অভিনেতা রুদ্রনীলবাবু লিখেছেন,
“হয়ত একদিন কিছু মানুষ,ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে.. দলমত জাতধর্ম ভুলে কিছু রক্তচোষা বেসরকারি হাসপাতাল ভাঙ্গবে। মালিকরা নিজের হাসপাতালে ভর্তিরও সময় পাবেন না! কাঠের বদলে তার লুঠের টাকা দিয়েই তাকে দাহ করা হবে ধাপার মাঠে! ঘি এর বদলে তার শরীরে ছড়ানো হবে থুতুর আতর। গঙ্গার বদলে তার নাভি ভাসানো হবে দুর্গন্ধের ড্রেনে।…, ঠিক সেই মূহুর্তে, স্বজন হারানো লুন্ঠিত বিপর্যস্ত গরীব ও মধ্যবিত্তেরা হাওয়ায় ছুঁড়ে দেবেন উলুধ্বনির ভ্যাকসিন। তাদের চোখের আগুনে লজ্জা পাবে ভলক্যানোর লাভা!
মহাকাল লিখবেন বাকি ইতিহাস।”
আমি ওনার এই বক্তব্যকে ধিক্কার জানাই।
এখন প্রশ্ন হলো আমি কেন এই বক্তব্যের বিরোধী। নীতিগতভাবে ওনার বক্তব্যকে সমর্থন জানানো উচিত ছিল। কারণ মহামারী সময়ও যেভাবে কর্পোরেট হাসপাতালগুলি ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে শোষণ করে চলেছে তা সত্যিই অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাছাড়া ওনার পোস্টটিতে কোথাও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও কিছু বলা হয়নি।
আমি ওনার বক্তব্যের বিরোধী, কারণ আমার মনে হয়েছে পোস্টটি উস্কানিমূলক এবং উদ্দেশ্যমূলক। পোস্টটি করা হয়েছে মানুষের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে অন্য দিকে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে।
ওনার পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু বক্তব্য আছে।
১.কর্পোরেট হাসপাতাল যদি ভাঙচুর হয় তাহলে মালিকের গায়ে কি আদৌ হাত উঠবে? বরঞ্চ রক্তাক্ত হবেন চিকিৎসক নার্স ও সামান্য মাইনেতে কাজ করা কিছু স্বাস্থ্য কর্মী।
২. ধাপার মাঠে মালিকের বদলে পুড়বে কোনও স্বাস্থ্য কর্মীর দেহ।
৩.থুতুও মালিকের গা অবধি পৌঁছাবে না। থুতু মাখবেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই।
৪. গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষদের চিকিৎসার দায়িত্ব কেন সরকার নেবে না? সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কেন তাদের দ্বারস্থ হতে হবে কর্পোরেট হাসপাতালের?
আসলে সমস্যাটা অনেক গভীর। এবং সেটা রুদ্রনীলবাবুর মত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বুদ্ধিজীবীর জন্য আদৌ সুখকর নয়।
আমাদের দেশ ও রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেট অনেকটা নিম্নবিত্ত বাড়ির দুঃখিনী মায়ের খাওয়ার মত। সকলকে দিয়ে যদি কিছু বেঁচে থাকে তবে খাওয়া জোটে।
তাছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাও বেশ অদ্ভুত। সবচেয়ে অদ্ভুত হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। যার চাপে মান সম্মান বজায় রাখতে বহু চিকিৎসক চাকরি ছাড়ছেন। একজন জলজ্যান্ত উদাহরণ আমি। অথচ এখনো আমি মনেপ্রাণে সরকারি চিকিৎসকই রয়ে গেছি।
যাহোক, ব্যক্তিগত কথা বাদ দিয়ে বলাই যায়, জোড়াতালি দিয়ে চালানো সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে ভরসা দিতে পারছে না। ফলে তাঁরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
বেসরকারি পরিকাঠমো দিয়ে কখনো মহামারী আটকানো যায় না। এবং সেটা করার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সম্ভবত রুদ্রনীল বাবুও এটা জানেন। কিন্তু উনার হাত-পা বাঁধা। অতএব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
উনি ‘পুঁজিপতিদের কালো হাত ভেঙ্গে দাও- গুড়িয়ে দাও’ মার্কা পোষ্ট করে নিজের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটা মজবুত করলেন। যদিও তিনি ভালভাবেই জানেন ওই পুঁজিপতিদের গায়ে আদৌ হাত উঠবে না। মার খাবেন মহামারীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই স্বাস্থ্যকর্মীরাই। আর ওই পুজিঁপতিরা ভোটের সময় টাকার যোগান দেবে। তাই এই অসময়ে তাদের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করার জন্য সরকারি তরফে উৎসাহ দেখা যায় না। বিপ্লব শুধু ফেসবুকের উস্কানিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সবশেষে ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা। রুদ্রনীল বাবু পড়ে দেখবেন কি?
‘কান্নাকে কবিতা ভেবোনা’ https://thedoctorsdialogue.com/it-is-cry-not-a-poem/