রানী পাড়ার স্কুলে ছিল ভালো ছিল। পাশ ফেল নিয়ে চিন্তা ছিল না। জানতাম ঠিক পরের ক্লাসে উঠে যাবে। ক্লাস ওয়ানে সারদা কন্যা বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়ে বিপদ হয়েছে।
মিশনের স্কুল। ফেল করলে পরের ক্লাসে ওঠা যায় না। মহারাজরা ভয়ানক কড়া। তাঁদের মুখ দিয়ে কথা বের করাই শক্ত। তাঁদের কাছে পরীক্ষায় অকৃতকার্য মেয়েকে পরের ক্লাসে তোলার জন্য আবেদন করব ভাবলেই হৃৎকম্প হয়।
তবে রানীর এসব নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা নেই। মহারাজদের ও আদৌ ভয় পায় না। আগে ভয় পেত। জগৎসংসারে একমাত্র মহারাজদেরই ভয় পেত। কে ওকে বলেছে মহারাজরা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসেন। তারপর থেকে ও বেশ নিশ্চিন্তে আছে।
আমি বললাম, ‘এতোটা নিশ্চিন্তে থাকিস না। পড়াশুনো না করলে তাঁরা কিন্তু ভয়ানক রেগে যান।’
রানী হেসে বলল, ‘মোটেও না।’
আমি বললাম, ‘তুই মহারাজদের দেখেছিস? তাঁদের চিনিস?’
‘হ্যাঁ, না চেনার কী আছে। ওই তো, যাঁদের নেড়া মাথা থেকে আলো বের হয় তাঁরাই মহারাজ।’
আলো? আমি অবাক হয়ে যাই। বলি, ‘একজন মানুষের মাথা থেকে আলো বের হবে কী করে?’
রানী হেসে বলে, ‘মানুষের মাথা থেকে কেন হবে। মহারাজদের মাথা থেকে হবে। মাথার পেছনে গোল একটা আলো দিব্যি দেখা যায়। আলো দেখেই তো আমি মহারাজদের চিনি।’
আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘কিন্তু আমি তো কখনো আলো দেখিনি।’
রানী বলল, ‘তাহলে তুমি যাকে দেখেছো তিনি মহারাজ নন।’
প্রথম প্রথম রূপালী গজ গজ করতো, ‘তুমি ছোটোটাকে একেবারে পড়াও না। ও কিচ্ছু পারছে না।’
হেসে বলতাম, ‘ক্লাস ওয়ানে পড়ানোর কী আছে। ঠিক শিখে যাবে। কটা দিন যাক।’
দিন যায়, মাস যায়, বছরও প্রায় চলে গেল। কিন্তু রানী বিশেষ শিখে উঠতে পারে না। শেখার যে তেমন ইচ্ছে আছে তাও ওকে দেখে মনে হয় না। অথচ অন্যান্য ব্যাপারে ওর উৎসাহ প্রচুর। যেখানে সেখানে ডিগবাজী খেতে পারে। মাথা নিচে করে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি দেওয়ালের দুই কোনা বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারে। শুধু পড়তে বসালেই মুখ ভার।
তা ছোটো মেয়ের মুখ ভার দেখতে কোন বাবার ভালো লাগে। আমারও লাগে না। তাই পড়াতে বসলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের আর পড়াশুনো করা হয়ে ওঠে না। গল্পে গল্পেই সময় কেটে যায়। অংক করাচ্ছি, ‘১৯২টি কুল ৮ জন বালক বালিকাকে সমান ভাবে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকে কটি করে কুল পাবে?’
রানী প্রশ্ন করে, ‘ছেলে আর মেয়ে না লিখে বালক বালিকা লিখেছে কেন?’
‘বালক বালিকা শুদ্ধ ভাষা, শুনতে ভালো লাগে। তাই বালক বালিকা লিখেছে।’
‘শুনতে কেন ভালো লাগে বাবা? আমার তো ভালো লাগছে না।’
‘তুই ওই নিয়ে চিন্তা না করে আগে অংক কর।’
‘আচ্ছা বাবা, কুল গাছে তো কাঁটা থাকে। তাহলে কী করে কুল পাড়ে?’
বলাই বাহুল্য মেয়েকে ধমক দিয়ে থামানো আমার পক্ষে মুশকিল। তাই শেষ পর্যন্ত অংক খাতা সাদাই থেকে যায়। আমি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দি। আর রানী আনন্দে ডিগবাজী খায়।
তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকেই পরিস্থিতি বেশ গুরুগম্ভীর হয়েছে। রানী উঠতে বসতে মায়ের কাছে ঝাড় খাচ্ছে। ওর পক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করলে আমিও ঝাড় খাচ্ছি। রূপালীকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো রেগে আছো কেন?’
রূপালী বলল, ‘রাগবো না তো কী আনন্দে নাচব? ও কী রকম পরীক্ষা দিয়েছে জানো? পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটা একবার দেখেছো? যেমন বাপ, তার তেমন মেয়ে।’
আমি বলি, ‘যা তো রানী মা, অংক প্রশ্নটা নিয়ে আয়।’
রানী বলে, ‘পরীক্ষা তো হয়ে গেছে বাবা। আর প্রশ্ন দেখে কী হবে?’
আমি গম্ভীর গলায় বলি, ‘তোকে আনতে বলেছি, তুই আন।’
রানী ব্যাজার মুখে প্রশ্নপত্র এনে দেয়। প্রথম প্রশ্ন, “১৫-এর মধ্যে ৫ কতবার আছে?”
বললাম, ‘এটা পেরেছিস তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব সোজা। ১ বার মাত্র আছে। এতো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ১ এর পিঠে ৫। একটা মাত্র পাঁচ।’
আমি ওর কনফিডেন্সে চমকিত হই। বলি, ‘এটার উত্তর ৩ হবে। তিন পাঁচে পনেরো।’
‘হ্যাঁ, তুমি যেভাবে ভাবছো, সেভাবে ৩ হবে। কিন্তু আমি যে ভাবে ভাবছি সেভাবে ১ হবে। সকলের ভাবনা চিন্তা কি সমান হয়, বাবা?’
এসব দার্শনিক কথাবার্তার আমি থই পাই না। পরের প্রশ্নে যাই। “কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে গুণফল কতো হয়?” জিজ্ঞেস করি, ‘এইটা পেরেছিস?’
রানী সদর্থক ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘কিছুই হয়না।’
‘কিছু হয়না মানে? শূন্য হয় লিখতে হবে তো।’
‘কিছু না মানেই তো শূন্য। ধরো আমি তোমাকে শূন্যটা লজেন্স দিলাম। মানে আমি তোমাকে কিছুই দিলাম না। আমি তাই শূন্য না লিখে কিছুই হয় না লিখেছি। যাতে দিদিমণিরা সহজে বুঝতে পারে।’
আমি আর প্রশ্নপত্র দেখার সাহস পাই না। তবে বুঝি রেজাল্ট বেরোনোর পর যদি মহারাজ ডেকে পাঠান, আমি তখন নিশ্চিত মহারাজের মাথার পেছনে একটা আলো দেখতে পাব। পাবোই পাব।
রানী বলে, ‘প্রশ্নগুলো তাহলে তুলে রাখি বাবা।’ বলেই সে আনন্দে ডিগবাজী খায়।