ঝাঁঝালো দুপুর-রৌদ্র সর্বদা বিরক্তি উদ্রেকের কারণ নহে। কখনো কখনো তাহারই মধ্যে ছায়া ও ছবি হইয়া ছড়াইয়া ছিটাইয়া থাকে বাল্যের ইকড়ি মিকড়ি দৃশ্য অথবা কৈশোরের তপ্ত জ্বরো দেহ। ধরা থাকে, বিগত জনম ছায়াপট। শ্রুতিগোচর হয় প্রশান্ত ছায়ানট। ঝাঁঝালো তীব্র দ্বিপ্রহরে, তেমন তেমন অবসর যদি মেলে।
কতকটা তেমনই হয়েছিল সেবার রিসর্টে পৌঁছানোর অব্যবহিত পর মুহূর্ত থেকে। আগেই বলেছি, জায়গাটা মুরাডির কাছাকাছি। এসেছি এখানে, গাড়ি হাঁকিয়ে আমরা। এসেছি, আমি, মা আর শুভ্রা। হাঁকানো অর্থে চালনা করিনি যদিও। সম্ভব নহে। এ বিদ্যা, এ যাবৎ আমার এই জনমে অধরা। অগত্যা … ইলা হি ভরোসা। ভর করেছি বাধ্য হয়ে সারথীর। একটি অত্যন্ত ভদ্র আর আপদমস্তক মানভূমি চালক গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাদেরকে এ পথে। আর সেই ব্যবস্থাটি করে দিয়েছে পার্থ। আমার বাল্য বন্ধু। পার্থ সারথি মাহাতো। সে ব্যাটা এখন জবরদস্ত সরকারি আমলা হয়েছে ‘হে গম্ভীর’ । চেয়ারের পশ্চাৎদেশে পেলব কুশন আর পৃষ্ঠদেশে সবুজ তোয়ালে কায়দা-দুরুস্ত থাকে সর্বদা। দেখিনি যদিও সেসব স্বচক্ষে। তবুও… পার্থর রোয়াব বলে দিচ্ছিলো এক কথাতে – এসব অনিবার্য। নইলে, ভেলকিবাজির মতো গাড়ির জোগাড় হয়ে যায় এক রাত্তিরের তলবে!
সকাল আটটাতেই দোরগোড়াতে হাজির হয়েছিল চকচকে চারচাকা। রঙ যার, তাক লাগানো লাল। চালকের নাম যেটির – কৃষ্ণ। নামপত্তর এক্ষেত্রে, অবশ্য লক্ষ্যণীয় বটে। কিঞ্চিৎ ক্লেশেই মালুম পড়বে যে, এ সকলই বিশুদ্ধ মহাভারতীয়। অন্তত পুরুষদিগের।
সে কথা থাক। তফাত হঠুক। গওর ফরমান এইবেলা আসল কিসসাতে।
“চিন্তা করিন্না… লিয়ে যাঁবে ঠিকঠাক করে। খালি… একটু কথা টথা বল্যে লিস। ডাক্তার যাবেক শুনে টেনশনে আছে বেচারি।”– বলেছিল পার্থ গত রাত্রে দূরভাষে।
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয় যদিও। কৃষ্ণ খানিকটা চুপচাপই ছিল প্রথম দিকটাতে। সন্ত্রস্ত আর তটস্থ যেন একটু আধটু। তারপর, আমার বকবকানিতে রাশ আলগা হলো ক্রমে। “এটা কী? ওটা এখনো আছে?”-র উত্তরে সঙ্গত করে যাচ্ছিল বাকায়দা বহোৎ খুব।
“পলাশ অ্যাখোনো ফুটে নাই ই বছ্রে। পন্হরো দিন পরে আইসল্যে দেইখতেন তখন…। দমে গাড়ি আসে ই ধারেঁ টুরিস লিয়েঁ।” – কৃষ্ণ বলছিল গাড়ি চালাতে চালাতে। ভেবে দেখলাম ভালই হয়েছে এক দিক থেকে। এরকমটিই চেয়েছি। ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে বেড়াতে আলগোছে। নতুবা, কী বা আর দেখার আছে এ মুলুকে! সুরম্য কুটির অথবা ধামসা মাদল সহযোগে ‘ইকো ট্যুরিজম’ বেবাক অস্বস্তিকর লাগে আমার তাবতই। মনে হয় কৃত্রিম। মনে হয়–কলচর দেখতে এসেছেন শহরে বাবু বিবিরা লৌহ শকটে। সঙ্গে এনেছেন খানিক সোডা, গানের কল আর অতি অবশ্য ডিস্পিরিন ট্যাবলেট। অচানক মহুয়া সেবনে যদি শিরঃপীড়া ঘটে শহুরে তবিয়তে। ফুরসতের রগড়, বেকায়দাতে বিগড়ে যাবে তামাম।
তফাতে রাখি আমি এইসকল শহুরে ক্রীড়া। এ পথ আমার শৈশবের সলজ্জ সাহিবাঁ। এ ধূলামাটি আমার কৈশোরের কমবখৎ কলঙ্ক। বেড়েছি, খেলেছি, ছুটেছি, পড়েছি এই … এইখানেই আজনম। মুরাডি ছিল আমার খুশির ইস্টিশন। খানিক বাদেই দামোদর পেরিয়ে সটান আসানসোল আর বার্ণপুর। ট্রেনে যেতে যেতে একদা পুলকিত হতাম মামাবাড়ির মনজিলে। আনোখা আরশোলা রঙের ট্রেনের ডাব্বা। বেতমিজ বাদাম খোলায় ভরপুর মেঝে। সমভিব্যাহারীরা সকলই প্রায় কুলি মজদুর বুদ্ধু আদমী। খৈনি ডলতে ডলতে খাঁই খাঁচা হনুমান চালিশা গাইছে গলা ছেড়ে।
এ পথ ছিল বড় আজুবা। এই যে এই রেলপথ। আদ্রা তক্ গাড়ী আসতো একদমে সিধে। তারপর, ইঞ্জিনে জল খেয়েই আচমকা ছুট লাগাতো উল্টো মুখ। শৈশবে বহুবার বাহুলগ্না জননীকে শুধিয়েছি আমি ব্যাকুল কণ্ঠে–” আবার ফিরে যাচ্ছি? মা? ট্রেন যে ব্যাকে যাচ্ছে এবারে..।” তারপর উমর-এ আর ইত্মিনানে বুঝতে শিখেছি থোড়া বহুত। মালুম হয়েছে দুনিয়ার কলকব্জার কায়দা কানুন।
আদ্রা থেকে একখানি লাইন যায় ফিরসে পিছন পথে। ঠিক যেন ত্রিভুজ। এক বাহু ধরে এসেছি। আরেক বাহু ধরে ফিরছি। অথচ, ওয়াপসি হচ্ছে না কিছুতেই পূর্বপথে। দূরত্ব থেকে যাচ্ছে ত্রিভূজের তিসরা বাহুর। হোলি ট্রিনিটি। ত্রিমূর্তি। তিন তিলষ্ম। ফিরব বললে ফেরা যায় না কভি ভি কিছুতেই। ফাঁক থেকে যায় … দূর থেকে যায় শুরুয়াতি বিন্দু। তফাতেই।
এইটে আরো ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম এইবারে। ওই সেই সেইখানে গিয়ে। মুরাডির নিকটস্থ একচিলতে রিসর্টটিতে। পলাশ তখনো প্রস্ফুটিত হতে শুরু করেনি লাল জ্বালিয়ে। রুক্ষ ভুমিরূপে তখনো ঝকমকাচ্ছে পুটুশ ঝাড় কিংবা ফিনফিনে হলুদ কাঁটাগাছের পুষ্প। গরম পড়েনি মোটে। শীতঋতু সদ্য বিগত। রৌদ্র তাই এক্ষণে ঝাঁঝালোও বটে, আরামদায়কও। দু চোখে ঝিলমিল মেখে নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে, ভারী চমৎকার রকমের ঝিমঝিমে নেশা হয় মগজের গোপন মুলুকে।
সেইসবই করছিলাম। একটু তফাতে এসে। আমি একলা একলা। ওরা নেই। ‘ওরা’ মতলব, মা আর শুভ্রা। ওরা দুইজনে, চপলে, চুটিয়ে চা সহযোগে কাতলা ভাজা খাচ্ছিল দেখে এসেছি ব্যালকনিতে। খেয়েও এসেছি গরাস খানেক। তারপর জুত করে এসে তসরিফিয়েছি কুলগাছের তলায়।
এদিকটা রিসর্টের পিছনদিক। নির্জন। শান্ত। ফুরসৎদার।
সেইখানেতেই আমি ঠ্যাং ছড়িয়ে ধুলায় বসে, স্বপ্নবেলায় পাড়ি দিচ্ছিলাম চুপিচুপি। তারই মধ্যে খাওয়ার ডাক পড়লো। দ্বিপ্রাহরিক। আর সেই খেতে বসেই যোগাযোগটা টের পেলুম জব্বর রকম। ইন্দ্রিয়ের সাথে স্মৃতির।
ওয়াকিফ আছেন নিশ্চয়ই, ইন্দ্রিয়র সাথে স্মৃতির একটা যোগসাজস আছে ভারী চমৎকার রকম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সহসা কুমার শানু শুনলে কিংবা এক ঝলক আম মুকুলের সুবাস ঝাপটা মারলে, সেই যোগাযোগটি বড়ো তীব্ররকম ভাবে টের পাওয়া যায়।
মুখে একটা অপারেশন হয়েছিল আমার বছর তিনেক আগে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম কয়েক রাত্তির। যে দিন অ্যাডমিট হয়েছি, সেইদিনই গভীর রাতে আমার চ্যানেল করেছিল যে সিস্টারটি, তার হাতের পরশে আমার মামাবাড়ির কথা মনে পড়ে গিছল আচম্বিতে। ঠিক যেন দিদার হাত। খাইয়ে, দাইয়ে, উবু করে বসিয়ে, মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে স্টিলের ঘটি থেকে জল নিয়ে নিয়ে। পরশে পরশে তুলতুলে নরম, আর বয়সের ভারের মসৃণতা। আঙুলে, ভিকো ভিকো গন্ধ। চুলে, জবাকুসুম সুবাস। সিস্টারটির সেসব সাবেকি শৌখনতার ঘটা ছিল না বটে। তবে হুবহু একইরকম মসৃণ হাত দিয়ে ছুঁচ ফোঁড়ার সময়ে, মৃদু ধমকেছিল এক্কেবারে দিদার মতোই চোখ পাকিয়ে
–”উঁহ! নড়ো না একদম।”
আলু পোস্তর বাটি থেকে এক খাবলা তুলে ভাতে মাখতেই আজ আবার সেই যোগসাজসটা টের পেলাম। আর মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আশ্চর্য এক ছায়াছবি।
কলপাড়ে কচলে কচলে হাত ধুতে ধুতে হাসছে কাকামণি–“সাবুন! হ্যাহ্! ইয়ারা ক্যামন গাধা দ্যাখ তুই পার্থঅ! সাবানকে সাবুন বইলছ্যে!”
তখন ঠাঁ ঠাঁ দুপুরবেলা। সাদাকালো প্যানোরামা চলছে খাবার ঘরে। গত পরশুই বাসন্তী পূজার পরবে দেশের বাড়ি এসেছি আমি। বাবা আমাদেরকে পৌঁছে দিয়েই পুরুলিয়া ফেরত চলে গেছে দুপুরের গাড়ীতে। আসবে আবার, আজ বিকেল বিকেল নাগাদ। ততক্ষণ, এই পেল্লাই দোতলা বাড়িতে আমি, মা, ঠাকুমা, কাকামণি আর রুণুপিসি। তা, তার মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ। আমার আর কাকামণির। পিসিমণি আর ঠাকুমা তখনো খাচ্ছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। আর মা, আমার সকড়ি থালাতেই নিজের ভাত ঢেলে নিচ্ছে দেড় মুঠো। ওই সেইসময়তেই ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে কাকামণি কথাগুলো বলেছিল।
কাকামণির সাদা চেক চেক লুঙি, দুই হাঁটুর ফাঁকে গুঁজে রাখা। গায়ে, ধপধপে স্যান্ডো গেঞ্জি নবাবের। কাঁধের কাছে পৈতের আভাস। আর চুলগুলো কোঁকড়ানো আর ভেজাভেজা। সদ্য চান করেই খেতে বসে গিছলো লুঙি গুটিয়ে। মাথা থেকে তখনও টসটসিয়ে জল ঝরছে। গা থেকে ভুর ভুর করছে মার্গো সুবাস। যে সুবাসে চোখ বুজলেই দেখা যায় সবুজ জংলার ঘনায়মান মায়া।
আমি নিজে যদিও চান করিনি। অত আমার সময় কোথায়! সন্ধ্যায় ভিসিপি আসবে না?
চন্ডীমেলাতে? তা সে সবের তদারক করবে কে? হাঁসের ঘরের সামনে গোড়ালি ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পল রাখা ছিল দুটো। কাকামণি কিম্বা পিসিমণির। নীল রঙের ফিতে। গোড়ালির কাছে ক্ষয়া-খসটা। তাই গলিয়েই চললাম আমি টুম্পার বাড়ি। পিছনে পড়ে রইলো ঠাকুমার চিৎকার – “হাঁ দ্যাখো, হাঁ দ্যাখো… এসে কি এসেই চইলল্যো! …বলি… ও ছিলা … খাবি নাই রেই?”
গলা অব্দি তখনো আমার উঠে আসছে লেবুর সরবতের টক-টক আর নরম পেঁড়ার গুড়ো গুড়ো। এর মধ্যেও এখন আবার খাবো কি! ধ্যাৎ! চিল্লাক বুড়ি। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে মরুক গে যাক। কাপড় গুছিয়ে দোরগোড়া তক্কো আসতে আসতে সময় লেগে যাবে অনেকক্ষণ। আমি ততক্ষণে সাতুরগঁড়া পার হয়ে টুম্পাদের বাড়ি। আর সেখান থেকে, আপুদের দোতালাতে।
আপুরাও সকালের ট্রেনে নেমেছে মায়ে পোয়ে। এখন, দোতলায় ঘুরে ঘুরে চপ খাচ্ছিল ওয়াকম্যান কানে। আমাদের দিকে পিঠ। দেখতে পায়নি। শুনতেও।
টুম্পা ঢলে পড়ে শব্দ করলো –”হাহ্ হা।” করেই চাপড় মারল আমার বাঁ কাঁধে। টুম্পা ওইভাবেই হাসে। আমরা জানি। তারপর কানের কাছে মুখ এনে বললো –”মরণ! দ্যাখ পার্থা! ইয়ার ইস্টাইলটা একবার! কোলকাতা দ্যাখাইচ্ছে! ওয়াকম্যান!”
এক লাফে এপাশে সরে এসে মুখ খিস্তি করলাম–” গায়ে পড়বি না একদম! হ্যাট।”তারপর দু জন মিলেই একসাথে ঝাঁপ মারলাম আপুর পিঠে–” এইইই ধ্-ধাপ্পা।”
হাসাহাসি হলো খুব। আপুদের দোতালাটা বড়ো অদ্ভুত। ঘর আছে। ছাদও। তবে পাল্লা নেই। দরজাতেও না। জানালাতেও না। দেওয়ালে চুনকাম করা কোন যুগের। তার উপরে সবুজ সবুজ শ্যাওলার পাৎলা দাগ। বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে ঢুকে ভিজে গেছে।
এ জায়গাটা আমাদের বড্ডো প্রিয়। এখানেই তাসের রঙ মিলিয়ে ‘গাধা পেটাপেটি’ খেলি আমরা। ছেলে আর মেয়েদের টিমে অন্তাক্সরিও। কিন্তু সেসবের জন্য এখন লোক নেই যথেষ্ট। লোকজন আসবে আশ্বিনে। দুর্গাপুজোতে। দীপু নয়ন টিনা সোনাই মনাই। মামণি পিসিও আসবে। বড় কালী আর ছোটো কালীও। সবাই মিলে, আন্তাক্সরি জমে তখন।
এখন সেসব নেই। এখন তিনজনেই মেঝেতে বসে পড়লাম ধুলো সরিয়ে। মেঝেগুলো বড্ডো কিরকিরে। হাঁটু ছিলে যায় মালাইচাকির। আপুর একহাতে চপ, আরেক হাতে কমপ্ল্যানের গ্লাস। জ্যেঠিমা হেবি কড়া। এখানেও কমপ্ল্যানের কৌটো নিয়ে আসে সাথে করে।
সে আনুক। আপুর আরেকবার কমপ্ল্যান খেতে এখনো অনেক দেরি। বিকেল হোক আগে। তারপর ন্না! তার আগে আগে মস্তো প্ল্যানিং বাকি আছে এখন আমাদের। এই বছরে বড় হইছি আমরা। সাইকেল নিয়ে যাই এখন ইস্কুলে। এই বছর তাই বিকেলের গাজনে একলা একলা যাব তিনজনে। কতদূর আর! গড়গড়ান … জগন্নাথ ডাক্তারের চেম্বার … পাদুকালয় … থানা… ব্যাস। তারপরেই মেলা শুরু হয়ে যাবে বাসন্তী গাজনের। চন্ডীদাস পার্ক থেকে শুরু হয়ে আইসক্রিম ফ্যাক্টরি পেরিয়ে আরো অনেক দূর দূর পর্যন্ত।
ছড়ানো ছিটানো মেলা, দু’পাশের মাঠ জুড়ে। মোগলাই খাব ঠিক। আর গেলাস ধরে লস্যি। আর মিষ্টি পান খাবো তিনজনে এক এক পুটুম। খেতে খেতে মুখে দু আঙুল রেখে পুচুৎ করে পিক ফেলবো থ্যাবড়ানো। বড় হইছি তো আমরা! নাকি?
তেমনই হলো। সবটাই ভেবেছিলাম যেমনধারা। চুল আঁচড়িয়ে বেরিয়ে গেলাম ঠিক-বিকেলে। রাধাকান্ত গড়ার জলে তখন নিঃশব্দে চান করছে ছায়া ছায়া পানকৌড়ি। পুটুশ ঝাড়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে শুরু করেছে থেমে থেমে। নারাণী দিদা সন্ধ্যে প্রদীপ দিচ্ছিল আঁচল কাঁধে অশ্বথ তলায়। তাই আমরা একটু থেমে, দু হাত পেতে বাসোতা খেলাম কুড়ুর মুড়ুর। প্রণাম করলাম চটি খুলে। তারপর আবার ব্যস্তসমস্ত হয়ে মেলার পথে।
পথ আটকালো সিকুদাদু। লুঙি। বুকে লোম। সফেদ রঙের, বলয়ের মত চুল টাকের চারিধারে।
– কুথাকে যাইচ্ছো গো নুনু?
– আমরা যাচ্ছি বাসন্তী গাজনে।
– হাঁআঁআঁ দ্যাখো টা। ই বাবা… তুমি রামুর ছিলা না! লয়? উটি কে বটে? সমীরের বড় ব্যাটা নাকি?
– হ্যাঁ, আমি রামুর ছেলে পার্থ। ক্লাস সিক্সে পড়ি। ও আপু। সমীর জ্যেঠুর বড়ছেলে। কোলকাতায়। এটা টুম্পা।
– বঠেঁ ব! হঁহ! কত বড় হই গেলে হে তুমরাঁ! হাঁ শুনো…শুনো এইদিকে….। বলি, রামু আইসছে নকি? ই বছর?
– হ্যাঁ। এসেছে তো। আমরা… আমরা আসি সিকুদাদু? মেলায় যাবো।
– যাও বাবা! যাও যাও। কত বড় হইলে হে তুমরা! হঁ! রাত কইরো না যেন আবার…
সিকুদাদুর এসব কথা ফেলে থুয়ে আমরা তখন ধুলো উড়িয়ে ছুট দিচ্ছি প্রাণপণ। পাথর ঢুকে যাচ্ছে চপ্পলের বুড়ো আঙুলের নীচে। শুনতে পাচ্ছি –
” এখানে পাচ্ছেন ভ্যারাইটি আইটেম। চিরুণী দু টাকা, আয়না দু টাকা,মেয়েদের ক্লিপ দু টাকা, চামচ দু টাকা, পকেট আয়না দু টাকা…। তাড়াতাড়ি আসুন। এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।”
পালা করে ছেলের গলা আর মেয়ের গলায় ঘোষণা হচ্ছে বারে বারে। হাওয়ায় ভাসছে ভেঁপুর আওয়াজ ভঁপর ভঁপর ভঁপ।
আমরা জোরে জোরে হাঁটা লাগালাম আরো। মেলার আগেই মেলা শুরু হয়ে গেছে পথের ধারে। পিঁচিক পিঁচিক লাল প্লাস্টিকের ঘোড়া নাচাচ্ছে আলোর নীচে ধুতি পরা দোকানী। ঘোড়ার পেটটা ফাটা। ঘোড়ার সাথে ল-ম্বা সবুজ নল লাগানো। নলের মাথায় হাঁপর। চিপলেই ঘোড়া নাচছে তুড়ুক তুড়ুক। শব্দ হচ্ছে পিঁক পিঁক। আর ঠিক পাশেই ঘুরছে আর ঘুরেই চলেছে টিনের ইস্টিমার। পেলাস্টিকের গামলায় ফটফটিয়ে চাঁই-ঘুরঘুর ঘুরে যাচ্ছে জল কেটে কেটে। পিছনে, জলের তিরতিরে বুড়বুড়ি।
ওসব আমরা এখন কিনবো না, থাক। আগে তো মেলা দেখি। দরদাম করি। তার …পর। ঠকে যাবো তো তা নইলে। এরা এদিকে দাম হাঁকে বড্ডো। চল রে চল। চল রে চল। পা চালিয়ে। বুক ফুলিয়ে। চল চল।
এই! এইবারে মেলা শুরু সত্যিকারের। লাবণী চাট ভান্ডারের সামনে দেখি মস্তো বড় ভীড়। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি একেবারে। আমরা এসব পেরিয়ে ‘সর্পকন্যা’-য় যাব। কাস্টমার ডাকছে একটা গ্যাঁড়া বামন হেঁকে হেঁকে। তার আগেই হঠাৎ টান পড়ল জামায়। চাট ভান্ডার পেরোতে পেরোতে টকটক গন্ধ শুঁকছিলাম রাজ-কচৌরির। জিভে জল আসছিল টলটলে সুলুৎ। তাকিয়ে দেখি –ছোটো পিসিমণি।
ও বাবা! এরা আবার কখন এলো মেলাতে! তাই যে এতক্ষণ গর্ব করছিলাম –একলা একলা মেলায় ঘুরছি!
– চ্চল! মোগলাই খাবি? তর মা-রাও আইসছে। আয়…।
প্লাস্টিক ফিতের চেয়ার। লাল রঙের আঁশ ওঠা টেবিল। ইস্টিলের কাঁটা চামচ। চামচ-এ, জল লেগে ছিট্ ছিট্। তাই দিয়েই মোগলাই খেলাম খোপ খোপ করে কাটা। গুঁড়ো গুঁড়ো মশলা ছড়ানো রয়েছে ওপরে। লাল সস জিভে ঠেকিয়ে হাসলাম হিহি।
– ” আপুর মগলাইটা কাঁচা দিঁয়েছে রেই! হাঁ দ্যাখটা..।”
খেয়েদিয়ে, আবার চম্পট। বড় হইছি আমরা। সর্বক্ষণ, অষ্টপ্রহর এদের সাথে সাথে থাকলে চলে!
লাইন দিয়ে সর্পকন্যা দেখলাম। … তিন মাথা বাছুর, শিঙঅলা বাচ্চা, তে চোখো নারী। মরণকুঁয়া দেখা হলো না আর। কানে তালা দেওয়া মটর বাইকের শব্দ শুনলাম খালি বাইরে থেকে। ওখানে, কালকে যাব। আজ মনে হয় রাত্তির হয়ে গেছে অনেক। হাওয়া দিচ্ছে ঠান্ডা ঠান্ডা। গিজগিজে ভিড় পাল্টে গিয়ে, ছাড়া ছাড়া লোকজন চারদিকে।
ফেরার পথে … বাবার সাথে দ্যাখা। দু টাকা দিয়ে কুলপি-মালাই খাচ্ছি তখন তিনজনে। তিনকোণা বিস্কুটটা আইসক্রিমে ভিজে ভিজে ন্যাতা। মুখে দিলেই – কাগজ কাগজ।
বাবা দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে বাতির নীচে। সঙ্গে হাঁদু কাকা আর শ্যামল কাকা। দেখলো আমাদের একবার। বললো না কিছু। চিনতে পারেনি বোধহয়। অন্ধকার তো খুব এদিকে। লম্ফ জ্বলছে শুধু কুলফিঅলার। ঘন্টা নাড়াচ্ছে টুড়ুং টুড়ুং।
— হাঁ দ্যাখ পার্থা…তর বাপ
— হাঁ ভাইল! চিনতে লাইরছ্যে তকে
আপু, টুম্পা বললো। আমার স্বস্তিই লাগছিল। বকতো নয়তো বাবা এখুনি। রাত হয়ে গেছে কত্তো! আমার … মনকেমনও করছিল একটু একটু। বাবা আমায় চিনতেই পারলো না? ইস!
তারপর অনেক রাতে … মা তখনো সকড়ি ধুয়ে শুতে আসেনি ওপরে … ব্যাঙ ডাকছে কটকট আর শীতশীত লাগছে ফ্যানের হাওয়ায়। … জানালা খোলা ওপর নীচে চার পাল্লার মাথার কাছে… আর ঘুম ঘুম ঘুম নীল মশারির ঘেরাটোপ। … তখন… ঠিক তক্ষণ…
একটা হাত। কপালে। গরম। খসখসে। শক্ত শক্ত। আলতো গলায় বলছে – মেলা দেখলি? কুলপি এখন ক পয়সা রে?
সেই হাতটাতে ঠিক এম্নি রকম গন্ধ ছিল। ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, পোস্ত, বড়ি আর লঙ্কাবাটার।
ওই দিয়েই ভাত খেয়েছিলাম সব্বাই রাত্তিরে। ঘুমিয়ে গিছলাম ভিসিপিতে ‘বই’ শুরু হওয়ার আগেই। আর ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যেতে যেতে আবছা বুঝতে পেরেছিলাম – বাবা ফেরত এসে গেছে পুরুলিয়া থেকে।
এবার … শা-ন্তি।
ওই সেইদিন। সেইদিন থেকে আজ সাতাশ বছর পরে, মুরাডির এক কৃত্রিম রিসর্ট-এ, বাইরে যার শৈশবের পুটুশ আর কৈশোরের বাতাস সাজানো রয়েছে এখনো খুব সোনালী , অথচ জীবন-নাট্যের ‘বাবা’ নামক কুশীলবটি হারিয়ে গেছে অলক্ষ্যে, আর পেরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে অযথা অনেক আয়ুক্ষয় … সেই রকম একটা ‘ফ্রোজেন শট’-এর মুহূর্তে … অচানক আমার ইয়াদ হলো – ফেরাটা সত্যিই দরকার। না হয় আদ্রার মতোই হবে। নাহয় ফাঁক থেকে যাবে শুরুয়াতি বিন্দু হতে। তবুও, ফি-র-বো তো। ফেরা তো যায়! কিছুটা। অন্তত।
রুমে ফিরেই গান চালিয়ে ছিলাম ইয়ারফোনে
–
তাকাই দূরে
শূন্যে ঘুরে,
চিল ফুকারে
মাঠের পারে
গরুর বাথান
গোয়াল থানা।
ওই গো! গাঁয়ের
ওই সীমানা…
বাইরে তখন ঝাঁপিয়ে নামছে দুক্কুর।