“সেটা ছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস, অলিম্পিকের বছর।” অলিম্পিক সোনা জয়ী শুটার অভিনব বিন্দ্রার ভাষায়, “আমি সেই সময় অস্ট্রেলিয়াতেই একটা ফিটনেস ক্যাম্পে। একটু ঝামেলার মধ্যে আছি, কম্পিটিশন এর কথা ভাবলেই নার্ভাস হয়ে পড়ি, হার্ট রেট বেড়ে যায় অধৈর্য হয়ে পড়ি, মনে হয় ব্যাপারটা চট করে চুকে বুকে গেলেই ভালো।” এই সময় টিভি খুলে
অভিনব দেখেন টেস্ট হচ্ছে, দ্রাবিড় ব্যাট করছেন। ওই পরপর চল্লিশটা ডট বল খেলার সেই ইনিংস। কেমন ছিল সেটা ?
সেটা ছিল সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট, সিডনিতে। অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে চারশো তেষট্টি। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ওয়াসিম জাফর তিন রান করে আউট। ভারত এক উইকেটে আট। দ্রাবিড় এর সঙ্গী হিসেবে নেমেছেন ভিভিএস। এর পরে ই সেই ঘটনা। আঠেরো রান থেকে উনিশ রানে পৌঁছাতে গিয়ে দ্রাবিড় খেললেন চল্লিশটি ডট বল। উনিশ রানে পৌঁছানো মাত্র মাঠ জুড়ে দর্শকদের হাততালি। অস্ট্রেলিয়ার সমঝদার দর্শকরা অভিনন্দন জানালেন। উত্তরে রাহুল ও তার ব্যাট তুললেন।
দ্রাবিড়ের মুখোমুখি হয়ে এক কথপোকথনে বিন্দ্রা নিজেই রাহুলকে জানাচ্ছেন যে ওই ইনিংস টা তাকে কত কি শিখিয়ে গিয়েছিল, কিভাবে ধৈর্য জিনিসটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হয় একজন সফল ক্রীড়াবিদকে।
এই জিনিষ একবার নয়, বার বার করেছেন রাহুল। নিউজিল্যান্ড ট্যুর ১৯৯৯ সালে তিন নম্বর টেস্ট হ্যামিল্টন। উল্টোদিকে একের পর এক ভারতীয় ব্যটার রা ক্রিস কেয়ার্নস, ন্যাকমিলন ভেট্টরি এর বলে কুপোকাত হয়ে ফিরে যাচ্ছে প্যাভিলিয়নে, সাইমন ডুল এক হাত করে সুইং করাচ্ছেন। টেন্ডুলকার এর ৬৭ ছাড়া আর বলার মতো কোনো রান নেই। দ্রাবিড় এক দেয়াল এর মতো দাঁড়িয়ে নবম উইকেট অবধি। দিনের শেষে তিনশ চুয়ান্ন টা বল খেলে ১৯০ রান। একটাও ছয় নেই। ছয় মারার ঝুঁকি নেন নি টিমের কথা ভেবে। দেওয়াল নড়ে না, চরে না, কথা বলে না বিশেষ। দেওয়াল কেবল বছরের পর বছর ভরসা দিয়ে যায় বাড়িটা অটুট থাকবে, ভেঙে পড়বে না তাদের ঘরের মতো।
আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে নিশ্চিন্ত যাপনের মূর্ত প্রতীক রাহুল দ্রাবিড়। ফ্ল্যামবয়েন্সি নেই, উরনচন্ডে স্বভাব নেই। যেটা আছে সেটা হল সলিডিটি, নির্ভরতা। মিঃ ডিপেন্দেবল। বাড়ির বড় সন্তান। মুখ বুঁজে সংসার টেনে নিয়ে যাবে যাতে করে তার চেয়ে প্রতিভাবান ছোট ভাই বা বোন বিকশিত হতে পারে। রাহুল কি সেদিন মেলবোর্ন এ পারতেন না, হ্যামিলটন এ পারতেন না পয়েন্ট এর ওপর দিয়ে ছয় মারতে ? তাঁর কি সেই স্কিল ছিল না ? হ্যাঁ ছিল না। ছিল না যে সেটা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন তিনি শচিন নন, তিনি সেওয়াগ নন। তিনি দ্রাবিড়। যার সম্বন্ধে স্টিভ ওয়া বলেছিলেন, ” প্রথম দশ পনেরো বলে দ্রাবিড় কে আউট করার চেষ্টা করো, না পারলে ছেড়ে দাও, ওকে বাদ দিয়ে বাকিদের আউট করার চেষ্টা করো।
দ্রাবিড় গত পরশু সন্মানিক ডি লিট উপাধি প্রত্যাখ্যান করবেন, গতকাল প্রত্যাখ্যান করবেন অতিরিক্ত আড়াই কোটি পুরষ্কার এর অর্থ। আগামী কাল দ্রাবিড় কি করবেন কেউ জানে না। আমি জানি, সুধী পাঠক আপনি দ্রাবিড় নয়, বরং শচিন, সেওয়াগ, বিরাট, বা রোহিত এর ভক্ত। এরা সকলেই অসম্ভব প্রতিভাবান এন্টার্টেইনার। কোনো বিতর্ক হবে না। নাথিং রং ইন ইট। আমিও মোর ওর লেস আপনার দলে। কিন্তু দিনের শেষে ভারতীয় ক্রিকেটের বিশ্বজয় এর ইতিহাস যদি আপনাকে বলতে হয় আগামী প্রজন্মকে বুক ফুলিয়ে তাহলে আপনি কিছুতেই বাদ দিতে পারবেন না দ্রাবিড়কে। সৌরভ এর সেই বিশ্বজয়ের চ্যালেঞ্জিং টিম এর অশ্বমেধ এর ঘোড়া, যাকে যজ্ঞ শেষে বলি দেওয়া হবে, যার নামে কেউ জয়ধ্বনি হবে না, কোনো পাগল ফ্যান যার নাম গায়ে লিখে ঘুরবে বা গোটা বিশ্ব।
ক্রিকেটীয় মূল্যবোধ নিয়ে একটা লাইন ও যদি লিখতে হয় তাহলে কিন্তু একটাই নাম থেকে যাবে, যার নাম রাহুল শরদ দ্রাবিড়। একজন ক্রিকেটার, একজন এন্টেটেইনার একজন সেলিব্রেটি এই সব পরিচয় ছাড়িয়ে একজন রোল মডেল স্পোর্টস পারসন হিসেবে যার জুরি মেলা ভার। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রত্যক্ষ ভাবে দ্রাবিড় যুগের হয়তো অবসান হল, কিন্তু চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের মনে রাহুল শরদ দ্রাবিড়। স্যালুট।
Love ❤️
দ্রাবিড়ের প্রতি যোগ্য বিচার হলো এতোক্ষণে।
লেখাটায় চরম মুগ্ধতা।
সত্যিই তো তাই ক্যারিশ্মায় বিশ্বাসী নয়।
বিশ্বাস শব্দ টা ধীরজ অর্থাৎ ধৈর্য্যের স্হিরতার উপর।
রাহুল দ্রাবিড় সেটাই।ক্রিকেটের ইতিহাসের এক স্বর্ণাক্ষরের মতো জ্বলজ্বল নাম হয়ে থাকবেন চিরকাল।
যাঁর সঙ্গে তাঁর পারফরম্যান্স আর ব্যাখা করতে হয় না।আপ্লুতায় চোখ ভরে আসে কিছু বলার আগেই এভাবেই ঠিক এই লেখাটার মতো করে।🙏❤️