নামমাত্র খরচে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার একটি কেন্দ্রে গেছিলাম। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করেন। ওখানে যেতে হবে বলে সকালের চেম্বার বন্ধ রেখেছিলাম। তবু ‘না না’ করেও ছ-সাত’জনকে দেখতেই হ’ল। আগে থেকে নাম না লিখিয়ে চেম্বারে এসে বসে থাকলে সবসময় ফিরিয়ে দেওয়া মুশকিল হয়ে যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক সময় দেখে দিতে হয়। ডাক্তারেরও যে অন্য জায়গায় ব্যস্ততা থাকতে পারে, সেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব হয় না। ফিরিয়ে দিলে সবারই মনে হয়, ডাক্তারের মানবিকতা বলে কিচ্ছু নেই। গায়ের চামড়াটা নির্ঘাৎ মানুষের নয়।
হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এদিকে রাস্তায় জ্যাম। কোনও এক রাজনৈতিক দলের কেউ একজন যাবেন। তাই তাঁর জন্য রাস্তা খালি করতে গিয়ে বাকি রাস্তা ঘেঁটে ঘ হচ্ছে। পৌঁছোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেশি সময় লাগলো। অনেকটা দেরি করে ফেলেছি। আমার গাইনিকোলজিস্ট বন্ধু অনেক আগেই রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছে। ফোনে ঘন ঘন তাগাদা আসছে। এদিকে গাড়ির চাকা এগোচ্ছে না। ভয় হচ্ছিল, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সবাই অপেক্ষা করতে করতে চলে যাবেন কিনা। হ’লে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।
বেশ খানিকটা দেরি হলেও অবশেষে পৌঁছোলাম। রাস্তা খুঁজে পেতে বিশেষ কিছু সমস্যা হয়নি। এবার চিকিৎসা কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পালা। ভুল আর ভয় দুটোই ভাঙলো। আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বাচ্চা আর (মূলত) মায়েদের ভিড়। সম্মিলিত গজগজ, বাচ্চাদের চ্যাঁ-ভ্যাঁ ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ রমরম করছে চারদিক। চিকিৎসা কেন্দ্রে মাটি আর বাঁশের দেওয়াল। উঁহু… সেটা ভেবে তীর্যক চোখে তাকাবেন না। ইচ্ছে করেই প্রেস্ক্রিপশনের ছবি দিলাম না। নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে যেত। দু-তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী আগে রোগের ইতিহাস বাংলা ভাষায় গোটা গোটা করে লিখে দেন। সেটা ডাক্তারি পরিভাষায় হয় না। অনেকটা এরকম, ধরুন, “তিনদিন ধরে জ্বর। সাথে সর্দিকাশি আছে। সকাল থেকে তিনবার বমি হয়েছে। এখন একশো দুই জ্বর।” নিচে বাংলায় ওজন, উচ্চতা, প্রেশার, পালস ইত্যাদি নেওয়ার জায়গা। আগে থেকে কোনও ওষুধ চললে সেটা লেখার জায়গা আছে। সবটাই বাংলায় লেখা। এবার সেটা চিকিৎসকের টেবিলে আসবে। চিকিৎসক পুরোটাই নিজের মতো ডাক্তারি পরিভাষায় (ইংরেজিতে) লেখেন। কখনো দরকার হ’লে বিশেষ কিছু নির্দেশ বাংলাতেও লিখতে পারেন। যথাসম্ভব অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাদ দিয়ে নিদানপত্র লেখা হয়। এই হ’ল পুরো ব্যাপার। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের অন্যান্য কেন্দ্রেও এভাবেই রোগী দেখা হয়।
দেখতে শুরু করলাম। প্রথম বাচ্চার বয়স পাঁচ। দেরিতে কথা বলতে শিখছে। এখনো খুব অল্পই কথা বলে। নানা রকম ভিটামিন, ক্যালশিয়াম, হজমি ওষুধ ইত্যাদি এ হেন জিনিস নেই, যেটা খায়নি। খেয়াল করলাম, বাচ্চা সব শুনছে কিন্তু একবারও আমার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাচ্ছে না। না, এটা ভয়ের জন্য নয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম, অন্য বাচ্চাদের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারে না। নিজের মতো খেলে, নিজের মতো থাকে। একইরকম খেলা খেলে। আকার-ইঙ্গিতে খুব কিছু বলতে পারে না। বাড়ির লোকজনের খুব একটা চিন্তা নেই। শান্ত বাচ্চা বলেই সবাই জানে। এ ধরনের বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি লাগবে সেটা হ’ল সময় আর ধৈর্য্য। সবে অটিজম দিবস গেল। এখনো এসব ব্যাপারে সচেতনতা প্রায় নেই বললেই চলে।
অপুষ্টি আছে মারাত্মকভাবে। এক বছরের কাছাকাছি বেশিরভাগ বাচ্চার ওজন সাড়ে পাঁচ থেকে সাত কেজির মধ্যে। তারা যে সবাই কম ওজন নিয়ে জন্মেছিল তেমনটা নয়। ছ’মাসের পর কখন, কীভাবে, কোন খাবার খাওয়াতে হবে সে ব্যাপারে প্রায় কারোরই পরিষ্কার ধারণা নেই। অবশ্য এই একটা ব্যাপারে সমাজের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত অংশেও সঠিক ধারণার বড্ড অভাব। একটানা, একসুর শোনা যায়, “বাচ্চা কিচ্ছু খায় না ডাক্তারবাবু। খিদে বাড়ার ওষুধ দিন।” বাড়ির খাবার দিতে বলে বলে হাঁফিয়ে যাই। যাদের বাড়িতে নিজেদেরই রোজ ভালোভাবে ডালভাতটুকু জোটে না, তাদের কাছেও বিজ্ঞাপনী প্রচারে **ল্যাক গুঁড়ো পৌঁছে গেছে। “সুদু বাড়ির খেলে বাচ্চা বাড়বে কিগরে বলঅ… এমনুতেই খেতে চায়নি। কী রকম রগা দ্যাখঅ…” এই হচ্ছে অবস্থা! এর উল্টোদিকে আছে সবকিছুর প্রাচুর্য। সবকিছুই অঢেল। বাচ্চা প্রতি আধ ঘন্টা থেকে সর্বাধিক এক ঘন্টায় কিছু না কিছু খেয়েই যাচ্ছে। তারপর জোর করে ভাত খাওয়াতে গেলে বাচ্চা বমি করে তুলে দিচ্ছে। বমি ঠেকাতে সপ্তাহে তিনবার করে ডাক্তার পাল্টানো চলছে। চোখে রিমলেস, হাল্কা লিপস্টিক রিনরিনে সুরেলা গলায় জানাচ্ছেন, “আমার বেবি কিছুতেই খায় না। ওকে কি **পেপটিনের বদলে ***জাইম খাওয়ালে ভালো খিদে হবে?”
ইনহেলার বা নেবুলাইজার নিয়ে আঁতকে ওঠার সংখ্যা বেশ কম দেখলাম। আসলে গুগলপক্কতা কম হলেই বাচ্চারা ভালো থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিষয়ে ডাক্তারের থেকে পাড়ার উমুক-তমুকের মতামত বেশি গুরুত্ব পায়। ফলে ‘ইনহেলার নিলেই অভ্যাস হয়ে যাবে’ কিংবা ‘প্রচুর সাইড এফেক্ট আছে’ ইত্যাদি ভুল ধারণা মাথার মধ্যে গেঁড়ে বসে। একা ডাক্তারের সাধ্যি কি সে ধারণা দূর করে… এখানে এসে এই ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো। এর আগে জঙ্গলমহলে কাজ করতে গিয়েও দেখেছি, প্রান্তিক মানুষ যাদের পেটে বই পড়া বিদ্যে কম, পকেটে গান্ধীছাপ কম, তারা ডাক্তারের পরামর্শগুলো অনেক বেশি বিশ্বাস করে। তিনদিনের জ্বরে তিনবার ডাক্তার পাল্টায় না। বিশ্বাস আর ধৈর্য্য… ওটারই বড্ড অভাব এখন।
পনেরো বছরের ছেলের ঘাড়ে, মাথায় ব্যথা। অভ্যেসমতো গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছি, “চেয়ার-টেবিলে বসে পড়বে। নিচে বসে ঘাড় গুঁজে অনেকক্ষণ পড়লে সমস্যা বাড়বে। ঘাড়ের ব্যায়ামগুলো করবে।” খসখসিয়ে প্রেস্ক্রিপশন লিখছি। কিছুক্ষণ বাদে খেয়াল করলাম কেউ কিচ্ছু বলছে না। মুখ তুলে তাকাতেই বুঝে গেলাম। আসলে এতগুলো বছর রোগী দেখার পর কিছু একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। কিছু না বলতেও বুঝতে পারলাম, বাড়িতে টেবিল-চেয়ারে বসার ব্যবস্থা নেই। ঢোঁক গিলে বললাম, “নিচে বসলেও হবে। সামনে একটা উঁচু কিছু রেখে পড়া যাবে। ছোটো চৌকি বা ঘুঁটের বস্তা জাতীয় কিছুর ওপরে বই রেখে পড়লেও হবে। আর ওষুধগুলো নিয়ম করে খেতে হবে।” এবারে হাসি ফুটলো।
বারবার, প্রতিদিন বুঝতে পারি, রোগ সারাতেই শিখেছি শুধু। কিছু নীরস উপদেশ দিই আর খসখসিয়ে প্রেস্ক্রিপশন লিখি। ডাক্তার হ’তে আর পারলাম কই? জ্বর তো সারাই, ছুঁতে আর পারি কই? ঠোঁটের দু-পাশে মুখভর্তি ঘা নিয়ে আসা বাচ্চাটাকে রোজ ফল খাওয়াতে বলি। সেটা খাওয়ানোর খরচ চট করে মাথায় আসে না। কিংবা, যদি আসতো… তাতেই বা কী করতে পারতাম? আধুনিক চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকার দায়িত্ব না নিলে আধুনিক চিকিৎসা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ সামলাতে না পেরে বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে অনেকেই ঝুঁকতে বাধ্য হন। সে আবার অন্য এক কাহিনী…
গাড়িতে উঠে পড়েছি। নিশ্চিতভাবেই জানি, সারা জীবনে দেশের এক শতাংশ মানুষের কানেও কথাগুলো পৌঁছোবে না। পাঁজর বের হওয়া কিংবা মুটিয়ে গোল হয়ে যাওয়া (দুটোই অস্বাস্থ্য। যদিও পরেরটা কারও নজরে আসে না) ধুঁকতে থাকা বাচ্চাদের বাবা-মায়ের সামনে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, উমুক খেলেই টলার-স্ট্রংগার-শার্পার কিংবা ফুল-দাদা হওয়া যায়। বিজ্ঞাপনী স্রোতের মুখে আমাদের কথাগুলো খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে, নিশ্চিতভাবেই জানি। তবু প্রতিদিন বলবো…
বাচ্চারা,
ঘাম ঝরাও। রোজ অল্প হলেও ব্যায়াম করো। ছোটো, লাফাও। আর বাড়ির খাবার খাও। বাড়ির ভাত-ডাল-তরকারি-ডিম-মাছ-ফল-শাক… যা পাওয়া যায়। সামনে অনেকটা লড়াই। লড়ে নাও চ্যাম্প!