আমাদের আধবুড়ো টেকো ডাক্তার নিশ্চিত জানেন উনি আদ্যন্ত একজন নিপাট হাতুড়ে। সামনের খালের পাতি হাঁসগুলো পর্যন্ত ওনাকে দেখলে কোয়াক কোয়াক বলে বিচ্ছিরি সুরে আওয়াজ দেয়। আশ্রমিক গরুরা ময়লা ঘেঁটে ফেরার সময় করুণার দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে যায়। তবু উনি নির্বিকার – স্কুটার ঘটঘট করে প্রতি সন্ধ্যায় খুপরিতে বসে রোগীর অপেক্ষা করেন। চেম্বারবালিকা (উনি কোনও অজ্ঞাত কারণে যাকে পিসিমা বলে ডাকেন) গেলাসে করে চাঙায়নী সুধা এনে দেয়। ডাক্তার ঢুলুঢুলু চোখে ঝিমন্ত হ’ন। বছর খানেক আগে একদিন এক ঘোষের বৌ – বছর পঁয়ত্রিশ বয়স – শ্যামলা ফুলো ফুলো ফুলের মতো সুন্দর – একা একাই এসে হাজির হলো।
ডাক্তার গেলাস হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন “কি হয়েছে?”
ঘোষের বৌ নতমুখে বলে “প্রেসার”
ডাক্তার বলেন “বুঝলাম কিন্তু কষ্টটা কি”
“ক্ষিধে হয় না – ঘুম হয় না” ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে বৌটি।
ডাক্তার পুরোনো ব্যবস্থাপত্র মানে প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেখেন। বহুদিনের প্রেসার। বহু ওষুধ খাচ্ছেন মহিলা। অথচ রক্তচাপ বেড়েই চলেছে, যাকে বলে বর্ধমান। ডাক্তার চিন্তায় টাক চুলকে আরও কয়েক গাছি চুল উঠিয়ে ফেলেন। পা দুটো একটুস ফোলা। শরীরে রক্তের অভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ ব্লাড প্রেসার ওপরে দুশো দশ নিচে একশো কুড়ি। না, না, ডাক্তার একদম স্থির জানেন যে শরীরে রক্ত না থাকলে ব্লাড প্রেসার কমবেই এরকম কোনও কথা কিন্তু মহাভারতে লেখা নেই। সুতরাং ওনার চেম্বারবালিকা সেই সুন্দরী পিসিমাকে আবার ডাক দিয়ে দ্বিতীয় পেয়ালার অনুরোধ জানালেন।
পিসিমা তখন মুঠোফোনে গান দেখছিলেন – বেজায় ব্যাজার মুখে গজর গজর করতে করতে পিসিমা পেয়ালা নিয়ে চলে গেলেন।
এক পেয়ালা ধূম্রবতী চাঙায়নী সুধায় ঠোঁট ঠেকিয়ে ডাক্তারের ঘিলুতে বুদ্ধি এলো। উনি খশখশিয়ে রক্তের কয়েকটা পরীক্ষা লিখে দিলেন। যাক, একটা দিন সময় পাওয়া গেল। ইত্যবসরে আগের ডাক্তারের কঠিন কঠিন ওষুধগুলোর কাজকর্ম বই ঘেঁটে দেখে নেবেন। পরের দিন সেই ঘোষের বৌ প্যাঙাশ মুখে এসে হাজির। প্যাঙাশ মুখ যে রক্তের অভাবে না রিপোর্টটা দেখে সেটা বলা শুধু মুশকিল নেহি না মুমকিন হ্যায়। ডাক্তার রিপোর্ট দেখলেন। ইউরিয়া একশো বারো, ক্রিয়াটিনিন চার দশমিক আট, হিমোগ্লোবিন সাত দশমিক পাঁচ। অর্থাৎ ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর। অস্যার্থ ঘোষের বৌয়ের দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছে।
ডাক্তার যখন বুঝিয়ে বললেন, তখন বৌটি জিগ্যেস করলো “তাহলে প্রেসার? সেটা কোথা থেকে এলো?”
হাতুড়ে বৌটির মাথায় হাত রেখে বললেন“মা, তুই চা খাবি?”
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বৌটির হাতের চা হঠাৎ লবণাক্ত হয়ে গেল।
হাতুড়ে ঘুমপাড়ানি সুরে বলে যেতে থাকেন “শোন মা ব্লাড প্রেসার সাধারণতঃ অনেক কারণে হয়। কারণ অনুযায়ী প্রেসারকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন প্রথমে আসে প্রাইমারি হাইপারটেনশন – হাইপারটেনশন জানিস তো এর মানে হলো উচ্চ রক্তচাপ। প্রাইমারি মানে যেখানে অন্য কোনও রোগ বা কারণ পাওয়া যায় না। যেমনটি হয় বয়সকালে। দ্বিতীয় হলো সেকেন্ডারি। অর্থাৎ একটা কোনও রোগ থেকে রক্তচাপ বেড়ে গেছে। যেমন ধর, রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস – একটা কঠিন অসুখ – ঐ যে ঠাকুর গড়ে? অনিল? ওর বৌয়ের হয়েছিল। মনে নেই? এনআরএসের হার্টের ডাক্তার রঞ্জন শর্মা মশাই ঠিক করে দিলেন?”
বৌটির চোখের জল শুকিয়ে গেছে- ঘাড় নেড়ে জানায় তার মনে আছে ।
“বা ধর ফিওক্রোমোসাইটোমা – এটা আবার একটা বিচ্ছিরি টিউমার – কিংবা তোর মতো কারো কিডনি খারাপ হয়ে গেলে। এছাড়াও অনেকের হঠাৎ হঠাৎ ডাক্তার দেখাতে গেলে প্রেসার বেড়ে যায়। আরো দুএক ধরণের প্রেসার আছে। তুই এখন চটপট কিডনির ডাক্তার দেখিয়ে নে।”
বৌটির চোখের জল আর বাঁধ মানে না । “আমাকে কোথাও আর দেখাতে নিয়ে যাবে না। ও রিপোর্ট আনতে গিয়ে জেনে গেছে আমার দিন শেষ।”
আজ আবার ঐ ঘোষের বৌটির কথা আমাদের বুড়ো ডাক্তারের খুব মনে পড়ছিলো। আজ ঘোষবাবু একজন গর্ভবতী নতমুখী নববধূকে নিয়ে বুড়োর খুপরিতে এসেছিলেন।