শান্তিনিকেতনের প্রবীণ অধ্যাপকরা একবার তাঁদের বাসগৃহের জীর্ণ শীর্ণ দশার প্রতিকার চেয়ে দল বেঁধে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন যাকে আজকের ভাষায় ডেপুটেশন বলা চলে। সম্প্রতি নতুন পদে যোগদান করে সেই ঘটনাটির কথা মনে এলো।
চাকরি জীবনের সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে এবং শুনে আসছি যে আমলাকুলের গুরুত্বের সবিশেষ পরিচয় হল তাঁদের অফিস কক্ষের আয়তন অর্থাৎ দৈর্ঘ্য প্রস্থের পরিমাপ হল তাঁদের পদের গুরুত্বের সমানুপাতিক। যিনি যত বড় পদে আসীন তাঁর ঘরখান ঠিক তত বড়। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কক্ষও সেই নিয়মের ব্যতিক্রমী নয়, এবং কালের অমোঘ নিয়ম অনুসারে বাতানুকুলও বটে।
এত কথা লেখার প্রয়োজন হত না, যদি না দেখতে পেতাম যে ওই সমানুপাতিকতার নিয়মের কি নির্মম প্রয়োগ। অন্যান্য আধিকারিক ও করণিক কুলের কাজের জায়গা এতটাই পরিসরে ছোট, যে ইংরেজিতে যাকে বলে এলবো স্পেস সেটুকু পর্যন্ত নেই। কি আশ্চর্যের বিষয়, দিনের পর দিন তাঁরা বিনা বাক্যব্যয়ে ওর মধ্যেই কাজ করে চলেছেন। দল বেঁধে তাঁরা কোনোদিন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দ্বারস্থও হন নি।
আবার রবীন্দ্রনাথে ফেরা যাক। অধ্যাপকের দল উত্তরায়ণে গেছেন দল বেঁধে। সেটি তখন খড়ের ঘর। রবীন্দ্রনাথ সাধ করেই তাতে বাস করতেন, মাথায় ছিট ছিল তো। এত জন অধ্যাপককে আসতে দেখে উনি বুঝলেন বিষয় গুরুতর। তিনি কিছু বলার আগে এক অধ্যপক বললেন, “আপনাকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে দেখছি”। “ক্লান্তির আর অপরাধ কী মশায়, বৃষ্টির জল থেকে আত্মরক্ষায় যদি সারারাত তক্ত পোষ টানাটানি করতে হয়, তবে ভোরবেলা মুখ প্রফুল্ল দেখাবে, এমন প্রত্যাশা করা উচিত নয়।”। তাঁর উত্তরে স্তম্ভিত হয়ে অধ্যাপকরা কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকলেন, তারপরে একজন বলে উঠলেন, “আচ্ছা, আপনি এতো কষ্ট করতে যান কেন? পাকা একটা বাড়িতে থাকলেই তো পারেন। রবীন্দ্র স্মৃতিচারণকার এর পরে মন্তব্য করেছেন যে – এই কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেটি শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার তো মনে হয় শুধু শান্তিনিকেতন এর ইতিহাসে কেন, যে কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানের ইতিহাসে লিখে রাখা উচিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দেখুন, আমার ছাত্রদের ও অধ্যাপকদের খোড়ো ঘরে রেখে আমার পক্ষে পাকাবাড়িতে থাকা সম্ভব নয়।” তারপরে একটু থেমে থেকে যোগ করেন, “এত ভোরে আপনাদের আসার কারণ বুঝতে পেরেছি, মনে থাকবে।” এর পরে চেয়ে চিন্তে অর্থভিক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই ব্যবস্থা করেছিলেন পাকা বাড়ির সবার জন্য।
আমাদেরও একদিন হবে, ছোট বড় সব কর্মচারীর কাজের জন্য বসার পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা হবে। রবীন্দ্রনাথ পথ দেখাবেন।