প্রাককথন
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একক মাত্রা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। দশ বছর পরে ফিরে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি। অন্য কথায় বলা যায়, আমরা রবীন্দ্র-পূজার বহুতর আয়োজনের মাঝে তাঁকে ভুলে থাকার অভ্যাস রপ্ত করেছি। রোগ হবার পরে হাসপাতাল ডাক্তারখানায় চিকিৎসা নিয়ে আমাদের যেটুকু হইচই, জনস্বাস্থ্য নিয়ে সেটুকুও নেই। ফলে কর্পোরেট আমাদের জন্যে স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করে দেবে, আমরা স্রেফ টাকার থলিটা জোগাড় করতে পারলেই ভূরিভোজে বসে যাব, নানাবিধ চিকিৎসা-বিভ্রাট সত্ত্বেও এমন ভাবনা আমাদের এখনও ছাড়েনি।
তাই পুরনো লেখাটি কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করে এখানে রাখছি। দীর্ঘ লেখায় ফেসবুকে পাঠক জোটে না। তাই লেখাটি ভেঙ্গে নিয়েছি চারটি পর্বে। প্রতিটি পর্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু এক-একটি পর্ব পড়লে তার বিষয় আলাদা করে পড়ে বুঝতে অসুবিধা হবার কথাও নয়।
পর্ব ১
রবীন্দ্রনাথ কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, গায়ক, অভিনেতা ইত্যাদি ছিলেন, তার ওপরে ছিলেন বড় মাপের একজন চিন্তাবিদ। শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর স্থানও আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। যে দিকটা আমরা কম জানি তা হল, গ্রাম-সংগঠনের জন্য তিনি জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলির এক বিরাট অংশ শিক্ষা ও পল্লী-উন্নয়ন নিয়ে লেখা। বিশ্বভারতী নিয়ে তিনি যখন লিখেছেন, সেখানেও এই দুটো বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর সমস্ত উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষা, এ-কথা বলাই যায়। এসবের বাইরেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ও ক্ষমতা বিভিন্ন দিকে তার শাখাবিস্তার করেছিল।
১৯২৯ সালে এক চিঠিতে তিনি প্রশান্ত মহলানবিশকে লিখেছিলেন, “তুমি তো জান আমি চিকিৎসাবায়ুগ্রস্ত …”। এটা নেহাত কথার কথা নয়। ডাক্তারি পাশ করেননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বহু ডাক্তারি বই তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন, আর নিজের ওপরে ও আত্মীয়-বন্ধুর ওপরে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করা তাঁর প্রায় নেশাই ছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও গ্রামের গরীব মানুষদের ওপরেও নিয়মিতভাবেই ডাক্তারি করেছেন। মূলতঃ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন তিনি, তবে পরে বায়োকেমিক পদ্ধতি বেছে নেন।
অজানা কোনও কারণে চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষক ও প্রবন্ধকারগণ চর্চা কম করেছেন। তবে রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষের সময় থেকে বিগত দশ বছরে চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও দু-একটি বই চোখে পড়ল। কিন্তু তাতে জনস্বাস্থ্য প্রায় অনুচ্চারিত। জনস্বাস্থ্য ব্যাপারটা সাধারণ চিকিৎসার থেকে আলাদা। তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্রে আলাদা প্রবন্ধও সেরকম নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বলতে গিয়ে আমি তাঁর কয়েকটি লেখাপত্র, কর্ম ও চিন্তার কথা তুলে ধরব। এগুলি অপরিচিত কিছু নয়, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে এদের মূল্যায়ন হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়ন মডেল ও জনস্বাস্থ্য
রবীন্দ্রনাথের জনস্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে ভাবতে গেলে অবশ্যই তাঁর (জনের) স্বাস্থ্য নিয়ে লেখা ও বলা কথাগুলির গুরুত্ব রয়েছে। তিনি জনস্বাস্থ্য নিয়ে স্বয়ং যে কাজকর্ম করেছিলেন সেগুলির বিশ্লেষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। শান্তিনিকেতনে, বিশেষ করে শ্রীনিকেতনে, তিনি পল্লীগঠনের যে কাজ হাতে দিয়েছিলেন তার মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ক, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক, চিন্তাভাবনা কিছুটা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগ নিয়ে তিনি বহু আক্ষেপ করেছিলেন। ম্যালেরিয়া নিয়েই তাঁকে বহুবার খেদোক্তি করতে হয়েছে। তাঁর স্বভাবধর্ম তাঁকে কেবল আক্ষেপ আর খেদ করে স্থির থাকতে দেয়নি। তিনি নির্দিষ্ট কর্মসূচী নেবার চেষ্টা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়নের মডেলে স্বাস্থ্য উন্নয়ন একটি মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। এই মডেলটি আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর পরিকল্পনার একটা মৌলিক এলাকা ছিল স্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য কথাটা তখনও এমন চালু হয়নি, হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ওই কথাটাই ব্যবহার করতেন। তাঁর মডেল নিয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পল্লীউন্নয়নের গোড়াতেই কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার বলে তিনি ভেবেছিলেন ও পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মধ্যে রয়েছে আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, স্বাস্থ্য, পল্লী সংগঠন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের যে জায়গাগুলো আলাদা করে তৈরি করা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া বিতাড়ন, স্যানিটারি ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রসব (মা ও শিশুর যত্ন), কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম। প্রশিক্ষণের মধ্যেও রয়েছে ধাত্রী-প্রশিক্ষণ। সুতরাং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে কাজ করছিলেন তাই নিয়েই আলাদা করে নিবন্ধ রচনা করা যায়।
কিন্তু আমি বর্তমানে সে প্রচেষ্টায় যাব না। কারণ আমার ধারণা, জনস্বাস্থ্য-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আসল অবদান তিনি কী কী করেছিলেন, সেখানে নয়। তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তার পুরো ফসল কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানোর চেষ্টা তিনি নিজে করে যেতে পারেননি। ফলে চিন্তাভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর মধ্যে দিয়ে তার যে সংশোধন-পরিমার্জনার প্রক্রিয়া চলতে পারত তাও সম্ভব হয় নি। এমনকি সেইসব চিন্তার যৌক্তিক পরিণতি কী কী হতে পারে তা নিয়েও তিনি হয়তো পুরোটা তলিয়ে ভাবেন নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে শান্তিনিকেতনে কিন্তু তিনি অনেকটাই সে চেষ্টা করতে পেরেছিলেন। তাঁর শিক্ষাভাবুনা কাজে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু স্বাস্থ্যভাবনা হাতেকলমে কাজে পরিণত হয়নি বললেই চলে।
“আমি দেশের কাজের মধ্যে একটি কাজকেই শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিয়েছিলুম; জনসাধারণকে আত্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠা দেবার শিক্ষা দেব বলে এতকাল আমার সমস্ত সামর্থ্য দিয়েছি । … অশক্তকে শক্তি দেবার একটিমাত্র উপায় শিক্ষা – অন্ন স্বাস্থ্য শান্তি সমস্তই এরই ‘পরে নির্ভর করে।” [‘রাশিয়ার চিঠি’]
সুতরাং তাঁর শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে ম্যালেরিয়া বিতাড়ন, স্যানিটারি ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রসব ও তৎপরবর্তীকালে মা ও শিশুদের যত্ন, কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম ইত্যাদিকেই কেবলমাত্র দেখলে চলবে না। তাতে ‘একটি গাছ দেখতে গিয়ে অরণ্যকে বিস্মরণ’ হয়ে যায়। অনেকেই শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান তৈরি, কোপাই-এর জলে আশ্রমের ছাত্রদের সাঁতার কাটানো, বা ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী থেকে ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’ খাওয়ানোর মধ্যে জনস্বাস্থ্যবিদ রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় খুঁজে পাবেন। বা নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাটা — “নিন নেপালবাবু, আপনার [আশ্রমের] ড্রেন তৈরির টাকা” — বলে দান করেছিলেন কিনা সে-বিতর্কের মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যভাবনার গুরুত্ব খুঁজবেন। আমি তাঁদের সঙ্গে তর্কে যাব না। আজকে আমি অন্য রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নেব তাঁর না-করা কাজের মধ্যে, মানুষ ও সমাজ নিয়ে তাঁর চিন্তার মধ্যে।
জনস্বাস্থ্যে জনগণের অংশগ্রহণ ও রবীন্দ্রভাবনা
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা নিয়ে যতটা আগ্রহ ছিল, যতটা হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ততটা ছিলনা। তার কারণ তিনি নিজেই স্পষ্ট করে বলে গেছেন। শিক্ষার যথার্থ ব্যবস্থা হলে মানুষ নিজেই নিজের ভাল করতে পারবে, আর সেটা সবচেয়ে বড় কথা। রবীন্দ্রের কাছে শিক্ষা হল সেই আলো যা মানুষকে তার নিজের কাজ করার ক্ষমতা দেয়। ব্রিটিশরাজ সেই শিক্ষা থেকে ভারতকে বঞ্চিত করে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাই কেড়ে নিয়েছে। সাইমন কমিশন ভারতের মানুষের ও সংগঠনের অনেক দোষ-ত্রুটি ধরে তারপর ইংরেজের এটুকু মাত্র দোষ কবুল করেছে যে, ভারতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সে-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, এ যেন চলতে ফিরতে হোঁচট খায় বলে কাউকে প্রচুর গালাগালি করে গলা খাটো করে বলা, ‘আমি অবশ্য ওর সব বাতি নিভিয়ে রেখেছি।’ [‘রাশিয়ার চিঠি’]
বিশ্বভারতীতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে অতি ছোট পরিসরে যেটুকু কাজ রবীন্দ্রনাথ করবার পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং কিছুটা করেওছিলেন, সেখানে তাঁর এই শিক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যে পৌঁছনোর প্রক্রিয়াটি দেখতে পাওয়া কঠিন নয়। আজকের ভাষায় একে জনগণের ক্ষমতায়নের দিকে একটি পদক্ষেপ বলে ভাবতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনায় ধাত্রী-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁর পল্লীউন্নয়নের কাঠামোতে ধাত্রী-প্রশিক্ষণ রয়েছে গ্রামের মেয়েদের প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসেবে, সে-ব্যাপারটা অত্যন্ত অর্থবহ।
“আমাদের মাননীয় বন্ধু ডাক্তার গোপালচন্দ্র চ্যাটার্জী যে কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন এ যদি শুধু মশা মারার কাজ হত তা হলে আমি একে বড় ব্যাপার বলে মনে করতুম না। দেশে মশা আছে এটা বড়ো সমস্যা নয়, বড়ো কথা এই – লোকের মনে জড়তা আছে। সেটা আমাদের দোষ, বড়োরকমের দুঃখ-বিপদের মূল কারণ সেখানে। ওঁরা এ কাজ হাতে নিয়েছেন, সেজন্য ওঁদের কাজ সবচেয়ে বড়ো বলে মনে করি। গোপালবাবু উপকার করবেন বলে কোমর বেঁধে আসেন নি।” [‘ম্যালেরিয়া’, অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটিতে কথিত, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪]
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে (জন-)স্বাস্থ্য চিন্তার আসল উপাদান এই নয় যে ঠিক কতটা উপকার করে দিতে পারা গেল। আসল কথা হল, সেটা সমাজের নিজস্ব বস্তু হয়ে উঠল কিনা, সমাজ সত্যি সেই শিক্ষাটা নিতে পারল কিনা। এবং শিক্ষা গ্রহণের পরে সেটা নিজেই নিজের কাজে লাগাবার জন্য সমাজ কতটা তৈরি হয়ে উঠল।
(ক্রমশ)
চিত্র পরিচিতি
রবীন্দ্রনাথ (চিত্রঋণ nobelprize.org)
তথ্যসূত্র
১) Ray PP, Biswas BC, Sen BK. Knowledge Communication in Tagore’s Model for Rural Reconstruction: An Overview. Annals of Library and Informational Study; 52, 3; 2005; 94-102
২) লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা উল্লেখ করা আছে।