আমাদের ছাত্রাবস্থায় মেডিকেল কলেজগুলোয় কলকাতার সব দিকপাল জাঁদরেল ডাক্তাররা প্রফেসর ছিলেন। গাইনি ডিপার্টমেন্টে ছিলেন সেইরকম হাঁকডাকওলা ম্যাডামেরা। তবে তাঁদের অনেকেই ছিলেন আনম্যারেড।
উত্তমকুমারের সিনেমাগুলোর চিত্রনাট্য দেখে মনে হতো, তখন আমাদের স্যারেরা ছাত্রাবস্থায় সহপাঠিনী অপেক্ষা সেবিকা দিদিমণিদেরই বেশি সুনজরে দেখতেন। সে যাই হোক আমার গাইনিতে পথ চলা শুরু এরকমই এক ম্যাডামের হাত ধরে।হাঁকডাকে, কাজে-কম্মে অনেক স্যারেরাও তাঁর কাছে গুটিয়ে যেতেন। সব মেডিকেল কলেজের মতো আর.জি.করেও ঐ ডিপার্টমেন্টে একটা বিশেষ ঘর আছে যার নাম লেবার রুম। আমি নিশ্চিত যে ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই অনেক সহপাঠী সহপাঠিনী শপথ করে, আর যাই হই আমি গাইনো ডাক্তার হব না।
সে এক অদ্ভুত জায়গা। আলো-আঁধারীতে মেশা, লাইকার গন্ধে আমোদিত এক মহল যেখানে শুধুই ব্যথার বসবাস। বিস্রস্ত বেশবাসে নানারকম মহিলা নানাসুরে চিৎকার করে চলেছে। কারো কুনকনে কান্না, কারও গোঙানি, কার ও বা সশব্দে চিৎকার–আর পারছি না।
ওদিকে জুনিয়র ডাক্তাররাও সমান তালে, ‘আর একটু ব্যথা দাও মা, আর এট্টু ব্যথা।’কোথাও বা সিস্টার চিল্লাচ্ছেন, ‘এখন একদম ব্যাথা নয়, মুখ টিপে থাকো, যখন বলব তখন দেবে। এর ওপরে আবার সিস্টার-ইন-চার্জের গর্জন। আমাদের সময়ে লেবার-রুম ইনচার্জ নির্বাচন করা হতো খুব সম্ভবত গলার স্বরের ও শরীরের ওজন মেপে। আমি কোনো করিণারূপী, লতাকন্ঠী লেবার-রুম ইনচার্জের সাক্ষাৎ পাই নি।
এই ব্যথাঘরই অদ্ভুত ভাবে শান্ত হয়ে যেত, ম্যাডাম তাঁর বাহিনী নিয়ে রাউন্ডে আসার সময়। আহা তখন এই ঘরে কি এক স্বর্গীয় শান্তি! কোনো ব্যথা নেই, কোনো চিৎকার নেই, সিস্টার ইনচার্জের অডিও সিস্টেমে তখন সাইলেন্সার ফিট হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন ঘটল এক অঘটন। ম্যাডাম ঢোকার পরেও এক মহিলা চিৎকার করে চলেছে,’ওরে বাবারে আর পারছি না। কী ব্যথা গো, কি ব্যথা।’ বিশ্বাস করুন আমি যেহেতু বাহিনীর শেষে (জুনিয়রমোস্ট ইন্টার্ন) নানাভাবে ইশারায় চুপ করতে বলেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। ম্যাডাম ঘুরে মহিলার মুখোমুখি। হাত বাড়ালেন। বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাভস পরলেন। পরীক্ষা করলেন, “তোমার এখনো দেরী আছে। একদম চেঁচাবে না।চুপ করে শুয়ে থাকো।” এবং হ্যাঁ, আমাদের সবাইকে অবাক করে মহিলা ম্যাডামের মুখোমুখি, “তুমি কি বুঝবে গো এ ব্যথা।আঙ্গুল দিয়েই তুমি বুঝে গেলে ব্যথা হচ্ছি নে। বলি এ ব্যথা তো কুনোদিন খেলি নে। যার হয় সেই বোঝে এ ব্যথা কী ব্যথা।” আমরা হতভম্ব। অগ্ন্যুৎপাতের অপেক্ষায়। আমাদের সবাইকে অবাক করে ম্যাডাম চুপচাপ নিজের ঘরে। সিনিয়র হাউস-সার্জেন দাদা জানাল, আজ নো রাউন্ড। আমরাও সদলবলে ভোলার চা-এর দোকান। আজ একটা বিস্কুট এক্সট্রা।
তারপর? তারপর কি হল?
যে দু-দিন পেসেন্ট রইল, আমাদের কাছে ভি. আই. পি. ট্রীটমেন্ট পেল আর ম্যাডাম ওদিকে পা বাড়ালেন না। সত্যি সত্যিই, ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে–