বাবার কথা লিখতে আমার একদম ইচ্ছে করে না।
একজন আদ্যন্ত অসফল অথচ দুর্দান্ত সুখী মানুষের কথা লিখতে অস্বস্তি হয় বড্ড। সঙ্কোচও হয় বৈকি!
মেধায় কমতি ছিল না বাবার, নামের পাশের চারখানা ডিগ্রি — এমএসসি, বিএড, ডিএসডব্লু, এলএলবি তার উজ্জ্বল সাক্ষী। সেই মেধাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে খামতি ছিল হয়ত। কিংবা অনিচ্ছা। অথবা দুর্ভাগ্য। অসাফল্যের কারণ জানা নেই আমার। শুধু জানতাম, সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না বাবার, ছিল না আফশোস।
এখনো কত মানুষের মুখে শুনি, ‘সে কি, ওঁর কোনো পেনশন ছিল না?’
না, সারাজীবন বেসরকারি চাকরি করা মানুষটার পেনশন ছিল না কোনো। সন্তানকে জীবনের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে, জমানো পুঁজি ঢেলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু গড়ে একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গিয়েছিল বাবা।
ভুল বললাম। নিঃস্ব হয়নি। আমি ছিলাম। কিন্তু উপযুক্ত সন্তানের মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা বাবা ভাবতেই পারেনি কখনো। নিতান্ত অবিবেচকের মতো, বোকার মতো ভেবেছিল স্ব-উপার্জনের ভরসায় কাটিয়ে দেবে জীবনের বাড়তি সময়টুকু। চিরকালের বেহিসেবি মানুষটা নিজের সবচেয়ে দামি সম্পদ, স্বাস্থ্যকে হিসেবের মধ্যে রাখেইনি। ছেলেবেলার নির্ভেজাল দুধ ঘি খাওয়া শরীর যে সিগারেটের অত্যাচারে অভিমান করে ছেড়ে যাবে হাত, সেই হিসেব আর রাখা হয়নি বাবার।
ফলে, জীবনের অন্তিম লগ্নে বড় দিশাহারা হয়ে পড়েছিল লোকটা। চারপাশের ভোগবাদী দুনিয়াদারি, অসুস্থ শরীর আর মেয়ের হাততোলা হয়ে না থাকার জেদ — এই ত্রিমুখী চাপে হারিয়ে গিয়েছিল তার চিরকালীন ইউএসপি — সন্তুষ্টি।
আজও মনে পড়ে, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাবাকে, আর রক্তাভ চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেওয়ার মতো অসহায় গলায় বিড়বিড় করছে বাবা — ‘আমি তোকে বড্ড বিপদে ফেলে দিলাম বাপি, বড্ড বিপদে ফেলে দিলাম।’
না, বিপদে ফেলেনি আমাকে। বাবা তো! পরের দিনই সুতো কেটে উড়ে গিয়েছিল ঘুড়ি — নিরুদ্দেশে। আর ফেরেনি নতুন কোনো বোকামির ডালা নিয়ে।
মেয়ের তৎকালীন সীমাবদ্ধতাটুকু বুঝতে একটুও ভুল হয়নি আমার অবুঝ বোকা বাবাটার।
মা থাকলে এই লেখাটা পড়ে রাগ করত খুব। ভাবত, বাবাকে বোধহয় সর্বসমক্ষে ছোট করে ফেললাম আমি।
যে মানুষটার নাগালই পাই না আর, তাকে ছোট করব কী করে, মা?
জানি, তুমি বলবে —
‘মা ব্রুয়াৎ সত্যম অপ্রিয়ম’।
তবু লিখলাম। হৃদয়ের ভার লাঘব করব বলে — নিতান্ত স্বার্থপরের মতো।
তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি বাবা। শুধু কলকাতা শহরের এই জলে জঙ্গলে ভরা অনুন্নত উপান্তে তোমার কষ্ট করে তৈরি করা বড় গর্বের বাড়িটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছি — শত প্রলোভন, অনুরোধ, অভিযোগেও যাইনি কোত্থাও। যাবোও না। এবাড়ির ছাদের পাঁচিলে তোমার পরিশ্রমী ঘামের গন্ধ লেগে আছে কুড়ি বছর পরেও। বারান্দায়, খাবার ঘরে এখনো মায়ের আঁচলের খসখস শোনা যায় নিস্তব্ধ দুপুরে। শোবার ঘরের আলমারিতে ভাঁজ করা শার্টগুলোয় হাত বুলোলে তোমার ঈষদুষ্ণ স্পর্শ পাই আজও। আমার ড্রেসিংটেবিলে চিরুনির পাশে এখনো রয়েছে তোমার মণিবন্ধের এইচএমটি — দম দিই রোজ। তোমার হারিয়ে না ফেলা অস্তিত্ব অনুভব করি। কোথায় যাব বাবা, এ সব ছেড়ে?
কত সাজিয়েগুছিয়ে, মেরামত করিয়ে নতুনের মতো তকতকে করে রেখেছি আমার পরাজিত সম্রাটের প্রাসাদ — তুমি দেখতে পাচ্ছ নিশ্চয়।
আশীর্বাদে তোমার বিশ্বাস ছিল না কোনোদিন। নিজের শর্তে জীবন বাঁচার সন্তুষ্টিটুকু পারলে দিও তোমার বাপিকে। দিও কিন্তু।
বাবার কথা লিখতে আমার একদম ভাল লাগে না। আমি যে একজন আদ্যন্ত অসফল এবং অসুখী মানুষ।