রাত্রি এগারোটার সময় সিস্টারদের টেবিলে বসে ছুটি লিখছিলাম। কাজ যতটা এগিয়ে রাখা যায়। আগামীকালও আমার ২৪ ঘণ্টা ডিউটি। পীযূষদা সান্দাকফু ট্রেক করতে গেছে। সঞ্জীবদার বহরমপুরে ভ্যাসেকটমি ট্রেনিং চলছে। আমি একা তিনদিন ধরে খড়গ্রাম হাসপাতাল সামলাচ্ছি। দুজনেই কথা দিয়েছে সামনের সপ্তাহে আমাকে চারদিনের জন্য বাড়ি যেতে দেবে। সেই আশায় আশায় একাই টেনে যাচ্ছি।
সিস্টার চৈতালীদি মাঝরাতের সেনসাস করে খাতা বন্ধ করলেন। তারপর বললেন, ‘যান, ডাঃ ভৌমিক, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ডেলিভারি, ডাইরিয়া সামলে দেব। খারাপ রোগী এলে সুকুমারদাকে দিয়ে ডাক পাঠাব। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।’
‘সেতো আপনি গত রাত্রেও তাই বলেছিলেন। তারপর ঘুমাতে না ঘুমাতেই ডাক পাঠালেন।’
চৈতালীদি আহত ভাবে বললেন, ‘আমার কি করার আছে। যদি দেখি ডেলিভারির সময় বাচ্চার ঠ্যাং নিচের দিকে আছে, আমি কি আপনাকে না ডেকে চেয়ারে বসে ঠ্যাং নাচাব। একটা বাচ্চার জীবন মরণের ব্যাপার। তার থেকে আপনার কাছে ঘুমটা জরুরী হল!’
অকাট্য যুক্তি। এই কথার পরে আর তর্ক চলেনা। বললাম, ‘আসলে আমার ভাগ্যই খারাপ। কাল ব্রিচ ডেলিভারি মাঝ রাত্রে নাচিয়ে ছেড়েছে। আজ ন্যাকাইটিস রোগিণী বিষ খেয়ে আসবে। সারারাত্রি তাই নিয়ে নাচব। যাই, নৃত্যানুষ্ঠান শুরুর আগে অন্তত ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়ে নি।’
কোয়ার্টারে ফিরে সুচিত্রাদির রান্না করা কড় কড়ে ভাত, ডাল, কুঁদলি ভাজা আর শোল মাছের ঝোল খেলাম। ওহ… কতদিন শোল ছাড়া অন্য মাছ খাইনা। বাড়ি ফিরে চারদিনে অন্তত গোটা আটেক ডিম ভর্তি ইলিশ মাছের পিস খাব।
খেয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিক ভয়ংকর নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝেই শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। তার সাথে রাতজাগা পাখির কর্কশ আওয়াজ।
সবে মাসি-পিসি ঘুম নিয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছে, এমন সময় সুকুমারদার গলার আওয়াজ। ‘সার, পেশেন এয়েচে।’
সুকুমারদা গাঁক গাঁক করে চিৎকার করছে আর বারান্দার গেট ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ভেতর থেকে আমি বারদুয়েক চিৎকার করে বললাম, ‘আর গেট ধরে ঝাঁকিও না। এমনিতেই কোয়ার্টারের অবস্থা খারাপ। ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছে। ওভাবে গেটের উপর অত্যাচার করলে গেটটাও যাবে।’
কিন্তু ঘর থেকে চিৎকার করে লাভ নেই। সুকুমারদা কানে কম শোনে। যতক্ষণ সশরীরে সুকুমারদার সামনে আবির্ভূত না হচ্ছি, ততক্ষন ঐ ঝন ঝনানি কমবে না।
বারান্দাতে আসতেই সুকুমারদা বলল, ‘শিগগিরি চলেন, একখান ভূতে ধরা মেয়ে এয়েচে। ওয়ার্ডে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েচে।’
এ আবার কি মস্করা। রাতদুপুরে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ভূত দেখানো। বেশ রাগ নিয়েই ওয়ার্ডে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ফিমেল ওয়ার্ডে সার্কাস চলছে। একটা কমবয়সী মেয়ে মূখে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। তার এলোমেলো চুলে মুখ ঢাকা।
আমি চৈতালিদিকে বললাম, ‘আর রোগী পেলেন না। শেষ পর্যন্ত ভূতে ধরা।’
চৈতালীদি অপরাধীর মত মুখ করে বললেন, ‘আমি চেষ্টা করেছিলাম ডাক্তারবাবু। ভেবেছিলাম স্যালাইন দিয়ে রাতটা পার করে দেব। কিন্তু চ্যানেল করতে গেলেই কামড়ে দিতে আসছে। বাড়ির লোকেরাও ধৈর্য্য হারাচ্ছে।’
মেয়েটির বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে?’
তিনি জানালেন, ‘আজ সকাল থেকেই মেয়ে কেমন কেমন করছিল। শুধু ঘর বার। তখন বুঝতে পারিনি। সন্ধ্যে থেকেই মেয়ে পুরোপুরি পাল্টে গেল। আমার শান্ত শিষ্ট মেয়ের গলার স্বর, ভাষা সব পাল্টে গেছে। যে মেয়ে সাত চড়ে রা কাড়ে না, সে অশ্লীল গালাগালি দিয়ে কথা বলছে।’
আমি মেয়েটিকে পরীক্ষা করে দেখতে গেলাম। মেয়েটি আমার ডান হাত খামচে রক্ত বার করে দিল। তারপর আমাকে বলল, ‘ব্যাটা অবাগীর পূত, আমার সাথে লাগতে এয়েচিস।’
একে কাঁচা ঘুম ভেঙেছে। তার উপরে এরকম রাম চিমটি। ইচ্ছা করছিল, একটা বিরাশি সিক্কার চড়ে ওর ভূত ছাড়িয়ে দি।
কিন্তু উপায় নেই। বহু পাপ করে এরকম গালাগালি আর চিমটি খাওয়ার জন্যই ডাক্তার হয়েছি। চৈতালীদিকে বললাম, ‘দিদি, একটা ডায়াজিপাম টানেন। আমি চেপে ধরছি। আপনি স্লো আইভি দিয়ে দেন।’
ইংজেকশেন দেওয়ার মিনিট দশেক পরেই মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ল। ওর বাবাকে বললাম, ‘ভূত তাড়ানোর ইংজেকশন দিয়েছি, কোনও চিন্তা নাই। ভূত পালিয়েছে। এখন আপনার মেয়ে ঘুমাবে। কাল ঠিক ব্রক্ষ্ম মূহূর্তে ভোর ৫টা ১৭ মিনিটে এর ঘুম ভাঙবে। এখন আপনারা ওয়ার্ডের ভিড় পাতলা করেন।’
আবার সিস্টারদের টেবিলে বসলাম। চৈতালীদি বললেন, ‘বসলেন কেন? যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল না হলে আউটডোর টানতে পারবেন না।’
বললাম, ‘এসমস্ত ন্যাকাইটিসে ভোগা রোগী দেখলে আমার চড়াতে ইচ্ছে করে।’
দিদি বললেন, ‘ন্যাকাইটিস আর ভূতে ধরা এক জিনিস নয়।’
‘আপনার কি মনে হয়? মেয়েটিকে সত্যি সত্যিই ভূতে ধরেছে?’
দিদি বললেন, ‘একটা গল্প শুনবেন?’
বললাম, ‘বলুন। এমনিতেই যা চিমটি দিয়েছে, তার জ্বালায় সহজে ঘুম আসবে না।’
চৈতালীদি শুরু করলেন, ‘আমি তখন মেডিক্যাল কলেজে নার্সিং পড়ি। এক ছুটিতে গ্রামে ফিরে শুনলাম, আমার জ্যাঠতুতো দিদি পূর্ণিমাকে ভূতে ধরেছে।
পূর্ণিমাদি আমাদের বোনদের মধ্যে সবচেয়ে রূপসী। পড়াশুনোতেও বেশ ভাল। ঐ ধ্যারধেরে গ্রামে থেকেই অংকে বিএসসি করে ফেলেছে। তারপর নানারকম চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছে।
গিয়ে দেখি কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পূর্ণিমাদি একটা তালগাছের মাথায় চড়ে আছে।সেখান থেকেই বিকট চেঁচাচ্ছে।
আমি ভয়ে ভয়ে গাছের তলায় গিয়ে বললাম, দিদি, আমি চৈতালী। তুমি এমন করছ কেন?
সাথে সাথে দিদি একটা তাল আমাকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারল। কোনও রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালাম।
তারসাথে গালাগালি শুরু হল। বাপরে সে কি অশ্লীল গালাগালি। ভাবতে গেলেই এখনও আমার কান লাল হয়ে যাচ্ছে।
ততোক্ষণে ওঝা চলে এসেছে। পাশের গ্রাম মিরিদ্দা থেকে ডাকসাইটে বিশু ওঝা। যার ভয়ে মামদো, ব্রক্ষ্মদত্যি একঘাটে জল খায়।
ওঝা সব পর্যবেক্ষণ করে জানাল, পূর্ণিমাদির ঘাড়ে অত্যন্ত নিম্ন মানের একটি পেত্নি চেপেছে। পূর্ণিমাদির বা অন্য কারো ক্ষতি না করে সে যাবে না।
ওঝার সাথে আসা দুইজন মুশকো জোয়ান তরতর করে তালগাছে উঠে পূর্ণিমাদিকে নামিয়ে আনল। দিদি তাঁদের একনাগাড়ে আঁচড়ে কামড়ে যাচ্ছে।
বিশু ওঝা ঝাঁটা নিয়ে এগিয়ে গেল। ঝাঁটার এক বাড়ি মেরে জিজ্ঞাসা করল, বল তুই কে? কোথায় থাকিস।
অস্বাভাবিক গলায় পূর্ণিমাদি উত্তর দিল, আমি ক্ষেমা শঙ্করী। বড় পুকুরের পাশে শ্যাওড়া গাছটায় থাকি।
তুই এই নিরীহ লক্ষ্মী মেয়েটার ঘাড়ে চেপেছিস কেন?
আমার একজনের উপর রাগ আছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।
কার উপর, কি প্রতিশোধ।
এগ্রামের বদমাইশ ছেলে কার্তিকের উপর। যদি ওর মাথা ন্যড়া করে দুগালে চুনকালি মাখিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমি মেয়েটিকে ছেড়ে, এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। ও এখন ঘোষদের গোয়ালে লুকিয়ে আছে।
কার্তিকের উপর এমনিতেই গ্রামের লোক খাপ্পা। হেন কুকাজ নেই সে করেনি। প্রায় ত্রিশ বছর বয়স। কোথায় উপার্জনের চেষ্টা করবে। বিয়ে থাওয়া করে বাচ্চাদের মানুষ করার চেষ্টা করবে। সেসব না করে সে পার্টি করে। পার্টির জোরে নিজেকেও বড় কেউকেটা ভাবে। সারাক্ষণ কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে মদ গেলে। বাজারে জোর করে চাঁদা তোলে। খেত থেকেও ফসল তুলে নিয়ে যায়। ইদানীং সে গ্রামের মেয়েদের দিকেও খারাপ নজর দিচ্ছিল। কিন্ত গ্রামের লোক পার্টির ভয়েই কার্তিককে কিছু বলছিল না।
ভূতের মুখে কার্তিকের নাম শুনে তারা অত্যন্ত আনন্দিতই হল। প্রায় মিছিল করে গ্রামের মানুষ ঘোষেদের গোয়ালে গেল এবং সেখানে লুকিয়ে থাকা কার্তিককে বের করে আনল। তারপর পূর্ণিমাদির সামনে শুধু মাথা কামানো আর চুনকালি মাখানোই নয়, বেশ কিছু চড় থাপ্পড়ও তাকে হজম করতে হল।
বিশু ওঝা বলল, এবার তুই মেয়েটাকে ছেড়ে যা।
যাব, নিশ্চয়ই যাব।
বিশু ওঝা বলল, তুই যে যাচ্ছিস প্রমাণ দিতে হবে। এই জল ভর্তি কলসি দাঁতে করে ঐ নিমগাছের নীচে ঢেলে দিয়ে যা।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, আমার রোগা পাতলা দিদি খুব সহজেই জল ভর্তি কলসি দাঁত দিয়ে তুলে ফেলল। তারপর নিম গাছের নীচে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।’
আমি বললাম, ‘আপনিও না… আমায় কি ছেলে মানুষ পেয়েছেন। ভূতের গল্প শোনাচ্ছেন?’
চৈতালীদি বললেন, ‘ভূত আছে কি নেই জানি না। কিন্তু গ্রামে গঞ্জে মেয়েদের অনেক রকম বিপদ আছে। অনেক সময় ভূতেরাই সেই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করে।’