প্রিন্সেপ ঘাটকে বাঁ পাশে রেখে স্ট্রান্ড রোড ধরে উত্তর দিকে দিকে যাচ্ছিল সৈকত। এমনিতেই এই রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকা থাকে, তায় আজ রবিবার, ছুটির দিন। জানালার বাইরে ন’টার বৈশাখী সকাল। গাড়ির মনিটরে আটত্রিশ ডিগ্রি। ভিতরে বাইশ।
সকালে গঙ্গার ঘাটে এইসময় খুব ভিড় হয়। শ্রাদ্ধকর্ম, গঙ্গাস্নান, জল ভরতে আসা – অনেকে তো আসে স্রেফ বেড়ানোর জন্যই। হঠাৎই যেন মনে পড়ল, সেও এরকম এসেছিল অনেক অনেক বছর আগে এরকমই এক বৈশাখে রবিবারের সকালে। উপনয়নের এগারো দিনের দিন দণ্ডি বিসর্জন দিয়ে গঙ্গাস্নান করে প্রতীকী ব্রহ্মচর্যের অবসান করতে। একা তো আসেনি। বাবা, কাকা, কাকিমা, পিসি, মাসি, ভাই বোন, দাদা দিদিরা – বালিগঞ্জ থেকে খানকয়েক ট্যাক্সি ভাড়া করে সবাই মিলে। আর এসেছিল সে। রমা। একটু সসংকোচে, হাতে নূতন গামছায় বাঁধা একটা ভারী পুঁটুলি নিয়ে।
চোখ মেলেই সৈকত বাড়িতে দেখেছে রমা কে। বাড়ির সব্বাই তাকে ডাকে, হুকুম করে, বকাও লাগায় ‘রমা’ বলেই – তাই সেও বুলি ফোটার পরে ডাকত- ‘অমা, ও অমা’। তারপর আরেকটু বড় হয়ে রমা। মা বোঝাতেন – “রমা বলে ডাকতে নেই সোনা, রমা পিসি বলতে হয়। তোমার থেকে বয়সে বড় না?” রমা বাধা দিত। “রাকো না বৌমণি, কি মিষ্টি নাগে আমার শুনতে। মনে হয় যেন সগ্গো থিকে আমার বাবা ফিরে এসে ডাকতেছে। আর তাছাড়া, রমা র মধ্যেও ত মা আছে, না, বলো? লোকের ঝ্যামন মাসিমা, পিসিমা হয় না গো, আমি তেমন ওর র মা।” অতএব ‘রমা’ ই বহাল থাকে।
উপনয়নের সময় সৈকত তখন এগারো। সনাতন ঐতিহ্য মেনে চলা বাড়িতে ব্রহ্মচর্যের এগারো দিন মা ব্যতীত আর কোনও নারীর মুখদর্শনও বারণ। দণ্ডি বিসর্জনের পরে স্নান সেরে উঠে এলে একজন অব্রাহ্মণ নারী নবীন দ্বিজকে বরণ করে নেবেন। এরকমই লোকাচার। অন্তত সৈকতদের পরিবারের ধারায়। সৈকতের মা অণিমা বেছে নিয়েছিলেন নিঃসন্তান রমাকে – পরিবারের কয়েকজন এর আপত্তি অগ্রাহ্য করেও। ছেলেকে সে জন্ম থেকে বেড়ে উঠতে দেখেছে, কোলেপিঠে নিয়ে বড় করেছে। বড় ভালোবাসে ও বাবুনকে। ও ই যাক বরং। ওর স্বামী বিয়ের ছ মাসের মাথায় ছেড়ে গেছে – নিঃসন্তান হওয়ায় ওর কী দোষ? বারো বছরের পুরানো কাজের লোককে তিনি শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন কি করতে হবে। অণিমা নিজের ত যাওয়ার উপায় ছিল না – ছেলের এইসব অনুষ্ঠানে মায়ের উপস্থিত থাকাও বারণ। আর এক লোকাচার।
জেঠতুতো দাদার হাত ধরে হাঁচোড়পাচোড় করে, জীবনে প্রথম গঙ্গায় ডুব দিয়ে উঠে এসে সৈকত দেখল সামনে দাঁড়িয়ে রমা। লাল পাড় সাদা শাড়ি, সাথে ওর ট্রেডমার্ক – কপালে এত্তোবড় একটা লাল টিপ। পান মুখে একগাল হাসি। নূতন গামছা দিয়ে পরম মমতায় গা মুছিয়ে দেওয়ার সময় রমার সে অশ্রুসিক্ত মুখ আজও চোখে ভাসে সৈকতের।
পুঁটুলিতে একখানা ভারী কাঁসার থালা, বাটি আর গ্লাসে করে সৈকতের জন্য আতপ চাল, সব্জি, ফল দিয়ে ভোজ্য সাজিয়ে এনেছিল রমা। সাথে নূতন ধুতি আর পাঞ্জাবি । চমকে গিয়েছিল সবাই, কৃপণ বলে পরিচিত কাকীমা ঘাটেই চাপা স্বরে বলেছিলেন – ‘আদিখ্যেতা’। বাড়ি ফিরে সৈকত আড়ালে শুনেছিল বাবা ওর মা কে বলছেন – ‘রমা ত বোধহয় তিন-চার মাসের মাইনে খরচা করে ফেলেছে তোমার ছেলের জন্য। নির্ঘাৎ ধারবাকীতে কিনেছে। কোনও একটা অজুহাতে ওকে কিছু টাকা দিয়ে দিও। গরীবদের নজর সবসময় বড় হয়, জানো তো গিন্নি?’
তারপরের গল্প অনেক বছর পরে। বারো বছর বয়স থেকে সৈকত নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। তারপরে দিল্লিতে আরও পড়াশোনা, আরও ডিগ্রি অর্জন শেষে সৈকতের ঠিকানা আহমদাবাদ। তখনকার ভাষায় অ্যাপ্রেন্টিস। যৌথ সংসার ভেঙে গেছে কালের নিয়মে, প্রোমোটারের দালালরা ঘুরঘুর করছে শরিকদের কোন্দলের ফাঁকফোকর খুঁজে। রমা কাজ ছেড়ে চলে গেছে বেশ কয়েক বছর। বয়সের জন্য আর পারছিলও না এত কাজ টানতে – তা থেকে নিত্য খিটমিট, মন কষাকষি। একদিন দু মাসের মাইনে আগাম ধরিয়ে সসম্মানে বিদায়। মা’র কাছ থেকে চিঠিতে খবর পেয়েছিল সৈকত। প্রথমবার শুনে একটু মন খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে ওই – ভুলে যেতেও সময় লাগেনি।
ক্রিসমাসের সময় ক’দিন ছুটি জোগাড় করে আহমদাবাদ থেকে কলকাতা এসেছে সৈকত। একডালিয়ায় এক স্কুলবন্ধুর বাড়িতে ঘন্টা দুয়েক গেঁজিয়ে বেলা একটা নাগাদ ফার্ণ রোডের বাড়ির দিকে যাচ্ছে সে। কাল রাতে ট্রেন। গড়িয়াহাট বাজারের সামনের ফুটপাথ থেকে বাচ্চাদের সস্তার শীতের জামা কিনছে ও কে? রমা না! সাথে আরেকজন অল্পবয়সী মহিলা। মাঝে কম করে বারো তেরো বছরের ব্যবধান। রমা কিন্তু চিনতে পেরেছে ওকে – “বাবুন না! কত্তো বড় হয়ে গেছিস রে! কি নম্বা! কি চুল মাথায়! আবার কায়দা করে দাড়ি রেখেছিস! ওমা, কি সোন্দর হয়ে গেছিস তুই! এই দেখ্ বৌমা, এই সেই বাবুন, যার কথা তোদের বলি না, আরে, যার আমি ভিক্ষামা হয়েছিলাম রে।” – শেষ বাক্যটি সঙ্গী মহিলাকে উদ্দেশ করে বলা। তিনি সৌজন্যে মাথা নাড়লেন। রমার চুল সাদা, কপালের টিপ নেই, সাদাকালো ছাপার শাড়ি পরনে। এসব ছাপিয়ে যেটা চোখে পড়ল – ওঁর ডান হাত। কনুই আর কব্জির মাঝে আরেকটা ভাঁজ হয়ে গেছে হাতটায়। প্রথম দর্শনেই কেমন বীভৎস লাগে। সৈকত জিজ্ঞাসা করে – “হাতে কি হল তোমার?”
রমা উত্তর দেয় – “আর বলিস না রে। বস্তির কলতলায় পা পিছলে পড়ে হাত ভেঙে গেছিল। হাসপাতালে পেলাস্টার করে দিল। খোলার পরে জোড়া নাগল নি। আবার পেলাস্টার করল। তাও নাগল না। হাতটা আমার এক্কেবারে নুলো হয়ে গেল রে। আজ আবার শম্ভুনাথে গেছলাম। বলল অপারেশন করে ইস্টিলের পেলেট দিয়ে সেট করে দেবে। পেলেট ত হাসপাতালে পাওয়া যায় না – কিনতে হবে। আড়াই-তিন হাজার টাকা খচ্চা। কোথায় পাব বাবা এত টাকা, বল? এক বচ্ছর হল বেকার, হাসপাতাল ঘোরাঘুরি করে ভায়ের সংসারে গলার কাঁটা হয়ে পড়ে আছি। এই ভায়ের ছেলের বৌটাকে সঙ্গে নে ঘুরছি। বাকি জেবন বোধহয় এভাবেই থাকতে হবে।” চোখ ছলছল করে আসে রমা’র। গলা বুজে যায়।
“তুমি এখনও কসবার সেই ধানকলমাঠেই থাকো তো?” – নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে সৈকত।
“না রে বাবুন, সে মাঠও নেই, বস্তিও নেই। কবে ফেলাট হয়ে গেছে। আমরা এখুন আরও ভিতরে ঝাপানবস্তিতে থাকি। এখান থেকে হেঁটে একঘন্টা নাগে।”
দু এক সেকেন্ড কি ভেবে সৈকত জিজ্ঞাসা করে – “ঝাপানবস্তি বললে লোকে চিনবে?”
রমাও যেন কিছু একটা ভাবছে৷ চির-তমসাচ্ছন্ন মুখে কেমন একটা আলোর আভাস। বলে – “তোরা কি আর অত হাঁটতে পারবি রে বাপ? রিসকাওয়ালাদের বললে নে যাবে। আমাকে ওখানেও সবাই চেনে। আমার মত আবাগীদের খপর সবার কাছে থাকে।”
মাথা নীচু করে চিবুকে হাত বুলিয়ে একটু কি ভাবে সৈকত। তারপর রমাকে বলে – “ঠিক আছে তুমি বাড়ি যাও। আমি দেখি গো, কিছু করা যায় কিনা”।
“আচ্ছা।” ঘাড় কাত করে একটু হাসে রমা। তারপরে আবার বলে “মা বাবা ভালো আছে তো? তুই ও ভালো থাকিস বাবা। চল রে বৌ।” আস্তে আস্তে হাঁটা লাগায় বিজন সেতুর দিকে। রমা এখন একঘন্টা হাঁটবে।
সৈকত ও পা চালায় বাড়ির দিকে। মা বসে থাকবেন লাঞ্চের জন্য। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। যেতে যেতে সে পরিকল্পনা শুরু করে। টাকাটার বন্দোবস্ত করে একদিন রমার বাড়ি যেতে হবে। সামান্য কিছু টাকার জন্য একজনের হাতটা সারাজীবন এভাবে বিকৃত-বিকল হয়ে থাকবে, এ তো হয় না। সৎ পরিকল্পনা আসে, পিছু পিছু আসে একশো সমস্যা, হাজারটা দোটানা। কবে যাবে সে রমার কাছে টাকা নিয়ে? কাল রাতেই তার ট্রেন, পিছোনোর কোনও প্রশ্নই নেই। কাল দিনের বেলাটা হাতে আছে, কিন্তু টাকাটা? সে স্টাইপেন্ড পায় বত্রিশশো পঞ্চাশ টাকা। জমার খাতায় কিছুই থাকে না, উল্টে কখনও কখনও বাবার কাছে চাইতে হয়। সামনের মার্চে বোন সুমনার বিয়ে। বাবা এখন আড়াই তিন হাজার টাকা হাতছাড়া করবেন মনে হয় না। মা সংসার খরচ থেকে এবং বাবার পকেট মেরে ভালোই জমান, কিন্তু এ সময় মা’র কাছ থেকেও পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া, রমা এ বাড়ি ছেড়েছে ভয়ানক তিক্ততার মধ্যে দিয়ে। ছেলের ব্রহ্মচর্যভঙ্গের দিনের মধুর স্মৃতি কবেই ডুবে গেছে দৈনন্দিন কালিমার অতলে। যদি মা সরাসরি না করে দেন? যদি মা ভাবেন, তার ভোলাভালা ছেলেটাকে পেয়ে গরীব রমা সুযোগ নিচ্ছে টাকাটা যোগাড় করার? না না, সে বড় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হবে। তারচেয়ে সৈকত কাল আমদাবাদ ফিরে যাবে। মার্চেই ত সে ফিরে আসছে। এর মধ্যে সে কিছু টাকা জমাবে, তিন মাসে হাজার খানেক। হাজার খানেক টাকা দু তিন জন কলিগের কাছ থেকে ধার নেওয়া যায় কি? যদিও সে কোনওদিন কারুর কাছে ধার নেওয়ার কথা ভাবেও নি – কিন্তু অন্যরা তো নেয় প্রয়োজনে একে অন্যের কাছ থেকে। সে ও চাইলে নিশ্চয় পাবে। বাকি শ পাঁচেক টাকা সে বাবা-মা র কাছে থেকে এটা ওটা বলে ম্যানেজ করে নেবে। রমা ত আড়াই-তিন বলেছিল, আর পাঁচশ যদি লাগে, রমা নিশ্চয় জোগাড় করতে পারবে এই কদিনে। সে কি কাল রমার বাড়ি গিয়ে বলে আসবে? না থাক – তার চেয়ে বরং একেবারে মার্চেই যাবে। একেবারে টাকা হাতে নিয়ে প্লেজান্ট সারপ্রাইজ। রমা নিশ্চয় খুব খুশী হবে, আনন্দে কেঁদে ফেলবে। অপারেশনের দিন সে পারলে কলকাতা আসবে, হাসপাতালে যাবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই সৈকত বাড়ি পৌঁছায়, দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ভাতঘুম দেয়, সন্ধ্যাবেলায় কফি হাউসে যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে। মধ্যবিত্তের সাধু সংকল্প শীতঘুমে চলে যায় মধ্যবিত্তেরই আগমার্কা কালক্ষেপণে। তারপর মার্চে বোন সুমনার বিয়ে হয়ে যায়, সৈকতের চাকরি পাকা হয় কিছুদিন পরে, বেতন অনেক বাড়ে, মা অণিমা সৈকতের জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেন, আরও কত কি চলতে থাকে নিয়ম মেনে – রমা আর তার বিকৃত অক্ষম ডান হাত চলে যায় মস্তিস্কের নিদ্রিত বিস্মৃতিকোষে৷ ভুল বলা হল হয়ত – বিস্মৃতি ঠিক নয়। ‘ওরকম তো কত জনেরই হয়, সবারই কি আর চিকিৎসা জোটে’ – এই রকম এক ছদ্ম, নির্লিপ্ত দার্শনিকতা, যা প্রয়োজনে সব অপারগতার ও সদিচ্ছার অভাবের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
এইসবই গত শতাব্দীর শেষ বছর আর এই শতাব্দীর প্রথম বছরের কথা। সৈকত তখন চব্বিশ-পঁচিশ। তারপরে আজ, তেইশ বছর পরের এক পয়লা বৈশাখের সকালে গঙ্গাপারের ভাসমান হোটেলে নববর্ষ সমাবেশে যাওয়ার পথে, সবরমতীর জলে ডুবে যাওয়া স্মৃতির কোন অতল থেকে উঠে এল রমা। সৈকত এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আজও সে কুর্তার সাধে ধুতি পড়েছে, ইলাস্টিক দেওয়া যদিও। মেয়ের কিনে আনা – জন্মদিনের উপহার।
আড়াই হাজার টাকা! আজকের কর্পোরেট বস্ সৈকত মুখোপাধ্যায়ের কাছে ওই টাকাটা কিচ্ছু না, স্রেফ কিচ্ছু না। কিন্তু সেদিন, দুহাজার সালের ডিসেম্বরে সেটা তার মান্থলি স্যালারির প্রায় সমান ছিল। সহজ ছিল না টাকাটা জোগাড় করা।
আগের মতই প্রবোধ এসে অনুতাপকে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছিল প্রায় – কিন্তু কি হয়ে গেল আজ, ফ্লোটেলের ডেকে গঙ্গার শনশন হাওয়া যেন অন্যরকম বেসুরো কথা বলে উঠল দুই যুগ পার করে। ‘তোমার র-মা যখন তোমাকে মহার্ঘ কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাস, ধুতি-পাঞ্জাবী উপহার দিয়ে সংসারে ফিরিয়ে এনেছিল ব্রহ্মচর্য্য শেষে – তার ক’মাসের মাইনের সমান টাকা ধার করতে হয়েছিল সেগুলো জোগাড় করতে, ভেবে দেখেছ সৈকত, কখনও? সে তো নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চায়নি, তোমার মত বড় ঘরের ছেলেকে ওইটুকু না দিলে তোমার মর্যাদা দেওয়া হতনা, তাই হয়ত দিয়েছিল। কিংবা নিঃসন্তান রমণীর তৃষ্ণার্ত স্নেহ ঢেলে দিয়েছিল সে ওই দুঃসাধ্য উপহারে। গা মুছিয়ে দেওয়ার সময় তার আদরটা, তার চোখের জলটা ভুলে গেলে, বাবুন সোনা?’
তড়িঘড়ি লাঞ্চ শেষ করে সবাইকে একটু অবাক করেই বেরিয়ে আসে সৈকত। প্রিন্সেপ ঘাট-ফোর্ট উইলিয়াম-রেসকোর্স-মা ফ্লাইওভার-পার্ক সার্কাস-গড়িয়াহাট হয়ে কসবা মোড় থেকে ডানদিকে ঢুকে থামে। গুগলে ঝাঁপানতলা বস্তির কোনও অস্তিত্ব নেই। বৈশাখের ভর দুপুরে রাস্তায় লোক পাওয়া মুশকিল, তাও এদিক ওদিক জিজ্ঞেস করতে করতে হাজির হয় সেখানে। বস্তিটা আছে। একেবারে গলির মধ্যে হওয়ার কারণেই বোধহয় উন্নয়ন করা যায়নি। তাহলে কি রমা এখনও? লজ্জা, শঙ্কা সব মিলিয়ে বুক ধকধক করতে থাকে সৈকতের। তবে যাইহোক, আজ আর সে ফিরে যাবে না
“না স্যর, রমাঠাকমা তো এখানে আর নেই। তা বচ্ছরখানেক হবে। এ ঘরটা এখন আমরা নিয়েছি। আমার নাম কমল। ওর ভাইও মারা গেল, তাদের একটামাত্র ছেলে ত কবেই লিভার ড্যামেজ হয়ে মরে গেছে – দুই বুড়ি আর কি করবে। ডায়মন্ড লাইনের কোথায় ওদের বাপ-চোদ্দপুরুষের দুয়েক কাঠা জমি আর একটা চালা আছে, সেখানে চলে গেছে। ঠাকমা আপনার কে হত স্যর?”
বিরাট এক বস্তির এ গলি ও গলি ঘুরে, আধঘন্টা ধরে অনেক তালাশ করে ‘নুলো রমা’ র সন্ধান পেয়ে অবশেষে এইখানে এসে থামে সৈকত। মরিয়া হয়ে ঠিকানা, ফোন নম্বর জানতে চায় কমলের কাছে – রমা ওর ‘কে হত’ এই প্রশ্নটা কোনওরকমে এড়িয়ে গিয়ে। ও জানে ওর স্টেটাসের লোককে দুবার এক প্রশ্ন করা মুশকিল এক বস্তিবাসীর পক্ষে।
“ঠিকানা ফিকানা আজকাল আর কে রাখে স্যর। মোবাইল নম্বর একটা ছিল, কাগজে টুকেও রেখেছিলাম, এখন আর নেই।” রমার ঘরের নূতন মালিক বলে। ছুটির দুপুরে তার গলায় কুড়ি টাকার বঙ্গীয় সুরার সুবাস।
বাঁ হাতের তালুতে একটা নিষ্ফল ঘুঁষি মারে সৈকত। আশপাশের সবাইকে থ্যাঙ্কস জানায়। কমলের সাহায্যে অলিগলি পার হয়ে সৌখীন সেডানে উঠে দরজা বন্ধ করে চাবি লাগায়। এসি বাইশ করে দেয়। আজই আবার ভোররাতে ফ্লাইট। লন্ডন ভায়া দোহা।
*******************************************
পাঁচ বাই আট ঘরের মেঝেতে অয়েল ক্লথে শোয়া এক অস্থিচর্মসার পেট ফোলা বৃদ্ধা কমলকে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞাসা করে – “চলে গেছে রে, কমল?”
“হ্যাঁ, ঠাকমা। কে হয় তোমার গো? এত খুঁজে খুঁজে এল, দেখা করলে না। তোমাকে একজন ফর্সা, লম্বা, বড়লোক মানুষ খুঁজছে খবর পেয়েই আমাকে দিয়ে মিছে কথা বলালে?” – আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করে কমল। কটা দিনই বা আর আছে দাদুর এই বুড়ি দিদিটা। কি একটা মেয়েলি টিউমার হয়েছে, পেটটা জল জমে ঢাউস হয়ে গেছে। লাস্ এস্টেজ নাকি।
“কেউ হয় না রে। ওই একঘন্টার মা। তুই বুঝবিনি। তাও আজ থেকে দু কুড়ি বছর আগে একসময় ওর জন্যি আমি ছ’ মাস ধরে পথের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছি।” একটু থেমে জল চেয়ে খায় বুড়ি। তারপর বলে – “আজ ওর টেইম হয়েছে বলে ও এসেছে। আমি ত এখন আর দেকা করতে পারব না রে। আমারও তো টেইমের দাম আছে কিনা, বল কমল?”
————————————————————-
পুনশ্চঃ
এখন সব বিষয়েই Political Correctness নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। অতএব, দুটি ব্যখ্যা।
১) উপনয়নে আচারে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ প্রসঙ্গটি স্রেফ গল্পটি সাজানোর জন্য এসেছে। কোনও জাতিগত বিভেদ করা বা উৎকৃষ্টতা দেখানোর জন্য নয়।
২) প্লাস্টার করার পরে Non union / malunion of fracture একটি পরিচিত ঘটনা, বিশেষ করে গল্পে উল্লেখিত ক্ষেত্রে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে সরকারী হাসপাতালে হাড়ের অপারেশন এত সহজলভ্য ছিল না। এর মধ্যে Medical Negligence এর গন্ধ খোঁজা নিতান্তই ছিদ্রাণ্বেষণ হবে।
————————————————————-