বিধান রায় ভগবান ছিলেন না। সামান্য মানুষ মাত্র। কবির প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের জন্য ইউরিন সম্পূর্ণ আটকে কিডনি ফেইলিওর হচ্ছিল ( high urea level )। এবং উনি ভয়ানক ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত ছিলেন ( pus cell and rbc ++++ )। কোনও অপারেশন হয়নি। সোজা পথে ক্যাথেটার পরানো যায়নি তাই বাড়িতেই supra-pubic path দিয়ে ক্যাথেটার পরানো হয়েছিল। কেবলমাত্র একটা চেষ্টা করা হয়েছিলো। সীমিত ক্ষমতার চেষ্টা। ঐ বয়সে প্রস্টেট অপারেশন সম্ভব নয় আর সেযুগে তেমন কিছু ছিলোও না। সেই অর্থে আজকাল প্রতিটি মৃত্যুর জন্যেই ডাক্তার দায়ী । কিছু সিদ্ধান্ত ডাক্তারকে নিতেই হয় । এড়িয়ে যাওয়া যায় না । এখানেই ডাক্তারের ভূমিকা – রবীন্দ্রনাথ এবং সাধারণ মানুষের জীবনদর্শন সম্পর্কে দুচারটে কথা এসে পড়ে ।
কবি নিজে মৃত্যু সম্বন্ধে কী ভাবতেন ?
কাছে বইপত্তর নেই। সবটাই স্মৃতিনির্ভর। তাই উদ্ধৃতিগত ভুলচুক ক্ষমণীয়। ‘হাল ছেড়ে আমি বসে আছি ওগো ছুটি নে কাহারো পিছুতে।’ এটাই বাঙালির মূল কথা। এবং সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই বাঙালি নন। এখানেই আমরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু নিয়ে আলোড়িত হই । যদি অপারেশন না হতো রবীন্দ্রনাথ অমর হতেন?
আমরা যদি ডাকঘরের কথা ভাবি – যদি সেই তরুণ বালক অমলের কথা ভাবি তাহলে কিন্তু আমাদের নিজেদের সত্যিকারের প্রতিবিম্বটা দেখতে পাবো। একজন তার কাঙ্ক্ষিত রাজার, যে কিনা আসলে মৃত্যু, অপেক্ষায় বাতায়নে বসে – সামনে দিয়ে জীবনের স্রোত বয়ে যায়। নিরাসক্ত বালক শুধু মাত্র কূতুহলী দৃষ্টিতে ঠাকুরদার চোখ দিয়ে ক্রৌঞ্চ দ্বীপের পাখিদের খবর শোনে। তার শুধু পথ চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া বর্ষা আসে বসন্ত যায়। এগুলো তো দৃশ্য মাত্র। আসল কথাটা হলো দিনশেষে বসন্ত তার প্রাণে কী দিয়ে গ্যালো? তার সেটুকুই তার শেষ পারানির কড়ি।
আবু সৈয়দ আইয়ুব সাহেব ওনার ‘পথের শেষ কোথায়’ নামের বিদগ্ধ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ডাকঘরের অমলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি। তবুও ও মোর মরণ তুমি আসো বড় চুপি চুপি ফেলে চরণ। অমল তো আমরা সবাই। সংসারের বাতায়ন প্রান্তে বসে শুধু স্বপ্নচয়ন। অথচ আমরা সবাই মৃত্যুকে অস্বীকার করি। শ্যামার উত্তীয়? তাকে তো আমরা ভুলে যেতে চাই। কিম্বা মুক্তধারা? সোনার খনির রুদ্ধজীবন অন্ধকারে কে প্রথম প্রাণ দিয়ে প্রাণের আলোরঅমল কমলখানি ফোটায়? কিশোর অভিজিৎ। সেও একজন তরুণ।
তবুও কর্ণ নয় কিশোর নয়। রঞ্জন? সেও নয়। নন্দিনী আর রাজাকেই আমরা মনে রাখি। আমরা জীবনমুখী। অথচ হাতে হাত রেখে পাঞ্জা ধরতে ভয় পাই। যদি মৃত্যুকে মেনে নিয়ে বিষণ্ণ মুখে রবীন্দ্রনাথের শেষ শয্যা থেকে বিধান রায় মাথা নীচু করে চলে যেতেন? আমরা বলতাম কবি মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। কিশোর বা অমল অথবা মুক্তধারার সেই কিশোর অভিজিত (দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একজনও বালিকা নেই) – কাউকেই আমরা চিনি না। মনে রাখি না। কেবলমাত্র বসন্তের – বর্ষার বহুচর্চিত বাতায়নগন্ধী গানগুলোই কি রবীন্দ্রনাথ?
এই প্রজন্মের ডাক্তার মৃত্যুকে চোখ তুলে প্রতিস্পর্ধা দ্যাখায় দুয়ার এঁটে অবশ্যম্ভাবীকে থামানোর চেষ্টা করে – বারবার হারে, মার খায় তবুও লড়ে যায়। রক্তকরবীর কিশোরের মতো, মুক্তধারার সেই বালকের মতো – এ লড়াই জারি থাকবে। ডাক্তার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে ভিয়েনায় জাত ইগনোজ ফিলিপ সেম্মেলউইজের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলি? ১৮১৩ ১লা জুলাই জন্মেছিলেন।পেশায় ডাক্তার। উনি প্রথম খেয়াল করেন হাসপাতালে ডাক্তারের হাতে প্রসূতি আর শিশুমৃত্যুর হার ধাত্রী বিভাগের আয়াদের হাতে প্রসবের থেকে বেশী। মনে রাখতে হবে তখনও জীবাণু আবিষ্কার হয়নি। সংক্রমণ মানেই সবাই জানতো এটা দূষিত বাতাস থেকে হয় । পাস্তুর বাবু তখনও বহু অনাগত যুগ দূরে। সেম্মেলউইজের এক বন্ধু গ্যাংগ্রীন রোগে মৃত এক রোগীর শবব্যবচ্ছেদ করার সময় শবব্যবচ্ছেদের ছুরিতে হাত কেটে ফ্যালে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই গ্যাংগ্রীন হয়ে মারা যায়। সেই “জুনিয়র” ডাক্তার সেম্মেলউইজ বন্ধুদের বলেন শবব্যবচ্ছেদ করে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। ফলাফল? কয়েক মাস পর সেই হাসপাতালে ডাক্তারের হাতে শিশুমৃত্যু আর প্রসূতি মৃত্যুর হার শূন্যতে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু গোটা সমাজ (চিকিৎসকরাও) সেম্মেলউইজের বিরুদ্ধে চলে গেল। কেউ মানলো না ক্যাডাভার পার্টিকেলের কথা, মানলো না হাত ধোয়ার উপকারিতা। “কী? এ্যাতো বড়ো কতা? চিকিৎসকের হাতে কি বিষ মাখানো থাকে?”
গল্পটা অনেক বড়ো। ছোট করে বলি। আবার মৃত্যুহার বেড়ে গ্যালো।
অভাগা সেম্মেলউইজ অনেক অনেক পত্রিকায় লিখলো। অনেক সভা করলো। কিন্তু বিতাড়িত হলো সেই লড়াকু ডাক্তার। বৌ ছেলে সমাজ সবাই এমনকি চিকিৎসকরাও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। কর্মহীন পাগল মাতাল ডাক্তার যেখানে যায় সেখানেই সবাইকে হাত ধুতে বলে আর মার খায়। গোটা পৃথিবীতে কেউ এগিয়ে এলো না সেম্মেলউইজের সমর্থনে। আমি কি কবিবর জয় গোঁসাই-এর মতো করে বলবো যারা হাত ধুয়েছিলো? তারপর? আমাদের বাংলার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো আত্মহত্যা। একলা ঘরে মৃত্যুর গান। মরণ রেরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।
ও, হ্যাঁ সুধাকে বলে দিও, লুই পাস্তুর তাঁকে ভোলেননি, সম্মান জানিয়েছেন।