আচ্ছা, ঈশ্বরে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে দূরত্বটা ঠিক কত খানি? কখন একজন মানুষ নাস্তিক হয়ে পড়েন? আমি হয়ত ভুল, কিন্তু কয়েকজন কম্যুনিস্ট ছাড়া আমার নিজের চারপাশে যেসব মানুষদের দেখেছি ভগবানে বিশ্বাস নেই তার বেশির ভাগের পিছনেই আছে না পাওয়ার অতৃপ্তি। মানে ধরুন আপনি কিছু একটা চাইলেন আপনার ভগবানটির কাছে, সেটা হতে পারে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া, কোন নারীর হৃদয় জয়, চাকরি পাওয়া, অথবা প্রিয়জনের রোগমুক্তি। আর সেই ইচ্ছা, সেই স্বপ্নটা সত্যি হল না। সেদিন থেকে অবিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু করল মনে। আর ভক্ত অস্বীকার করা শুরু করল ভগবানের অস্তিত্বকে।
আজকের স্ক্যালপেলের শুরুতে এত বড় একটা গৌরচন্দ্রিকার কারণ আছে। সেই কারণটা বলার আগে দুটো গল্প বলি। দুটোই ইংল্যান্ডের। দুটোই আমার সাথে ঘটেছে গত এক বছরের মধ্যে।
||
প্রথম গল্পটা মাস সাতেক আগের। আমি হসপিটালে অন কলে আছি। রাতের ডিউটি। মানে রাত আটটায় শুরু হয়ে শেষ হবে পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায়। প্রথম ঘন্টা দুয়েক খুব একটা চাপ যায় নি। তবে সাড়ে দশটা নাগাদ দৌড়তে হল মেডিসিন ওয়ার্ডে।
ভিক্টর জোন্সের বয়স ছিয়াত্তর। দিন চারেক আগে ফুসফুসের ইনফেকশন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিসিন ওয়ার্ডে। কিন্তু হটাৎ করেই শুরু হল পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। কোন ব্যথার ওষুধেই আর কাজ হচ্ছে না। মেডিসিনের ডাক্তারা তাই আর সময় নষ্ট না করে পেটের সিটি স্ক্যান করালেন। আর তাতে যা বেরোলো তার জন্য এই সার্জেন ডাক্তারবাবুকে ডাকতে হল। ভিক্টরের অ্যাকিউট মেসেনটারিক ইসকেমিয়া হয়েছে।
আমাদের পেটের ভিতরের যত নাড়ি ভুড়ি আছে তাদের গায়ে লেগে আছে ফ্যাটের একটা পাতলা চাদর। এই চাদরের নাম মেসেন্ট্রি। আর মেসেন্ট্রির মধ্যে থাকে মেসেনটারিক ধমনী আর শিরা। এই ধমনীকে অন্ত্রের হৃদপিন্ড বলা যেতে পারে। আর মাধ্যমেই অন্ত্রে পৌঁছয় অক্সিজেন আর খাবার। আর যদি কখনো এই পথটা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কি হবে?
নাড়িগুলো তো আর শ্বাস নিতে পারবে না, খাবার পাবে না। মরে যাবে একটু একটু করে। পেটের নাড়িতে এই রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার গাল ভরা নাম হল মেসেনটারিক ইসকেমিয়া।
ভিক্টরের পেটের স্ক্যানে দেখা গেল যে ওর মেসেনটারিক ধমনীতে একটা বেশ লম্বা আর বড়সড় জমাটবাঁধা রক্তের টুকরো। আর তাতেই নাড়ি গুলোর দম বন্ধ হয়ে আসছে। সেটাই ভিক্টরের পেটে ব্যথার কারণ। এটা এমন একটা যন্ত্রণা যেটাকে ব্যথার ওষুধ দিয়ে সাড়ানো অসম্ভব। আমি যখন ভিক্টরকে প্রথম দেখলাম তখন মানুষটা বিছানায় ছটফট করছে। মরফিনও ছুঁতে পারেনি ওর ব্যথাকে। এই অবস্থায় একটাই কাজ করার, ওকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে মরে যাওয়া অন্ত্রের অংশ গুলোকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু ভিক্টরের শরীরের হাল তো আর বাকিদের মতো নয়। ওকে অজ্ঞান করে অপারেশন করলে বাঁচিয়ে ফেরানো যাবে তো?
এই প্রশ্নের মোটামুটি একটা উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা একটা অ্যালগরিদম বা সূত্র ব্যবহার করি। এর নাম ‘পি-পসাম’। এটা একটা সফটওয়্যার। রুগীর বয়স, কয়েকটা রক্তের পরীক্ষার ফল আর অন্যান্য কিছু রোগ থাকা বা না থাকার ওপরে নির্ভর করে এই সফটওয়্যার আমাদের বলে দেয় অপারেশন করলে সেই রুগীর বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা কতটা। ভিক্টরের পি-পসাম স্কোর যখন আমি কম্পিউটারে বার করছি ততক্ষণে আমার কনসালট্যান্টও এসে গেছেন। স্কোরিংয়ের রেজাল্ট এল খুব খারাপ। অপারেশন করলে ভিক্টরের মারা যাওয়ার আশঙ্কা শতকরা আশি শতাংশ। আমরা দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকালাম এবারে।
কোন আশাই নেই। ভিক্টরকে বাঁচাতে পারব না আমরা। ওকে শান্তিতে যেতে দেওয়াই ভাল।
অপারেশন করলে ভিক্টর টেবিলেই মারা যাবে।এটা ওকে বোঝাতে হত আমাকে। কিন্তু এবারে ওর কাছে যখন আমি আবার গেলাম তখন আমার হাত দুটো ধরে ফেললেন প্রৌঢ়।
– আপনি আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিন প্লিজ।
– আমরা চেষ্টা করছি মিস্টার জোন্স।
– প্লিজ আমার অপারেশন করুন আপনারা, প্লিজ।
– কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনার জ্ঞান না ফেরার সম্ভাবনা খুব খুব বেশি, সেটা তো বললাম আপনাকে।
– হোক তাই। তাতে আমার কষ্টটা তো আর থাকবে না। এই যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বুড়ো মানুষটা যখন আমার হাত ধরে কাঁদছেন তখন আমার পাশেই কনসালট্যান্টও দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের কেউই কাজের জায়গাতে ইমোশনাল হই না। কিন্তু সেদিন ভিক্টরকে অসহ্য কষ্ট সহ্য করতে দেখে মনে হয়েছিল অপারেশনে মারা যাওয়ার আশঙ্কা আশি শতাংশ। কিন্তু তার মানে প্রতি একশোবারে কুড়িবার তো ভিক্টরকে বাঁচানোও যাবে।
থিয়েটার টেবিলে যখন ভিক্টরের পেটটা লম্বালম্বি ভাবে কেটে ভিতরটা দেখলাম তখন আমাদের সেই কুড়ি ভাগের মোমবাতির আলোটা এক ফুঁয়ে নিভে গেল। প্রায় গোটা নাড়িভুঁড়িই রক্ত না পেয়ে কালো হয়ে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থাতে ফেরানো অসম্ভব।
সেদিন আর ভিক্টরের জ্ঞান ফেরেনি।
||
দু’নম্বর ঘটনাটা ঘটল সপ্তাহ দুই আগেই ।
ডাঃ অমিত প্যাটেল ইংল্যান্ডের প্রথম দশজন গ্যাস্ট্রো-ইন্টেসটিনাল সার্জেনদের একজন। বয়স ষাটের কাছাকাছি। দুর্দান্ত সার্জিকাল স্কিল আর অভিজ্ঞতা। সেই লোকটাকে দেখলাম একটাই রুগীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এমনটা হল পরপর তিনদিন।
বার্নাডেট সিম্পসনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন কারণ পেট ফুলে গেছে। পাঁচদিন হয়ে গেল মলত্যাগ করছেন না।
বার্নাডেটের এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে পেটে অপারেশন হয়েছে মোট ছ’বার। প্রথমে অ্যাপেন্ডিক্স, তার পরে গল ব্লাডার, তারপরে কোলনের ক্যান্সারের জন্য, তারপরে জরায়ু বাদ দেওয়ার জন্য। শেষ দুবার আগের অপারেশন থেকে তৈরি হওয়া হার্নিয়া সারানোর জন্য। এতগুলো অপারেশনের জন্য তৈরি হওয়া স্কার টিস্যুতেই নাড়ি জড়িয়ে গেছে। এমন একটা পেট যে কোন সার্জেনের বধ্যভূমি।
বার্নাডেটকে তিনদিন স্যালাইন দিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। যদি অন্ত্রকে রেস্ট দিয়ে অবস্থা একটু ভাল হয়। কিন্তু তার কিছুই হল না।
– কি ভাবছেন ডাঃ প্যাটেল?
– ভাবছি কি করা যায় এবারে। শ্যাল উই গো ইন নাও?
– আর তো কোন উপায় নেই।
– নাহ, তিনদিন কনসারভেটিভলি ম্যানেজ করে তো দেখলাম, কিছুই তো হল না।
– কিন্তু ওর অপারেটিভ হিস্ট্রি..
– সেটাই চিন্তায় ফেলছে অনির্বাণ। পেটের মধ্যে এখন এত স্কার থাকবে যে সে সব কটা ছাড়ানো খুব খুব রিস্কি। কিন্তু সত্যিই আর তো কোন উপায় নেই। এভাবে ফেলে রাখলে তো আর বাঁচানো যাবে না ওকে।
সেদিন বিকেলে আমরা বার্নাডেটকে থিয়েটারে নিয়ে এলাম। ডাঃ প্যাটেল খুব খুব সাবধানে একটু একটু করে ওর পেট কেটে ভিতরে ঢুকলেন।তারপরে দুজনকেই কয়েক মিনিটের জন্য থামতে হল।
বার্নাডেটের গোটা পেটে নাড়িভুঁড়ি জড়িয়ে গেছে। মাকড়সার জালের মতো স্কার টিস্যু ছড়িয়ে আছে পেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ফুলে থাকার জন্য নাড়ির দেওয়াল গুলোও পাতলা ফিনফিনে হয়ে আছে।
অনেক অনেক ধৈর্য নিয়ে ঘন্টা দুয়েক ধরে এক একটা ইঞ্চির নাড়ির জট ছাড়াচ্ছিলেন ডাঃ প্যাটেল। হাতের সুক্ষ নড়াচড়াতে যে ম্যাজিক হচ্ছিল সেটা আমি উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছিলাম। একটা সময় মনে হচ্ছিল যুদ্ধটা হয়তো আমরা জিতেই যাব। আর একটু, আর একটু অংশ ছাড়াতে পারলেই..
এত যত্ন সত্ত্বেও একটা জেদী জট ছাড়ানোর সময় নাড়ির একটা জায়গা ফুটো হয়ে গেল। ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না। ওই জায়গাটা ছাড়িয়ে নিয়ে পরে সেলাই করে দিলেই হবে। কিন্তু ডিসেক্ট করে নাড়িটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো একটা ফুটো হল। তারপরে আরো একটা, কয়েক মিনিট পরেই আবার একটা। পুরনো কাগজের মতো ছিঁড়ে যেতে লাগল বার্নাডেটের অন্ত্র। পেট ময় তখন ছড়িয়ে যাচ্ছে অর্ধ পাচ্য খাবার, পিত্ত, মল।
একটা সময় ডাঃ প্যাটেল অ্যানাস্থেসিস্টকে বললেন,
– আর বাঁচাতে পারব না ওকে। উই আর ক্লোসিং হার অ্যাবডোমেন।
বার্নাডেট সিম্পসন অপারেশনের কয়েক ঘন্টা পরেই মারা যান।
||
আমি প্রায়শই শুনি ডাক্তাররা নাকি ভগবান। ভগবানের রূপ। সাধারণ মানুষই এমন বলেন। হয়ত নিজের মন থেকেই বলেন। কিন্তু কাউকে ভগবান ভেবে ফেললেই সেই লোকটার ওপরে প্রত্যাশা হয়ে যায় আকাশচুম্বী। তার কখনো ভুল হতে পারে না। সে সব সময় মৃত্যুকে জয় করবেই। কিন্তু এমনটা তো হয় না কখনো। ভিক্টর মারা যায়, বার্নাডেট মারা যায়। তখনই কি ভগবানের ওপরে অবিশ্বাস জন্মায়? ক্ষোভ,ঘৃণা তৈরি হয়? সেই জন্যই কি রুগীর বাড়ির লোক চড়াও হয় ভগবানের ওপরে? তার মাথা ফেটে যায়, ঠোঁট কেটে যায়। নর্দমা থেকে পাঁক তুলে লেপে দেওয়া হয় সারা শরীরে।
আপনার ডাক্তারটি ভগবান কোনদিনই নন। একদম ছাপোষা একজন মানুষ। যে চেম্বারে রাশভারী ভাব দেখালেও বাড়িতে সোফায় পা গুটিয়ে বসে চা খায়, কান খোঁচায়, আই পি এল দেখে, বাথরুমে গান গায়, বউয়ের সাথে ঝগড়া খুনসুটি করে। একদম আর পাঁচটা মানুষের মতোই।
শুধু পেশাগত কারণে সেই লোকটা আপনার সাথে মৃত্যুর একটা দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করে। এইটুকুই যা তফাৎ বাকিদের সাথে। তার জন্য তাকে পুজো করার দরকার নেই।
সহানুভূতি টুকুই যথেষ্ট।