কাল রাতে রাউন্ড, তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেইনিদের ছোট্ট করে পড়ানো শেষ করে যখন বেরোচ্ছি তখন ধুম বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়েছি। সকাল থেকে এতজন রোগীর বাড়ির লোক তারপর ক্লাসের পড়াশোনায় বকতে বকতে গলা ধরে গেছে। দরদরিয়ে ঘামছি।
মুশকিলটা হ’ল সকালে। ছোট্ট ব্যাগে স্টেথো, টর্চ, দৈর্ঘ্য মাপার ফিতে, বেশ কিছু পেন, স্ট্যাম্প, টুকিটাকি ওষুধ, স্যানিটাইজার ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস রাখা থাকে। বেরোনোর সময় কিছুতেই স্টেথোটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হারালাম কি? বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এ তো শুধু দুটো রাবারের টিউব আর একটা ধাতব চাকতিমাত্র নয়। স্টেথোস্কোপ যার গলায় একবার ঝোলে, ধীরে ধীরে তার শরীরের একটা অঙ্গ হয়ে যায়। বড্ড প্রিয় এই জিনিসটা। কোনোদিনই নিজের স্টেথোস্কোপ ছাড়া রোগী দেখে শান্তি পাওয়া যায় না। অন্য স্টেথোস্কোপ রোগীর বুকে বসানোর পরেও মনে হয়, কী যেন বাকি থেকে গেল। ভালো করে শোনা হ’ল না। বুকের আওয়াজ শোনা শুধু রোগ নির্নয়ের জন্যই নয়, এ আসলে সাধনা। প্রতিদিন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পিডিয়াট্রিক্সের ‘প’ টুকুও শিখিনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লেগে থাকতে হবে। জীবনের শেষ দিনেও না শেখার অপূর্ণতার বোধটুকু বেঁচে থাক, এইটুকু চাই।
মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিনের এক মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়ছে। এমন একজন স্যার, আমরা যাঁর কাছাকাছি যাওয়ার দিবাস্বপ্নও দেখি না। শুধু ঘাড় উঁচু করে দেখি আর পায়ের কাছে বসে শেখার স্বপ্ন দেখি। স্যারকে কোনোদিন অ্যাপ্রন ছাড়া দেখিনি। এত যত্ন করে রোগী দেখতেও খুব কমজনকেই দেখেছি। স্যারের কাছে এমবিবিএসের সেকেন্ডে ইয়ারে মেডিসিন ওয়ার্ডে ক্লাস করছি। যে কোনও কারণেই হোক, স্যার আমার মতো নগণ্য ছাত্রকেও একটু স্নেহের চোখে দেখতেন। তখন সবে নতুন নতুন স্টেথো গলায়, অ্যাপ্রন পরে ওয়ার্ডে যাচ্ছি। রোগীর বুকে স্টেথোস্কোপ বসাচ্ছি। অনেককেই দেখছি স্টেথো বসিয়ে ফটাফট মার্মার (এক ধরনের অস্বাভাবিক হার্ট সাউণ্ড) শুনে ফেলছে। শুধু আমরা কয়েকজন কিছুই বুঝছি না। পেছনে দাঁড়িয়ে ফ্যালফেলিয়ে দেখছি। পরে যদিও বুঝেছি… যাইহোক, সে কথা থাক। সোজা স্যারকে গিয়ে ধরলাম– স্যার মার্মার কিছুই বুঝতে পারছি না।
– সে কী! এ তো খুব সোজা জিনিস। না বোঝার কী আছে?
চুপ করে আছি দেখে স্যারের বোধহয় করুণা হ’ল। হেসে বললেন, – কোন হস্টেল?
– মেইন হস্টেল স্যার।
– শোনো, আজ বিকেলে একটা বাটা’র চটি কিনে আনবে।
বুঝতে পারছি না, জল কোনদিকে গড়াচ্ছে। ভুল কিছু বলে ফেলেছি কি? ভয়ে ঘামছি। হার্টবিট বাড়ছে।
– বুঝতে পারলে না তো?
মুখ দিয়ে ‘অ্যাঁ’ ছাড়া অন্য কিছু বেরোলো না।
-এবার থেকে যেদিন ওয়ার্ডে মার্মার শুনতে আসবে ওই নির্দিষ্ট চটিটাই পরে আসবে। আসতে আসতে যেদিন দেখবে চটির তলা ক্ষয়ে গেছে, সেদিন মার্মার শেখা হয়ে যাবে।
কী সহজ সত্যি কথা! চমকে উঠেছিলাম! আজও অক্ষরে অক্ষরে মানি স্যার। প্রতিদিন নতুন কিছু শিখে নিতে চাই। সঙ্গী এই স্টেথোস্কোপ। প্রাণের খুব কাছের একটা জিনিস। কিনে আনার পরেই সে আপন হয়ে ওঠে না। গলায়, কানে থাকতে থাকতে একসময় আপনজন হয়ে ওঠে। কানে দিলে মনে হয়, স্টেথোস্কোপের আলাদা অস্তিত্ব নেই। মনে হয়, টিউব ভেতর দিয়ে গোটা কানটাই রোগীর বুকে ছুঁইয়েছি।
নিজের স্টেথোস্কোপ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ ওয়ার্ডের স্টেথোস্কোপ নিয়েই রোগী দেখছিলাম। স্থানীয় কোনও কোম্পানির স্টেথো। শোনার অভিজ্ঞতা একেবারেই ভালো নয়। কানে একহাত দিয়ে জোর করে চেপে না ধরলে কিছুই শোনা যায় না। কোনোমতে কাজ চালালাম। চেম্বারে আর একটা স্টেথোস্কোপ আছে যদিও কিন্তু সে আর এখন পাবো কীভাবে?
অনেকেই মেসেঞ্জারে জিজ্ঞেস করেন, কোন কোম্পানির স্টেথোস্কোপ ভালো। মূলত যাঁরা নার্সিং বা ডাক্তারি পড়তে সবে ঢুকেছেন তাঁরাই জিজ্ঞেস করেন। সবাইকেই বলেছি, আমার প্রথম স্টেথোস্কোপ এইচ মুখার্জির। বেশ ভালো স্টেথো। ছাত্রাবস্থায় এটাই ভালো। পাশ করার পরে সাধ্যে কুলোলে অবশ্যই লিটম্যান। আমি শেষ আট-ন’বছর লিটম্যান ব্যবহার করছি। এবং, শুধুমাত্র লিটম্যানই ব্যবহার করি। স্টেথোস্কোপ বললে আমি কখনোই যে কোনও রাবার টিউব আর ধাতব চাকতি বুঝবো না। লিটম্যান ইজ নট জাস্ট আ স্টেথো, ইট’স লিটম্যান! দর্শনসুখ-ই বলুন বা কার্যক্ষমতা, লিটম্যানের কোনও বিকল্প হয় না। দামে সাধারণ স্থানীয় স্টেথোর দশ-কুড়ি-তিরিশ বা তারও বেশি গুণ! ঘুরেফিরে সেই ব্র্যান্ডের গল্প।
অনেক স্টেথোস্কোপের গল্প হ’ল, এবার রোগীর কথা বলি। প্রচুর, প্রচুর স্ক্রাব টাইফাসের রোগী পাচ্ছি। জ্বর-শ্বাসকষ্ট কিছুদিন বিরতির পর আবার ফিরে আসছে। এছাড়া সাপে কাটা, জন্ডিস, জ্বরজ্বালা, কিডনি থেকে প্রোটিন বেরোনোর রোগ, থ্যালাসেমিয়া এসব তো আছেই। ওয়ার্ড থিকথিক করছে।
যাক, শেষমেশ ভালো খবরটা দিয়ে শেষ করি। লিটম্যান পাওয়া গেছে। আমিই ল্যাপটপের ব্যাগে ভুল করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ফেরত পেয়েই ছবি তুলে নিলাম। গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে রেখে দিলাম। স্টেথোস্কোপ বইতে পারা বড় সহজ কথা নয়। আমি অন্তত বইতে শিখিনি এখনো। যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছি শুধু।