ক্লাসের সবাই খুব উত্তেজিত। তারা সবাই মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী। ক্লাস টেনে ছেলেমেয়ে বেশি না। গোটা আষ্টেক। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশই বাড়ীতে থাকে। কয়েকজন শুধু হোস্টেলে থাকে। ক্লাস টেনের একমাত্র বীণা সামন্তই গার্লস হোস্টেলের।
আলোর দিশা নামের এই স্কুলে অন্ধরা পড়াশুনো করে। রেজাল্ট বেশ ভালো হয়। এই ব্যাচটা আবার তার মধ্যে বেশি ভালো। এবারের রেজাল্টের ওপর সবার খুব ভরসা।
তাদের উত্তেজনার কারণটা হল, তাদের বকুলস্যার জ্যোৎস্না কী কেন আর সেটি দেখতে কেমন সেইটি অনেক আগেই নিচু ক্লাসে বুঝিয়েছেন। পৃথিবী চাঁদ আর সূর্যের অবস্থান মুখে বলেছেন তো বটেই, তারা স্যারের জোগাড় করা মডেলে হাত দিয়ে ব্যাপারটা ঠিক ঠিক বুঝেছে দুই তিন ক্লাস আগে।
কিন্তু এই স্যার চলে যাবেন। আজ পূর্ণিমা। স্যারের খুব ইচ্ছা তিনি আজ তাদেরকে পূর্ণিমা অনুভব করাবেন!
এই স্কুলের সবাই জন্মান্ধ নয়।
কেউ কেউ প্রথমে দেখতে পেত। কিন্তু পরে অসুখের কারণে চোখ খারাপ হয়েছে। খারাপ এতটাই যে বইয়ের লেখা পড়তে পারে না তারা।
আবার বীণার মত কেউ কেউ আছে যারা জন্মের থেকেই দেখতে পায় না। এই দুই ধরণের মধ্যে তফাত আছে। যারা আগে দেখতে পেত এখন পায় না তারা তাদের অন্ধ দশায় কেউ পৃথিবীকে দেখে কুয়াশাময় ঝাপসা। যেন দু একটা আলোর কণা কোনও রকমে তাদের চোখকে উদ্দীপ্ত করছে। আর যাদের সেটাও এখন আর হয় না, তারা দেখে অন্ধকার ঘোর কালো একটা জগত। তা হলেও আলোকিত পৃথিবী তাদের স্মৃতি থেকে মোছে না। তারা দৃশ্য কল্পনা করতে পারে।
কিন্তু জন্মান্ধ বীণার মত যারা, তারা দেখা ব্যাপারটা কী সেইটাই বুঝে উঠতে পারে না। কাজেই রঙিন কোনও দৃশ্য তাদের কল্পনাতেও আসে না।
স্বপ্ন দেখার বেলাও তাই। যারা আগে দেখতে পেত তারা স্বপ্নে জীবন্ত দৃশ্য দেখে চলমান মানুষ পশু পাখি। জন্মান্ধরা স্বপ্নে শুধু শব্দ শোনে, ছোঁয়া পায়। তাদের স্বপ্নে কোনও দৃশ্য থাকে না।
বকুল স্যার এমনিতে সাইন্সের স্যার। অন্ধদের সাইন্স নিয়ে পড়া সমস্যা। বিজ্ঞান বিষয়ের মূল কথাই হল পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্ত। এই পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণেই যত সমস্যা। পর্যবেক্ষণের মূলেই আছে বীক্ষণ। মানে দেখা। কিন্তু অন্ধরা দেখবে কী করে? সেইটাই সমস্যা।
স্যার কিন্তু বলেন দেখতে না পেলেও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া জানা এই সবই করা যায়। ছুঁয়ে বোঝা যায় এই রকমের ডায়াগ্রাম আর নানান মডেল স্যার আনিয়েছেন। আজকাল নাকি কম্পিউটার শিখে নিলে ব্যাপার আরও সোজা। এই স্কুলে কমপিউটারের গ্র্যান্ট বার করতে বকুল স্যারের খুব চেষ্টা।
অন্ধ ছাত্ররা ব্রেইলে পড়াশুনো করে। ব্রেইলে জ্যোৎস্না বানানটা শেখানো যায়। কিন্তু জ্যোৎস্না দেখতে ঠিক কেমন সেটা ব্রেইল দিয়ে বোঝানো অসম্ভব। স্যার নিজে অন্ধ কিন্তু জন্মান্ধ নন। তিনি একদা জ্যোৎস্না দেখেছেন।
তিনি ওদের বলেছেন হালকা চাঁপা ফুল রঙের চাঁদ যেন বাতাসে গুলে গেছে এই রকমের এক আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আকাশের গা বেয়ে। বর্ণনা করেছেন, সেই আলোয় সত্যিগুলোকে মনে হয় মিথ্যে আর সমস্ত মিষ্টি মিথ্যেগুলোকে মনে হয় সত্যি। আরও যে আশ্চর্য কথাটা বলেছেন তা হল, ঠিকঠাক জ্যোৎস্নাকে পেতে গেলে চোখ খুলতেও হয় না। জ্যোৎস্নার মাঝে বসে থাকলে তরল আলো গা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে তা নাকি অনুভব করা যায়।
স্যার বলেছেন, সবাই মিলে একদিন পূর্ণিমা রাতে সেই জ্যোৎস্না মাখা হবে ইশকুলের সামনের মাঠে বসে। এদের মধ্যে বীণা একমাত্র ভাল গান গাইতে পারে। অন্যরা মোটেই পারে না তা না। কিন্তু বীণার গানের ব্যাপারে গরজ বেশি। সে সান্ত্বনা দিদিমণির কাছ থেকে একখানি গান তুলেছে যত্ন করে। ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।’
তার ইচ্ছা জ্যোৎস্না দেখার দিন, সবার যখন সারা গায়ে জ্যোৎস্না মাখামাখি, সে এই গানখানি গাইবে।
বকুল স্যারের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের এই মেলামেশা নিয়ে এই গ্রামাঞ্চলে কথা উঠেছে। ওঠাটা স্বাভাবিকও। মাস্টার কেন তার স্টুডেন্টদের সঙ্গে এত মিশবে। অন্ধ হলেও হাত পা আঙুল আর কী বলে অন্যান্য ইয়েটিয়ে সবই আছে। মেয়েদের কথা ভাবতে হবে না?
আর আজকাল তো শোনা যায় ছেলেতে ছেলেলেতেও। কাজেই গার্জিয়ানদেরই সতর্ক থাকতে হবে। মেয়েদের ব্যাপারে তো বটেই, ছেলেদের জন্যেও। এই সব কথায় অভিভাবকদের মাথা সুধীরবন্ধু বাঁড়ুজ্যে আর ইয়াকুব মোল্লা একমত।
ইয়াকুবের অন্ধ মেয়ে রেহানা সুলতানা পড়াশুনোয় ভালো। সে বাণীর খুব বন্ধু। তার বাড়িতে পর্দা খুব। স্কুলে আসে সর্বাঙ্গ বোরখায় ঢেকে। হাতে কালো হাত মোজা। স্কুল রওনা হবার আগে তাকে তাকে আব্বা ইয়াকুবের কাছে গিয়ে দেখাতে হয়, পর্দায় কোনও ফাঁক পড়ল কি না। স্কুলে এসে এমনকি প্রখর গ্রীষ্মেও একটু আলগা দেবার পারমিশন নেই।
রেহানা তার মায়ের কাছে গজগজ করে। ‘ও আম্মা, সেখানে তো সবাইই অন্ধ। আমাকে দেখবে কে?’
ইয়াকুবের বিবি মেয়েকে বোঝায়, ‘আল্লার ইচ্ছায় তোমার চোখে এই বদ নসিব। তাই বলে তোমার আদব লেহাজ তো বারণ না। বরং তোমার বেলায় বেশি। তুমি তো আর দেখতে পাচ্ছ না কে তোমার কোন অঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছে?’
আম্মা এমনিতে তুই তুই বলে কথা বলে। কিন্তু এই সব কথাকে ভারি ওজনদার করার জন্য এখন তুমি তুমি।
রেহানার নানিও তাকে বলেছে এইরকমের সাবধানে থাকার কথা। মেয়েদের আদব লেহাজের কথা কেতাবে লেখা আছে। হুজুরেরাও বলেছে।
রেহানা তার এই সব গোপন কথা চুপি চুপি বীণাকে বলে। ‘এই যে আমরা অন্ধ, আমাদের গুনাহ্ হবার চান্স খুব বেশি। আমরা তো জানতেও পারব না কে আমার কোন অঙ্গ দেখছে। ইবলিশের চোখ একবার দেখবে, দুবার দেখবে, তিনবার দেখলেই গুনাহ্! একবার ছুঁয়ে ফেললেও তাই। গুনাহ্ মানে বুঝলি তো? পাপ… পাপ!’
রেহানা বীণার অনেক গোপন কথা জানে। বীণাই ওকে বলেছে, স্বপ্নে ও নাকি বকুল স্যারের সঙ্গে কথা বলে। রেহানা জানে, বাস্তব সামাজিক কারণেই বীণার এই সব স্বপ্নের কোনও মানেই হয় না। কিন্তু স্বপ্নকে সেই কথা তো বোঝানো যায় না!
বকুলমাস্টার তার মেসবাড়ি থেকে স্কুলের দিকে আজ একটু অন্যমনস্ক ভাবে রওনা হল। আলোর দিশা বলে এই স্কুলটা এক নামী এনজিও চালায়। তার যদিও অ্যাপয়েন্টমেন্ট সাইন্স টিচার বলে, কিন্তু তাকে সব রকম ক্লাসই কখনও কখনও নিতে হয়।
কাল থেকে সে ছুটি নেবে। অনেক দিনের ছুটি। লম্বা চিকিৎসার ব্যাপার। তার চিকিৎসার কাজ ঠিকঠাক মিটে গেলে মানে দৃষ্টি ফিরে পেলে হয়তো আর পড়াবে না এই স্কুলে। এই স্কুলে চোখ ভালো এই রকমের অন্য টিচার আছেন। কিন্তু তার চাকরিটা হয়েছে চক্ষু প্রতিবন্ধী কোটায়। জব পারমানেন্ট না। চোখ যদি সত্যিই সেরে যায় অন্ধত্বের অজুহাতটা থাকবে না। ম্যানেজমেন্ট বলেছে সে ক্ষেত্রে কলকাতার অফিসে হয় তো কাজ পাবে সে।
আকাশে মেঘ করেছে। স্কুল শুরু হতে দেরি আছে। ইলশেগুড়ি মতন বৃষ্টি পড়ছে। স্কুলে ঢুকবার মুখে যে চায়ের দোকান সেইখানে ঢুকল বকুল। দোকানে ক্রেতা আর কেউ নেই। দোকান অবশ্য খুলেছে অনেক আগেই। দোকানের মালিক শশধর দাস আর দোকানের শিশু শ্রমিকটি কাজ শুরু করেছে অনেকক্ষণ। কাজ বলতে চা তৈরি করা। আর ক্রেতাদের ছোটো কাচের গ্লাসে করে সেই চা দিয়ে আসা। সঙ্গে বেকারি বিস্কুট বা সস্তা কেক। শশধর চা তৈরিকে কাজ বলে না। বলে ‘ব্যবসা বাণিজ্য’। বকুলকে বসতে দেখে সমাদর করে বলে, ‘আন্ধা স্যার, এককাপ স্পেশাল মালাই দেই? মেঘের কারণে আজ ব্যবসা বাণিজ্যের হাল বড়ই খারাপ!’
শশধর খেয়াল করে না, আন্ধা স্যার বলে ডেকে সে অযথাই বকুলকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, তার চোখে না দেখতে পারার কথাটা। সে সম্ভবত ছোটোবেলায় পড়েনি কিম্বা পড়ে থাকলেও ভুলে গেছে কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিতে নাই।
সে কিন্তু আসলে জানাতে চায়, প্রতিবন্ধী বলে বকুলকে মোটেই অবহেলা করা হচ্ছে না। শিশু শ্রমিকটিকে সে তাড়া দেয়, ‘ও চাঁদু তাড়াতাড়ি আন্ধা স্যারকে চায়ের গেলাসটা দে রে’!
এই শ্রমিকটি প্রকৃতই শিশু। শিশুটির নাক দিয়ে সামান্য শিকনি গড়াচ্ছে। অন্য সময় হলে সে হয় তো কাঁধের গামছা বা জামার হাতায় মুছে নিত। বকুল অন্ধ বলে চাঁদু সেই অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় কাজটা করে না।
চায়ের কাপটা বকুলের সামনে রাখতে রাখতে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার নাম চাঁদু না স্যার, আমি চান মিঞা’। এই যে প্রায় হিন্দু নামের বদলে নিজের নামের সাম্প্রদায়িকরণ সে করে, তার কারণ সে কীভাবে যেন জেনেছে, বকুল মাস্টারের ডাকনাম বকুল হলেও তার আসল নাম শওকত আলি।
চাঁদুর নিজের পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে এ পাশে এসেছিল। আসার পর তার আব্বা কোথায় দূরে কাজে গেছে। আর আম্মা তারপরে শিশুটিকে রেখে তিনদিনের জ্বরে মারা গেছে। অনাথ শিশুটিকে রাস্তায় ঘুরতে দেখে শশধর তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
শিশুটির মা তাকে চাঁদ মিঞা বলে ডাকত। বকুলের কাছে বলা তার নিজের নাম সম্বন্ধীয় এই ঘোষণাটুকু তাকে এক ধরণের সাম্প্রদায়িক নৈকট্য আর নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। এই স্যারের কাছে লেখাপড়া শিখতে পারলে ভালো হত। কিন্তু অন্ধ মানুষ তাকে কীই বা শেখাবে এই জাতীয় একটা সংশয়ও তার রয়েছে।
অবশ্য চক্ষুষ্মানদের দুনিয়াও তাকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেনি তেমন। এই স্কুলে সে শুনেছে মিড ডে মিলেরও একটা ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু শিশু চান মিঞা চোখে দেখতে পায়। এই চোখে দেখতে পাওয়াটা এক সমস্যা। বিরাট সমস্যা। চান মিঞা এখনও জানে না বকুল স্যার কালকে চলে যাবে।
আপাতত আজই স্কুলে শেষ দিন বলে আজ পড়ানো তেমন হবে না। শওকত আলি বকুল নামের এই যুবকের মনে একই সঙ্গে নানা রকম টানাপোড়েন চলছে। তার চোখ ভালো হয়ে গেলে, এই স্কুলে পড়ানোর কাজটা বদলে যাবে। অন্য রকম কাজ হয় তো দেওয়া হবে তাকে। এক রকমের উত্তেজনা আর আশা আকাঙ্ক্ষা ভরা উদ্বেগে রয়েছে সে।
হেড দিদিমণি বেরোবার আগে খুব স্নেহভরে বললেন , ‘রওনা হবার আগে সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ো বকুল। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো।’
বকুল একটু দ্বিধাভরে লজ্জিত গলায় বলল, ‘আজ সন্ধ্যের পরও একটু থাকব। ক্লাস টেনের কয়েকজনকে একটা ব্যাপার দেখানোর কথা দেওয়া আছে।’
এই কারণেই এই দৃষ্টিহীন শিক্ষকটিকে খুব ভালোবাসেন বড়দিমণি। খুবই মায়াভরে সে বিজ্ঞানের ব্যাপারটি শেখায় ছাত্র ছাত্রীদের। সে নিজে চোখে দেখতে পায় না বলে এই ব্যাপারে খুবই ইনোভেটিভ। ক্লাস সিক্সে দ্রবণ দ্রাব্য বোঝানোটি বড়দি নিজে দাঁড়িয়ে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। চোখ থাকা ছাত্ররা চোখে দেখে খুব সহজেই বুঝতে পারে গ্লাসে জলের মধ্যে লবণ বা চিনি ঢেলে নাড়লে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু অন্ধদের ব্যাপারটা বোঝানো যাবে কী ভাবে? বকুল প্রথমে গ্লাসে জলের মধ্যে বালি ঢেলে নাড়ে। তারপর সেটি ফিল্টার পেপার দিয়ে ছেঁকে দেখায় জল আর বালি আলাদা হয়ে গেল। তার পর একই কাজ সে করে জলের ভেতর লবণ ঢেলে। দেখায় ফিল্টার পেপারে লবণ আটকায়নি। পুরোটাই মিশে গেছে জলের সঙ্গে। বুঝতে সময় বেশি লাগলেও ব্যাপারটা মাথায় গেঁথে যায় ছাত্রদের।
কিন্তু আজকের ব্যাপার ঠিক সেই রকমের কোনও বিজ্ঞানের বিষয় না।
বকুল লজ্জায় হেড মিস্ট্রেসকে আজ কী দেখানোর কথা সেই গোপন কথাটি বলতে পারেনি। আজ তার চলে যাবার আগের দিন। আজ পূর্ণিমা। বকুল ছাত্রছাত্রীদের কথা দিয়েছে সে তাদের আজ জ্যোৎস্না দেখাবে। দেখাবে কথাটা ঠিক নয়। বোঝাবে… কী ভাবে অনুভব করতে হয়। এক ধরণের প্র্যাকটিক্যালও বলা যেতে পারে! কিন্তু এই ধরণের প্রায় অবাস্তব প্র্যাকটিক্যালের কথা সবাইকে বলা যায় না।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামবে এখুনি। কিন্তু সারাদিনে টিপটিপ বৃষ্টি হল তো বটেই, সন্ধ্যের দিকে মেঘ ভিড় করে এল আকাশ কালো করে।
রেহানার খুবই আসার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তার আম্মা তাকে বলেছেন, স্কুলের ছুটির পরে মাস্টার হাজার ভালো হলেও তার ডাকে স্কুলের সামনের মাঠে সন্ধ্যে বেলায় যাবার কোনই কারণ থাকতে পারে না। তিনি ভয়ে ভয়ে আছেন। ইয়াকুব সাহেবের কানে এই সব কথা গেলে স্কুলে যাওয়া পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি মাঝে মধ্যেই স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, স্কুলে মেয়ের গায়েটায়ে হাত বোলায় কি না কোনও হারামজাদা মাস্টার। বিশেষ করে শওকত নামের এক বিজ্ঞান শিক্ষকের জনপ্রিয়তার খবর পেয়ে তিনি খুবই ক্ষিপ্ত। ব্যাপার কী? তার এত উৎসাহ কীসের? অথচ আম্মা জানেন মেয়ে অন্ধ হলেও লেখাপড়া ব্যাপারটা জরুরি।
আজ পূর্ণিমা বটে কিন্তু আকাশে চাঁদ ওঠার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সারাদিনই আকাশে মেঘ।
ঝোড়ো আবহাওয়া আর বৃষ্টি ছিল বলে অন্য ছাত্রছাত্রীরা কেউই আসেনি।
বকুল একলা দাঁড়িয়ে।
টিপটিপ বৃষ্টি একটু ধরেছে। হোস্টেল থেকে বীণা এসেছে, ছবি মাসীকে সঙ্গে নিয়ে। হোস্টেল সুপারিন্টেনডেন্ট সান্ত্বনাদি ছবিকে বলে দিয়েছেন, যাই প্র্যাকটিক্যাল হোক একঘণ্টার মধ্যে যেন ফেরত আসে। ছবি এই সব প্র্যাকটিক্যালের কিছু বোঝে না। কিন্তু এই মাস্টারটিকে সে স্নেহ করে।
আর রয়েছে চান মিঞা। এই শিশুটিকে মাস্টারমশাই সকালে বলেছেন আজকের জ্যোৎস্না দেখানোর ক্লাসের কথা। সে খুব আগ্রহের সঙ্গে বকুলের সঙ্গে রয়েছে, কেন না সে জানে আজ কোনওমতেই জ্যোৎস্নার আলো দেখা যাবে না। তবে কি মাস্টারমশাই কোনও জাদুমন্ত্রে জ্যোৎস্না নামাবে?
বকুল নিজেও জানে আজ চাঁদ দেখা যাবে না। কিন্তু সে জানে তবুও চরাচর ব্যাপী জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশ ঢাকা মেঘের ওপর দিয়ে। পিছলে যাচ্ছে সেই অপার্থিব চাঁপা রঙের স্বপ্নময় কুহেলিকা।
আর কেউ আসেনি বলে জ্যোৎস্না দেখার অনুষ্ঠান মোটেই জমল না। জমার কথাও না। জ্যোৎস্না অনুভব করা নিয়ে যা যা বলবে ভেবে রেখেছিল বকুল তার কিছুই বলা হল না।
বীণাই বরং বলল, ‘স্যার, আমি স্পষ্ট বুঝছি আলোর ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী, আপনি আমি সবাই। হ্যাঁ স্যার আমি বুঝেছি।’ বলে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল সে। তারপর বলল, ‘আজ আমার একখানি গান গাইবার কথা ছিল। গাই?’
আগে ঠিক করে রাখা সেই গানখানি না গেয়ে, হাহাকারের মত গেয়ে উঠল সে। ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার… পরাণসখা বন্ধু হে আমার…’
অবাক হয়ে শুনছিল ছবিমাসী আর চান মিঞা।
সেই হাহাকারটুকু যেন গলে গলে পড়ছে বকুলের গায়ে মাথায়।
গাইতে গাইতে বীণা ভাবছিল, এই যে সে বলে ফেলল তার অন্ধ চাওয়াটুকুর কথা, পাপ হল কি তাতে? রেহানা শুনলে কি বলত, ‘এটা খুব গুনাহ্…?’