‘বি ফাইভ ব্লিড করছে, কাম নাও!’
ক্রিস্টোফার ল্যাঞ্জকে সেদিন সন্ধ্যেবেলাতে আমিই এমার্জেন্সিতে দেখে ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিলাম। ক্রিস্টোফারের বয়স তিরিশ, কিন্তু ওকে দেখলে মনে হয় বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। অস্থিচর্মসার চেহারা, পরণে মলিন জামাকাপড়, দুইপাশের হনু বেরিয়ে থাকা গালে দাড়ি। ক্রিস ড্রাগের নেশা করে। ওকে ভর্তি করতে হয়েছিল ওর ফিমোরাল আর্টারির সিউডো অ্যানিউরিজমের জন্য।
যারা নিজের শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নেন তারা শিরায় সুঁচ ফোটানোতে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু বারবার সুঁচ ফোটানোর জন্য শরীরের চামড়ার তলায় থাকা শিরাগুলি একে একে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে একটা সময়ে দুই হাতের শিরাই ব্লক হয়ে যায়, তখন আর হাতে ইঞ্জেকশন দেওয়া যায় না। তখন নেশাড়ুরা পায়ের পাতার ওপরে ইঞ্জেকশন নিতে শুরু করে। সেই শিরাও নষ্ট হয়ে গেলে তাদের নজর পরে নিজের কুঁচকির ওপরে। আমাদের কুঁচকির মাঝখানের অংশ হাত দিয়ে টিপে ধরলে একটি ধমনীর দপদপানি টের পাওয়া যায়। এটির নাম হল ফিমোরাল আর্টারি। এর মধ্যে দিয়েই রক্ত ছড়িয়ে পরে পায়ের বিভিন্ন অংশে। এই ফিমোরাল আর্টারিতে বারবার ইঞ্জেকশন এর সুঁচ ফুটিয়ে ড্রাগ নেওয়া চলতে থাকে। একসময়ে ধমনীর গা খুব পাতলা হয়ে গিয়ে বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। একে বলে সিউডো অ্যানিউরিজম।
একুশ নম্বর ওয়ার্ডের বি ফাইভ বেডে ক্রিসকে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি যখন ওয়ার্ডে পৌঁছলাম তখন ওর বেড ঘিরে তিনজন নার্স আর এক জুনিয়র ডাক্তার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বেডের কাছে গিয়ে দেখলাম বেডশিট রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
ক্রিসের বাঁ পায়ের ফিমোরাল আর্টারির সিউডোঅ্যানিউরিজম ফেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
একজন নার্স আর একজন জুনিয়র ডাক্তার চেষ্টা করে চলেছেন ক্রিসের বাঁ হাতের কোন শিরা খুঁজে বার করে তাতে চ্যানেল করার, যাতে রক্ত বন্ধ হওয়ার ইঞ্জেকশন এবং স্যালাইন দেওয়া যায়।
আর ক্রিস ওর ডান হাত দিয়ে বাঁ কুঁচকি চেপে ধরে বসে আছে। চেষ্টা করছে অবিরত ভাবে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারাকে আটকাবার। ক্রিসের হাতের গজপিস রক্তে ভিজে রক্ত ওর থাই থেকে গড়িয়ে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
এমন অবস্থায় প্রাথমিক কাজ হল ফিমোরাল আর্টারির ওপরে নির্দিষ্টভাবে চাপ দিয়ে রক্ত বন্ধ করা।
আমাকে দেখে ক্রিস পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করল, তার কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা শরীরে নেশার দ্রব্যের মাত্রার ঘাটতির জন্য,
-আমাকে বাঁচান ডাক্তার! প্লিজ আমাকে বাঁচান!
-আচ্ছা ক্রিস, রক্তটা কোথা থেকে বেরোচ্ছে আমাকে দেখতে দাও প্লিজ।
-আই কান্ট টেক মাই হ্যান্ড অফ দিস ডক্টর! কত রক্ত বেরোচ্ছে দেখো! আমি বাঁচব না!
-কাম ডাউন, আমাকে দেখতে না দিলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব না।
হাতে বেশ কিছুটা শুকনো গজ-পিস নিয়ে ক্রিসের ডানহাতটা কুঁচকির ওপর থেকে সরাতেই পিচিকারি মতো রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসতে লাগল। ফিমোরাল আর্টারিতে রক্তের চাপ ভালই থাকে, তাই একে বন্ধ করা খুব কঠিন। ক্রিসের সিউডো অ্যানিউরজমের পাতলা দেওয়াল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। ঠিক যেখানে অ্যানিউরিজমটা আছে সেই যায়গাটায় বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে রাখলাম। এখন একটাই কাজ- জায়গাটায় চেপে ধরে অপেক্ষা করা, রক্তপাত যদি বন্ধ হয় সেই আশায়।
ততক্ষণে ক্রিস নেতিয়ে পড়েছে। জলদি ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত এনে ওকে দেওয়া শুরু করা হল। আমি ব্লিডিং এর জায়গাটা চেপে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিট পনেরো। তারপরে ধীরে ধীরে গজপিস সরিয়ে দেখলাম রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। তবে আবার রক্তপাত শুরু হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নার্সকে বললাম আমি যেভাবে চাপ দিয়ে আছি ঠিক সেই ভাবে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ওয়ার্ডের বাইরে বেরিয়ে এসে ভাস্কুলার সার্জারির কনসালট্যান্টকে ফোন করলাম।
সেই রাতে ক্রিসের অপারেশন হয়। তবে থিয়েটারে আমি ছিলাম না।
||
এর দু’দিন পরে ওয়ার্ড রাউন্ড দেওয়ার সময় দেখলাম ক্রিসের নাম আমার লিস্টে আছে। ক্রিস বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে।ডান পা ভাঁজ করা, বাঁ পা সামনের দিকে ছড়ানো, সামান্য বিবর্ণ। সিউডো অ্যানিউরিজম থেকে রক্তপাত হতে থাকলে এমার্জেন্সিতে অপারেশন করার উপায় হল গোটা আর্টারিটাকেই বেঁধে দেওয়া, যাতে অ্যানিউরিজমে রক্ত না পৌঁছয়, রক্তপাত আর না হয়। এতে একটা বড় রিস্ক জড়িয়ে থাকে। যদিও সেইদিনের মতো হয়ত মানুষটাকে বাঁচিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু ফিমোরাল আর্টারিই পায়ের মূখ্য ধমনী। তাকে বেঁধে ফেললে গোটা পায়েরই রক্ত চলাচলে ভীষণ সমস্যা হয়। অন্যান্য ছোট ছোট ধমনী (যাকে আমরা কোলাটেরাল বলি) থেকে যথেষ্ট রক্ত না পেলে সেই পা’টি মরে যেতে থাকবে, একসময় কেটে বাদ দিতে হবে।
ক্রিসের পা মরে যাবে কি না তা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হত। আমি যখন ওকে পরীক্ষা করলাম তখন ও পায়ে পালস খুব কম পেলাম, কিছু জায়গা অসাড়ও। তবে চার বোতল রক্ত পেয়ে ক্রিস অনেকটাই চনমনে হয়ে উঠেছে তখন। সেদিন আমার হাতে একটু সময় ছিল, আমার স্বভাববশতই ক্রিসের সঙ্গে সামান্য আলাপ জমাতে শুরু করলাম, লক্ষ্য যদি ওকে ড্রাগের কুফল নিয়ে কোন জ্ঞান দেওয়া যায়।
-খুব জোর এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন আপনি ক্রিস। তবে পা’টাকে আরো কয়েকদিন ভাল ভাবে অবজার্ভ করতে হবে।
ক্রিস মৃদু হেসে বলল, -আপনি ভাবছেন আমি বেঁচে গেছি?
আমি সামান্য অবাক হলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রিস বলল, -দিস ওয়াজ নট দা লাইফ আই ড্রেমড অফ ডক্টর।
-ইফ ইউ ওয়ান্ট ইউ ক্যান স্টিল হ্যাভ আ ডিসেন্ট লাইফ ক্রিস। ইউ রিয়েলি নিড টু ফোকাস অন লিভিং দিস অ্যাডিকশন অফ ইওরস। আওয়ার রিহ্যাবিলিটে্শন টিম ক্যান হেল্প ইউ উইথ দিস।
-হোয়াই ডু ইউ থিং আই টেক কোকেইন ডক্টর?
-আই ডোন্ট নো। বাট উই ক্যান হেল্প ইউ…
আমাকে এবারে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ক্রিস বলল, -প্লিজ ডু মি এ ফেভার। ক্যান ইউ প্লিজ গুগুল মাই নেম? সি হোয়াট কামস আপ।
সামান্য ভুরু কুঁচকে পকেট থেকে ফোন বার করালাম। ক্রিস্টোফার ল্যাঞ্জ লিখে সার্চ করাতে প্রচুর রেজাল্ট এল। তাতে বিছানায় পা মেলে বসে থাকা ক্রিস নেই।
-কান্ট ফাইন্ড ইউ ক্রিস।
-ওকে, নাও অ্যাড ফুটবল আফটার মাই নেম অ্যান্ড দেন সি।
এবারে ক্রিসের নামের পাশে ফুটবল লিখে সার্চ করতেই গুগুল পরপর কয়েকটি ছবি আমাকে দেখিয়ে দিল। স্বাস্থ্যবান পুরুষ গায়ে লুটন ফুটবল ক্লাবের জার্সি পরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নিচে কিছু খবরের লিঙ্ক। তাতে ক্লিক করলাম। সেকেন্ড ডিভিশনের বেশ কিছু ম্যাচে লুটন এফ.সি জিতেছে। গোল করেছে ক্রিস্টোফার ল্যাঞ্জ। সব কটা খবরই বছর পাঁচেক আগের।
-ইউ আর ফেমাস ক্রিস! সরি আই ডিডিন্ট নো।
-আই ইউজড টু বি ফেমাস ডক্টর। চার বছর আগে একটা ফ্রেন্ডলিতে খেলার সময় আমার এই বাঁ পায়ের শিনবোন ভেঙে যায়। টানা ছ’মাস মাঠের বাইরে থাকার পরে রিহ্যাবে এসেও আমি আর দৌড়তে পারিনি। আমার ফুটবলারের জীবন শেষ হয়ে যায়। তারপর আমি কয়েকদিন একটা স্টোরে কাজ করতাম। কিন্তু সেই কাজে আমি টিকতে পারিনি। ফুটবল খেলা ছাড়া আর তো কিছু জানতাম না আমি ডাক্তার। আমার সামনে আর কিচ্ছু ছিল না। একে একে বাড়ি,গার্লফ্রেন্ড, চাকরি সব খোয়ালাম। ফ্রাস্টেশন থেকে বাঁচার জন্যই ড্রাগ নিতে শুরু করেছিলাম। অ্যান্ড নাও আই অ্যাম অ্যাস ইউ সি মি।
আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু বলার মতো শব্দ আমার জিভের ডগায় এসে জমা হচ্ছিল না। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ক্রিস আরো একবার বিদ্রুপের হাসি হেসেছিল, বলেছিল–সো ইউ স্টিল থিংক ইউ সেভড মি?
ক্রিসের পায়ের আরো অবনতি হওয়ার জন্য এই ঘটনার কিছুদিন পরে ওকে কাছের একটা বড় হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। জানি না ওর বাঁ পা বাদ দিতে হয়েছে কী না। যে মানুষটা মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলত আজ তার জীবনে তার বাঁ পাটা কতটা প্রয়োজন সেটাও জানি না।
||
আমার অনেক পাঠক-পাঠিকা মাঝে মধ্যে মৃদু অভিযোগ জানান এই বলে যে আমার লেখায় বারবার মৃত্যুর কথা চলে আসে।আমার নিজের মনে হয় মৃত্যুই মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, তাকে আমি ভীষণ কাছ থেকে প্রতিনিয়ত দেখি। তাই তাকে নিয়েই যে লিখব এমনটাই স্বাভাবিক। এর পরের স্ক্যালপেলেই হয়ত মৃত্যু আসবে আবার। তবে মানুষ মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে চায়। কেন? মৃত্যুর পরে কী আছে সেই অনিশ্চয়তার কথা ভেবে? জীবনকে ভালবেসে? নাকি আসন্ন মৃত্যুর যন্ত্রণাকে ভয় পেয়ে? একটা জীবনের শেষই তো হয় শেষবারের মতো শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে। এ তো যন্ত্রণারই। কিন্তু কখনও কখনও জীবন যে যন্ত্রণা দেয় তা কি মৃত্যুর থেকে কম? ক্রিসকে বাঁচিয়ে আমি ভেবেছিলাম একটা জীবনকে বাঁচালাম আমি। কিন্তু ক্রিসের কাছে ওর এমন জীবন দীর্ঘায়িত করার কোন বাসনাই ছিল না। যখন ওর কুঁচকি থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসছিল তখন ও জীবনকে ভালবেসে চেপে ধরেছিল কুঁচকির জায়গাটা, তখন শুধু সেই মুহূর্তটুকুর জন্য মৃত্যুভয় ওকে গ্রাস করেছিল। থিয়েটার থেকে ফিরে আসার পর ও আবার সেই আগের দুঃসহ জীবনের ভারকেই বইতে শুরু করে। একটা দুর্ঘটনা আর দুর্ভাগ্য এই দুয়ে মিলে একটা হাসিখুশি চনমনে তরতাজা ছেলেকে ভেঙে দিল।
যখন আমরা কোন মানুষকে দেখি তখন তাকে রাস্তার যে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি সেই মোড়েই তার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নিই। কোন রাস্তা বেয়ে সে এখানে এসে পৌঁছল তা নিয়ে ভাবি না। সে হয়ত কোন একদিন পর্বতের শিখর থেকে তার যাত্রা শুরু করেছিল, আজ সে ক্রমাগত খাদের দিকে নামতে থাকছে। নিচের দিকে গমন যে ভীষণই সহজ। গড়িয়ে নামার সময় তার নিজের উপরেই আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
আসুন এমন মানুষের মুখোমুখি হলে নাক কুঁচকে ‘তুমি এমন কেন হলে?’ এটা জিজ্ঞাসা না করে বরং জানতে চাই-
‘তোমার পথটা কেমন ছিল। কোথা থেকে শুরু করেছিলে তুমি?’