কর্মজীবনে কয়েকটি কুখ্যাত থেকে পরবর্তীতে খ্যাত হয়ে ওঠা হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলাম। সেখানে সিংহভাগ সময় চলে গেছিল আমার সহকর্মী চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে যুদ্ধ ও মিত্রতা করতে।
সেখানকার একটি বিষয় ছিল ইমারজেন্সি তে কোন রোগী এলে আমাদের একাংশের নিস্পৃহতা। রোগীর বাড়ির লোককে আমাদের লোকদের ডাকাডাকি করতে, চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করতে, নিজেদের ট্রলি, হুইল চেয়ার ইত্যাদি খুঁজে বের করে রোগীকে নামাতে ওঠাতে হত। এস এস কে এম ইত্যাদি জায়গায় রোগীর বাড়ির লোককে উৎকোচ দিতে হতো। অথচ কর্পোরেট হাসপাতালে ইমারজেন্সি তে রোগী নিয়ে গেলে দেখতাম পরবর্তীতে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স শূন্য করে দেওয়ার আয়োজন হলেও বেশ কিছু ইউনিফর্ম পরা স্বাস্থ্য কর্মী তৎক্ষণাৎ অ্যাটেন্ড করতেন ও দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। আর আমরা সকলে জানি যে আপৎকালীন চিকিৎসায় প্রথম দিকের সময় টি কতটা গুরুত্বপুর্ণ। উপরোক্ত হাসপাতালগুলিতে সেইসময় ওই অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হলেও গতকাল দেখলাম অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
দুটি সরকারি দফতরে কাজ ছিল। একটি পারিবারিক গাড়ি এবং একটি নামি এজেন্সি থেকে একজন ড্রাইভার hire করে গেলাম। প্রসঙ্গত একটু আধটু যা গাড়ি চালাতাম বড়সড় ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে বন্ধ। প্রথম দফতর থেকে দ্বিতীয় দফতরে রওনা দিয়েছি। একটু পরে মাঝ রাস্তায় সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালো। তারপর সিগন্যাল চালু হলেও দেখি গাড়ি চলছে না। ড্রাইভারকে প্রশ্ন করতে দেখলাম সে স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় ঢলে পড়েছে। তাড়াতাড়ি ইগনিশন সুইচ পুরো অফ করে চাবি খুলে পার্কিং ব্রেক দিয়ে গাড়ি থেকে বেরোলাম।
ড্রাইভারকে শুইয়ে resuscitate করার চেষ্টা ব্যর্থ হল কারণ মধ্যবয়সী ড্রাইভারের ভারী ওজন এবং সিট এর সাথে সেটে থাকার জন্য। রাস্তার ট্রাফিক দাঁড় করিয়ে আশপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে একটি গাড়ির সাথে উচ্চমূল্যে রফা করে তাকে ধরাধরি করে তুলে নিকটবর্তী বড় হাসপাতালের ইমারজেন্সি তে নিয়ে গেলাম।
ইমারজেন্সি তে সেইসময় অন্য রোগী নেই। কর্মীরা বসে গল্প করছেন। গুরুতর রোগী নিয়ে এসেছি বলা সত্ত্বেও কেউ কোন গা করলেন না, একে অন্যকে দেখাতে লাগলেন। অগত্যা EMO কে গিয়ে বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে একটা ঘরে গিয়ে যেখানে কয়েকজন কর্মী AC র মৌতাত নিচ্ছিলেন বুঝিয়ে সুজিয়ে নামালেন। তাও তারা খুবই অনিচ্ছুক। EMO ও আমি তাদের সাথে গাড়ি থেকে রোগী নামিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলাম। এরপর EMO প্রাথমিক পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করলেন। আমাদের PD হল CVA in a case of Hypertension।
এরপর ফিজিশিয়ান দেখলেন এবং CT Scan লিখে দিলেন। CT Scan করতে নিয়ে যাওয়ার আগে তার পকেট থেকে মোবাইল, পার্স, কাগজপত্র, খুচরো পয়সা, খৈনি ও চুনের ডিবে বেরোলো। সিস্টারদের কাছে একটা ছোট প্লাস্টিক চাইলাম। বললেন নেই। বললাম এগুলো একপাশে একটু রেখে দিন, CT থেকে ফিরে নিয়ে ওর বাড়ির লোক কে দিয়ে দেবো। একজন স্টাফ সিস্টার এসে আমায় ধমকাতে শুরু করলেন।
EMO ডা. মজুমদার খুবই ভালো। উনি CT Room অবধি আমাদের সঙ্গে গিয়ে ওখানে বললেন খারাপ রোগী তাড়াতাড়ি করে দিতে। এবার ওখানে রোগীর নামধাম লেখা সই করার জন্য আমায় ডাকল। দেখি ট্রলি তে রোগীকে ফেলে ইমারজেন্সি র কর্মীরা কখন চলে গেছে। রোগী ছটফট করছে, পড়ে যেতে পারে। আমি রোগী সামলাচ্ছি আবার ওখানে গিয়ে কথা বলে দৌড়ে ফিরে আসছি। এরপর ডাক এলে নিজেই ট্রলিতে করে রোগীকে ঢোকালাম। ওখানকার দুজন কর্মী র নির্দেশে আমাকেই কোনরকমে রোগী কে CT র বেডে তুলতে হল। গলদঘর্ম অবস্থা। মহিলা সাফাই কর্মী টি অকারণে দুর্ব্যবহার করছিল। এরপর ওরা আমায় নির্দেশ দিল রোগীকে ধরে রাখতে। ওই অবস্থায় CT করবে।
ক্যাচ দেওয়ার পক্ষপাতী নই। এবার বাধ্য হলাম সুপার কে ফোন করতে। সে আমার স্নেহধন্য অত্যন্ত ভালো এবং কাজের মানুষ। একটি জেলায় বিএমওএইচ হিসেবে ভালো কাজ করেছে। আমরাও তার ব্লকে নিয়মিত যেতাম, বিপদ আপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম। এবার দ্রুত পরিস্হিতি বদলে গেল। প্রচুর লোকজন চলে এল। আমায় আর কিছু করতে হলোনা। রোগী CCU তে ভর্তি হয়ে গেলো। CT তে ব্রেন এর ডানদিকে হেমারেজ পাওয়া গেল।
এজেন্সি র মাধ্যমে রোগীর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়েছিল। তারা তিলজলায় থাকেন। তাদের আসতে সময় লাগল। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। অল্পবয়সী স্ত্রী, দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে, গরীব পরিবার। ওর স্ত্রীর কাছে জানলাম গত রাতে ঘুমায়নি। ওদের জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে সব বন্দোবস্ত করে সুপার কে ধন্যবাদ জানিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে সন্ধ্যায় ফিরলাম। সুপার রাতে ফোন করে জানালো ও উদ্যোগ নিয়ে রোগীকে BIN এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছে কারণ ওর ওখানে নিউরো সার্জারি র সাপোর্ট নেই। আগেই বলেছি খুব ভালো আর কাজের মানুষ।
কিন্তু আমাদের সার্বিক কর্ম সংস্কৃতির পরিবর্তনের সাথে ইমারজেন্সি পরিষেবার মনোভাব বা অ্যাটিটিউড বদলানো দরকার । 🙏
সহজবোধ্য কারণেই এই লেখার লেখক অনামা থেকেছেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।