যেদিকে চোখ যায়, আদিদিগন্ত বিস্তৃত শুধু জল আর জল। নৌকা থেকে চোখে পড়ে, একটা সরু লম্বা অস্থায়ী বাঁধ, আর সেখানে আমাদের গন্তব্যের ভাঙাচোরা ঘাটে কাতারে কাতারে অপেক্ষায় মানুষ। অস্থিচর্মসার, শতচ্ছিন্ন কাপড়জামায় আবালবৃদ্ধবনিতা।
আজকাল ত্রাণ, সাহায্য বা রিলিফ শব্দগুলো কানে বড্ড ক্লিশে লাগে শুনতে। কাদের রিলিফ? কিসের রিলিফ? রায়মঙ্গলের শাখানদী কলাগাছিয়া ধরে যে গ্রামটায় আমরা পৌঁছালাম আজ, তার নাম ছোটতুষখালি। পাঁচখানি পাড়া জুড়ে প্রায় দুশো পরিবারের বাস। হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো তক্ষুনি। ঘন্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে সমস্ত সামগ্রীর বিলিব্যবস্থা শেষ। পরিবারপিছু এক ইউনিট, মানে যেটুকু খাবারদাবার, কাপড়জামা আর ওষুধ আমরা বঙ্গবাসী কলেজ ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিমের টিম নিয়ে যেতে পেরেছিলাম।
প্রয়োজনের তুলনায় সেটা নিতান্তই নগণ্য। আধবেলাও একটি পরিবারের পেট ভরবে কিনা সন্দেহ। সরকার বাহাদুরের তরফ থেকে আপাতত একটি করে ত্রিপল ছাড়া কিছু জোটেনি। তাই মাথায় দিয়ে, কোমরজলে ডোবা ভাঙা বাড়ি ছেড়ে এসে, চাঁদিফাটা রোদ্দুর, বৃষ্টি, বাৎসরিক সাইক্লোন আর অতিমারীর মধ্যে কীটপতঙ্গের মত বেঁচে আছে মানুষগুলো। হ্যাঁ, ঠিক শুনলেন। কীটপতঙ্গই বললাম। যাদের শুধুমাত্র বোতাম টেপার সংখ্যার নিরিখেই পাঁচবছর অন্তর খবর নেওয়া হয়। আর প্রধান দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের নমুনা শুনবেন? “বাবারা, ও পাড়ার রহিমা-বেওয়ার লগে একখান কাপড় দিবেন? বুড়ি উটতে পারচে লাই গো বিচানা ছেড়ে…”- শাঁখাপলা পরিহিত শীর্ণ একটি হাত এগিয়ে এসেছিলো সামনে। “বিশ্বাস না হলি চলেন আমার ঠেঁয়ে, উ ত কুপন পায় নাই কেনে…।।
হে ভগবান। একি দৃশ্য দেখে আসতে হলো আজ নিজের চোখে? শুধু একটু জীবনধারণের জন্য এতটা লড়াই? খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নেই। আর শিক্ষা? ভাবলেও হাসি পাচ্ছে আজ। লোলচর্মসার এক বৃদ্ধ বললেন, জাল ফেলে মাছ ধরতে গিয়ে গতবছর জোয়ান ছেলের হাঁটুর তলা থেকে কেটে নিয়ে গেছে কামট। এইট অব্ধি পড়তে পেরেছিলো ছেলেটা। অগত্যা নিজেই অল্প জলে তেলাপিয়ার মীন ছেড়েছিলেন এবার। গতমাসের ছাব্বিশ তারিখ সব ভেসে গেছে। সমস্তকিছু।
আর শহুরে আমি? লেফট ভেন্ট্রিক্যুলার হাইপারট্রফি, এল-৩ এল-৪ স্যাক্রিলাইজেশন, অর্থাৎ সুখের কিছু অসুখে ভোগা আমি একটা বেশ বিশাল কিছু করে ফেলছি মনে করে আজ ভিড়ে গিয়েছিলাম কলেজের দলে। ফিরে এসেছি একরাশ লজ্জা আর অপরাধবোধ নিয়ে। ঘুমোতে পারবো না বোধহয় আজ আর আগামি অনেকদিন রাতে। ওই মুখগুলো, ওই চোখগুলো ফিরে ফিরে আসবে চেতনায়। আর কতদিন শুধু নিজের জন্য বাঁচবো?
আর প্রাপ্তি? হ্যাঁ, তা একটা হয়েছে। আমাদের কলেজের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সহকর্মী Priyadarshini D র তোলা এই ছবিটা। আমার মিথ্যা আত্মশ্লাঘায় সজোরে দুটো থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছে অপাপবিদ্ধ শৈশবের ফ্রেমবন্দী মুহূর্তটা।