পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং থেকে যে রাস্তাটা শহরের পূবদিকে চলে গিয়েছে তার পোশাকি নাম সুরাবর্দি এভিনিউ। এই সুরাবর্দি কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের, অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সেই কুখ্যাত খলনায়ক নন। ইনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর, তবে সম্পর্কে সেই খলনায়কের আত্মীয় তো বটেই।
সেই পথে যেতে যেতে মনে পড়লো বাঁ দিকে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের পাশে এক চিলতে শর্টকাট রাস্তা ধরে
এককালে পৌঁছে যাওয়া যেতো আমাদের মেডিক্যাল কলেজে। দেখতে পেয়ে সেই গলিপথেই ঢুকে পড়লো গাড়ি। কিন্তু কলেজ খুঁজে পাওয়া গেল না। কারণ, ততক্ষণে রাস্তা ভুলে ঢুকে পড়েছি কোনও এক কানা গলিতে!!
আসলে যতটা মনে হয়, নস্টালজিয়ায় ফেরত যাওয়াটা ঠিক ততটা সহজ নয়।
অগত্যা ফিরে আসা হলো মূল রাস্তায় ।পথচারীদের এক প্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদের পর কানা গলি পেরিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল সঠিক পথ।
গন্তব্যে পৌঁছে দেখছি , তিরিশ বছর আগে শেষ দেখা লোহার গেটটা কেমন বদলে গিয়েছে চেহারায়। অবশ্য পাশের দেওয়ালে মার্বেল পাথরে এখনো ঝকমক করছে সেই ঠিকানা, ৩২ নম্বর গোরাচাঁদ রোড।
কিন্তু চার একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই কলেজ বিল্ডিংগুলির বয়স, মাত্র তিরিশ বছর নয়। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে ১৯৩০ সালে ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের দান করা জমিতে শুরু হওয়া ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুলের কাজ শেষ হয় ১৯৩১ সাল নাগাদ।
ততদিনে ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে বেরিয়ে আসা ডাক্তারি পড়ুয়াদের পড়াশোনা’র উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়ি থেকে উঠে এসেছে কাশিমবাজারের জমিদার মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর কাঁকুড়গাছির বাগানবাড়িতে। সেখানে জুনিয়র ছাত্রদের চলছে ক্লাস। কিন্তু সিনিয়রেরা ক্লিনিক্যাল ডিউটি করতে আসছেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলের ঠিক বিপরীতে, গোরাচাঁদ রোডে তৈরি হওয়া নতুন হাসপাতালে।
সেটা ১৯২৫ সাল। শহরের প্রথম মেয়র চিত্তরঞ্জন দাশের বদান্যতায় কলকাতা কর্পোরেশন পাঁচ একর জমি দান করে হাসপাতাল তৈরি করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ১৯২৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, একটি ১০০ বেডের হাসপাতাল তৈরীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৪ নম্বর গোরাচাঁদ রোডে শুরু হয় সেই হাসপাতালের কাজ। দেশবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই হাসপাতালের নামকরণ হয়- চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল।
পুরনো শহর কলকাতা। ধীরে ধীরে বাড়ছে আকারে আর আয়তনে। ডিহি শ্রীরামপুর রোড আর গোরাচাঁদ রোডের সংযোগস্থলে সেই ফাঁকা জমিটি’র মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল একটি সুপ্রাচীন বটগাছ। তার পাশে একটি তিনতলা বাড়িতে হাসপাতালের সূচনা ঘটলো। সে বাড়ির এক তলায় প্রশাসনিক দপ্তর, দোতলায় ওয়ার্ড আর তিন তলায় ডাক্তারদের থাকবার জায়গা। জমিটি’র মূল ফটক পেরোলে তিন কামরা বিশিষ্ট একটি বাংলো ছিল ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর কালাজ্বর ওয়ার্ড, পরবর্তী কালে সে জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় রাজা রামমোহন রায় মেডিক্যাল ব্লক। আর ঠিক সেভাবেই কলেরা ওয়ার্ড পরিবর্তিত হয়ে যায় বর্তমান প্রশাসনিক ভবনে। জমির উত্তরভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্জিক্যাল এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড। ধীরে ধীরে হাসপাতালের বর্তমান কলেবরের গঠন সম্পন্ন হয়।
তবে ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলের একত্রিত হতে আরও সময় লাগে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরের বছর, ১৯৪৮ সালে এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিশে, তৈরি হয় ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ।
এসব পুরনো কাহিনি। নিজের কলেজের ইতিহাস জানার চেষ্টা। তবে সময়ের সাথে সাথে তো সবই পুরনো হয়। যেমন এখন আমরা পুরনো হয়েছি। পাক ধরেছে চুলে।
১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম যেদিন এই লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকছি কলেজে,সেইদিনের অভিজ্ঞতা আর আজকের অনুভবের মধ্যে তাই পার্থক্য আসমান জমিন।
এবং শুধু সেটা কলেজ বিল্ডিংয়ের নীল সাদা রঙ নয়। আরও অনেক কিছু।