ডাক্তার ব্যাটা হতচ্ছাড়া –যত্তসব চশমখোর লুটেরা–পেশেন্ট পার্টির রক্তচোষা ছারপোকা –আরো নানাবিধ বিশেষণে আমরা আজকাল ভূষিত হয়ে থাকি, একেবারেই যে অকারণে সেটাও হয়তো নয়। ভালো ডাক্তার হওয়ার জন্য ডাক্তারি পাঠ ছাড়াও কিছু গুণাবলী প্রয়োজন মানছি।
কিন্তু শুধু ডাক্তার খসখস করে ওষুধ লিখে দিলেই তো আর রোগ সারে না। “নিরাময়” হল গিয়ে ডাক্তার রোগীর একটা পারস্পরিক সমঝোতা ও মান্যতার ফসল। সেই ‘নিরাময়’ অর্জন করতে গেলে রোগীদেরও কিছু নিয়মকানুন জানা দরকার। ভাল রোগী হতে গেলে কি’রকম আচরণ দরকার একটু বলা যাক।
ধরুন, আপনি জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন । কয়েক হাজার কারণে জ্বর হতে পারে — প্রশ্নের মাধ্যমে ডাক্তারকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো বুঝে নিতে হবে আপনার লক্ষণগুলো শরীরের কোন তন্ত্রের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। তারপর আপনাকে পরীক্ষা করা, চিন্তা ভাবনা করে ওষুধ পত্তর লেখা। ডাক্তারকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য অতি অল্প সময়ে নানারকম কঠিন মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় –সেই সময়টুকু একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন।
“ডাক্তারবাবু, আমার পিসতুতো শালা আপনাকে দেখিয়ে ভালো হয়ে গেছে, ওই তো আমাকে পাঠাল, সেই যে মন্ডলবাবু -গুসকরায় থাকে আপনাকে খুব ভালো ভাবে চেনে -ওই যে তার বুকের ব্যামো হয়েছিল—” এই জাতীয় অবান্তর কথা বলে অথবা ঠিক প্রেসক্রিপশন লেখার সময়েই “ডাক্তারবাবু কি খাব? ভাত খাব? ডাল খাব? ডালে কি ফোড়ন দেব? গরমজলে চান করব? রোদে গরম না গ্যাসে গরম?” ক্রমাগত প্রশ্ন করে ডাক্তারের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাবেন না। আপনার চিকিত্সা ও অসুখ সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ডাক্তার বাধ্য কিন্তু প্রশ্নগুলো পরীক্ষা ও প্রেসক্রিপশন লেখার পরে করবেন–ওটুকু সময় ধৈর্য প্রার্থনীয়। ডাক্তারবাবু যখন আপনাকে প্রেসক্রিপশনের ওষুধের নিয়ম বুঝিয়ে দেবেন তখন মন দিয়ে তা শুনে বুঝে নেবেন ও মনে রাখার চেষ্টা করবেন। অধিকাংশ রোগীই ঠিক মতো শোনেন না, ভাবেন –ও তো ফার্মেসীর লোকই বলে দেবে। তারা বলে দেবে ঠিক, কিন্তু ডাক্তারের চাইতে সঠিকভাবে বলবে না।
ওষুধ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস এসব ব্যাপারে ডাক্তারবাবু যা বলবেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। অনেক অসুখে আপনি এই নিয়ম গুলো না মানলে শুধু ওষুধে রোগ আয়ত্তে থাকে না –খুব সোজা উদাহরণ হল আপনি ডায়াবেটিসের ওষুধ আর যথেচ্ছ মিষ্টি একসঙ্গে খাচ্ছেন। এরকম অধিকাংশ অসুখেই বিভিন্ন ধরনের যাপন পদ্ধতি আছে।
পুরোনো বাংলা কথা ছিল –‘ডাক্তারের কাছে সবকিছু খুলে বোলো’। এটা খুব জরুরী। ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা কথা বললে বা কিছু লুকিয়ে গেলে আপনারই ক্ষতি। ধরুন উচ্চ রক্তচাপের জন্য আপনি ডাক্তার দেখালেন, তারপর আপনার পাশের বাড়ির বন্ধু বলল–“ধ্যুর ডাক্তারদের পাল্লায় পড়ে ওসব ওষুধ শুরু কোরোনা –সারা জীবন খেতে হবে একবার ধরলে তারচেয়ে অমুক গাছের রস খেয়ে দেখ।” পরের বার আপনি যখন ডাক্তার দেখাতে গেলেন সব কথা বেমালুম চেপে গেলেন। ডাক্তার মেপে দেখলেন প্রেশার একটুও কমেনি, তিনি চিন্তিত হয়ে ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন যেটা আপনার জন্য প্রয়োজন ছিল না। আপনাকে এবার বিশেষ ভাবে সতর্ক করে দিলেন আর আপনি সেই বর্ধিত মাত্রার ওষুধ খেতে শুরু করলেন। এরকম হাজারো পরিস্থিতি উপস্থিত হতে পারে রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে তথ্য আদান প্রদানে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা যদি না থাকে।
কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে দেখানোর সময়েই জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হবেন –বাড়িতে এসে ফোনে জিজ্ঞাসা করবেন না। প্রেসক্রিপশন বা রোগী না দেখে, খুব বিশেষ গুরুতর রোগী ছাড়া ফোনের কথায় ডাক্তারের পক্ষে মনে করে সঠিক উত্তর দেওয়া অসম্ভব এবং আইনবিরুদ্ধ। আজকাল প্রায়ই দেখি মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে এসে বাড়ির লোক বলেন –“ছেলে/ মেয়ে তো আছে পুণে / মুম্বই/ ব্যাঙ্গালোর–ওখানে ডাক্তার দেখাতে পারছে না –আপনার পুরো ভিজিট দিয়ে দেব –একটু দেখে দিন”।
রোগী সশরীরে সামনে উপস্থিত না থাকলে, তাকে পরীক্ষা না করে কোনো মতেই তার চিকিৎসা করা ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়।
নানারকম অবিজ্ঞানের থাবা তো ছিলই , ডাক্তারি শাস্ত্র সবচেয়ে বিপন্ন হতে বসেছে গুগল ডাক্তারের দাপটে। ডাক্তারিপাঠ কালে, ছাত্রদের এক একটা বিষয়ের শিক্ষায় শরীর ও রোগকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বারবার পড়ানো হয়। যেমন ধরা যাক–পাচনতন্ত্র ( Digestive system) -প্রথমে তার অ্যানাটমি– শব ব্যবচ্ছেদ করে মানুষের শরীরে কোথায় কিভাবে তা থাকে একেবারে ওষ্ঠ থেকে পায়ু –তার প্রতিটি শিরা উপশিরা ধমনী স্নায়ু লসিকাগ্রন্থি পেশী কোষ সব দেখতে হয়। এত বিশদে সব মনে রাখানোর জন্য এক একটা অংশের (যেমন খাদ্যনালি, পাকস্থলী, অন্ত্র—) পাঠশেষে একটা পরীক্ষা হয়–আইটেম, পুরো তন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ শেষে আবার পরীক্ষা–পার্ট। পুরো পেটের ব্যবচ্ছেদ শেষে আবার একটা বড় পরীক্ষা। একই সঙ্গে পাচন তন্ত্রের বিভিন্ন অংশের কোষ ও কলাগুলোও মাইক্রোস্কোপে দেখা ও তার পরীক্ষা চলতে থাকে –অ্যানাটমির হিসটোপ্যাথলজি ক্লাসে। এই সব তন্ত্রের যন্তরগুলো কাজ করে কিভাবে তা শিখতে হয় শারীরবিদ্যা (Physiology) ক্লাসে– সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শারীরবৃত্তীয় কাজও মগজস্থ করতে হয় সব হবু ডাক্তারকে। একইসঙ্গে চলে শরীর ও কোষের ভেতরের নানারকম রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ জানা Biochemistry বিভাগে।
Anatomy, Physiology, Biochemistry পাশ করে এক ধাপ পেরোনো হল। মানুষের স্বাভাবিক শরীরকে জানার এই শিক্ষার উপর ভিত্তি করে এরপর পড়তে হয় –বিভিন্ন অসুখে তার চেহারা কেমন বদলে যায়–ধরুন আলসার বা ক্যানসারে (তারও হাজারো রকমফের –সবগুলোই জানতে হবেই ) পাকস্থলীর চেহারা কেমন বদলে যায়–খালি চোখে ও মাইক্রোস্কোপের তলায়। এ হল প্যাথলজি। ফার্মাকোলজি বিষয় শেখায় বিভিন্ন ওষুধের রাসায়নিক গঠন, কোন রোগে কোন তন্ত্রে ঠিক কিভাবে কাজ করে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ডোজ ওভারডোজ ইত্যাদি। মাইক্রোবায়োলজি –আণুবীক্ষণিক সব জীবাণুর জীবনী, তারা কি অসুখ কিভাবে বাধায় এবং কিভাবে তাদের ধ্বংস করা যায়।
প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন –গুরুত্ব কম দেওয়া হলেও সবচেয়ে জরুরী বিষয়–সমাজে রোগ প্রতিরোধ ও নির্মূল করার উপায়। এই বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত আবার করে সব অসুখ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পড়তে হয়।
ফরেনসিক মেডিসিনের বিষয় সবাই জানেন। এই সাবজেক্ট পড়ার সময় আবার অন্যভাবে কাটাছেঁড়া করে মানুষের শরীরকে দেখা জানা। কেউ ফাঁস দিয়ে খুন করল না নিজে আত্মহত্যা করতে গলায় দড়ি দিল –তা শিখতে আবার প্রথমবর্ষের অ্যানাটমির অর্জিত জ্ঞান ঝালিয়ে নিতে হয়।
ফাইনাল ইয়ারে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি। মেডিসিনে — সব সব সব অসুখের উপসর্গ, লক্ষণ, পরীক্ষা নিরীক্ষা, রোগনির্ণয় , চিকিৎসা শিখতে হয় বই পড়ে, ওয়ার্ডে রোগী দেখে, বার বার পরীক্ষা দিয়ে। সার্জারিতে –আবার অ্যানাটমি মানে মানুষের শরীরের কোথায় কি সে সম্পর্কে পুনরায় পড়তে হয় কোন রোগে কিভাবে কোন অপারেশন করতে হবে তা শেখার উদ্দেশ্যে।
শিশুদের শরীর, শিশুদের রোগ, শিশুদের ওষুধ ডোজ সব কিঞ্চিত অন্যরকম ও তা বিশেষ মনোযোগ দাবী করে বলে Paediatric Medicine আলাদা বিষয় হিসেবে পড়তে হয়। স্ত্রীরোগও সেরকম আলাদা ভাবে Gynaeocology and Obstetrics, চোখ — Opthalmology, নাক কান গলা –ENT –আলাদা আলাদা বিষয় হিসেবে এমবিবিএস কোর্সে অবশ্যপাঠ্য ।
তাহলে বুঝতে পারছেন? Anatomy, Physiology, Biochemistry, Pharmacology, Pathology, Microbiology, Preventive and Social Medicine, Medicine, Surgery, Forensic Medicine and Toxicology, Paediatric Medicine, Gynaeocology, Eye , ENT — বিশদে এই সব গুলো বাদ্যযন্ত্রের সম্যক জ্ঞান থাকলেই “ডাক্তারি” নামক অর্কেস্ট্রাকে সুরে বাজানো সম্ভব।
এমবিবিএস পাশ করার পর সেই জ্ঞানটুকু হল। এরপর সিনিয়র ছাত্র ও শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্টেজে বাজানো। অর্থাৎ সরাসরি রোগীর চিকিৎসা করা। সাড়ে চার বছরের এত পড়াশোনা, ওয়ার্ডে রোগী দেখার পরও কিন্তু একজন ডাক্তার নিজে হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা করার স্থায়ী রেজিস্ট্রেশন নাম্বার পায় না যতক্ষণ না তার একবছরের ট্রেনিং পিরিয়ড, ইন্টার্ণশিপ শেষ হচ্ছে। এক বছর ইন্টার্ণশিপের সময়ে তাকে পালাক্রমে সবগুলো বিভাগে ঘুরে ঘুরে শিক্ষানবিশ থাকতে হয় –আউটডোরের রোগী, ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী, এমারজেন্সি রোগী ইত্যাদি সবরকম রোগীর মুখোমুখি হয়ে নিজেকে তৈরী করতে হয়।
এবার ভাবুন তো —-গুগলজ্যাঠার কিছু অক্ষর পড়ে কি ডাক্তারি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভব? ধরুন আপনাকে কেউ একটা কলাগাছ দেখিয়ে যদি প্রশ্ন করে –আপনি বলছেন, এটা কলাগাছ কিন্তু আমি তো গুগলে পড়েছি এটা কাঁকড়া –আর ইউটিউবে দেখেছি এলোভেরার রস মাখলে কাঁকড়াদের ল্যাজে চুল গজায়! এরকম চরম অসঙ্গতিপূর্ণ প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন? কিভাবে তাকে বোঝাবেন?
আমাদের ঠিক এরকম সমস্যায় পড়তে হয় গুগল পড়া ইউটিউবে ডাক্তারি পড়া পেশেন্টদের নিয়ে।
রোগ সংক্রান্ত কিছু অনুসন্ধিৎসা থাকা অবাঞ্ছনীয় নয় –তা ডাক্তারকেই বলবেন বুঝিয়ে দিতে।
এবার আপনি ভালো রোগী কিনা তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক —
১। আপনি রোগ ও চিকিত্সা সংক্রান্ত সব কথা ডাক্তারকে সঠিক বলেন?
২। ডাক্তারের নির্দেশ মন দিয়ে শোনেন?
৩। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখার সময়ে অধৈর্য হয়ে নানারকম অবান্তর কথা বলেন?
৪। ডাক্তারের নির্দেশ মেনে ওষুধ খান?
৫। ডাক্তার নির্দেশিত জীবনযাপন প্রণালী অনুসরণ করেন?
৬। পরবর্তী সময়ে যখন ডাক্তার দেখানোর কথা তখন দেখাতে আসেন?
৭। নিজে বা ডাক্তার ব্যতীত অন্যের নির্দেশে অন্য কোনো সমান্তরাল চিকিৎসা চালান?
মনেমনে উত্তর দিতে দিতে নিজেই বুঝতে পারবেন আপনি ভালো রোগী কিনা ।
This is a necessary information for Doctors and Patients .
Wonderful article. It will help patient to understand what goes in the mind of a doctor
Thank you NITAI for your encouraging words
Can’t appreciate more…the need of message and the delivery…both deserve cognition. Excellent Didi.
Thank you Shubhranka for your encouraging words .
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
I learn something new and challenging on blogs I stumbleupon everyday.
Thanks for fantastic info I was looking for this info for my mission.
I used to be able to find good info from your blog posts.