্ধার সুবাস মস্তিষ্কে সজাগ হয়ে রয়েছে।
আমাদের নাটক রাখা থাকতো সব শেষে। বার বার ঘোষণা করে দর্শকদের আটকে রাখার চেষ্টা চলতো নৃত্যনাট্য শেষ হয়ে গেলেই। তখন ইতিমধ্যেই বাতাস বইতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে কোন তারাই আর দেখা যাচ্ছে না। তাড়াহুড়ো করে শুরু করতে হতো নাটক।
কুশীলব আর দর্শকবৃন্দ সবাই জানতো কালবৈশাখী আসতে চলেছে যখন তখন। দ্রুত সংলাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে হতো আমাদের।তবে খুব কমই হয়েছে যে আমরা নাটক শেষ করে উঠতে পেরেছি। কয়েকবার একেবারেই ধুয়ে দিয়েছে বৃষ্টি। সেই অকাল বর্ষণ শেষ হয়েছে মাঝরাতে। ঝড়ের দাপটে উড়ে গিয়েছে দুপুরে গোবিন্দদার হাতে যত্ন করে বানানো স্টেজের চালা। তার সাথে আমাদের নাটকের অবশিষ্ট।
মনে পড়ছে একবারই শেষ করতে পেরেছিলাম অনুষ্ঠান ।বৃষ্টি ধরে এসে সুযোগ করে দিয়েছিল নাটক সম্পূর্ণ করার। স্বল্পসংখ্যক দর্শকও ফিরে এসেছিলেন নাটকের শেষাংশ দেখবার জন্য। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’। এখনো মনে আছে নাটকের নাম।
তাই এতদিন পরে আবার রবি ঠাকুরের জন্মদিনে ঝড় বৃষ্টি দেখে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। অতিমারীর বিভীষিকায় এখনো ত্রস্ত হয়ে রয়েছি আমরা। এই বুঝি আবার এলো ফিরে।
তাই আজ একটু অন্য কথা হোক। স্বর্ণালি স্মৃতির পাতায় ফিরে যাওয়া যাক।
সেই আলোকিত সন্ধ্যা…,
রবি ঠাকুরের ছবিতে সাজানো মঞ্চ…,
রজনীগন্ধার মনকেমনিয়া সুবাস…,
আর কোন এক কাজলকালো চোখের ঝিলিক!
অক্ষয় হয়ে থাক হাজার তারার ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেওয়া, চোখে লেগে থাকা সেই আলো….!